বর্ষায় প্রেম

0
327

মুহাম্মদ ফজলুল হক

জীবনে অনিবার্য কিছু নেই। সময়ের আবর্তে
বহুকিছু অনিবার্য হয়ে উঠে। বয়স বাড়ার সাথে
সাথে পাল্লা দিয়ে অনিবার্যতা বাড়তে থাকে। কখন
কি অনিবার্য হয়ে উঠবে তা ব্যক্তি নয় সময়ই
নির্ধারণ করে। আমীর আলীর একদা ইসমাইলকে
ভালো লাগত। মাঠে, ঘাটে, গোসলে, বৃষ্টিতে কিংবা
অলস দুপুরে পাখীর বাসা ভাঙ্গতে সর্বদা সঙ্গী
ইসমাইল। এমন কোন কর্ম নেই এই মানিক জোড়
করেনি।
কৈশোর ডিঙ্গিয়ে যৌবনে পদাপর্নে আমীর আলীর
মোহ পরিবর্তন হয়। তার জীবনে অনিবার্য হয়ে
উঠে সুলতানা। ডাগর চোখ, ঢেউ খেলানো চুলের
মেয়েটি তাকে স্তব্দ করে রেখেছে। নাওয়া-খাওয়া,
ঘুম বন্ধ হয়ে আছে। সুলতানা তার আরাধ্য। তার
চলন, বলন, তাকানোর ধরণ, পোষাক, শরীর তাকে
পাগল করে তুলেছে।

বর্ষার আগমনে নদী, নালা, খাল, বিল ছাপিয়ে
বাড়িঘর পানিময় হয়ে উঠার গন্ধ ও ভ্যাপসা গরম

আমীর আলীর শরীরের গরমকে ছাপাতে পারে না।
আবদ্ধ ঘরে থেকে বেড়িয়ে সে নৌকায় উঠে। নৌকা
চালিয়ে বিল পেড়িয়ে নদীর কাছাকাছি চলে আসে।
বৈঠা রেখে নৌকার হাল ছেড়ে আকাশ পানে তাকিয়ে
হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে পরে।

তার মনের খেলা তার উপলব্ধির বাইরে। নিজকে
শান্ত করে সে। প্রচণ্ড গরম তাকে ক্লান্ত না
করলেও দমকা বাতাস ও হঠাৎ বৃষ্টিতে স্বস্তি
আসে। শরীর ও মনে সজীবতা আসলে উঠে বসে
আমীর আলী। অচেনা পরিবেশে তাকিয়ে অবাক হয়।
কিছুক্ষণ পর ঝুঝতে পারে স্রোতের টানে ভাসতে
ভাসতে নৌকা বহুদূর চলে এসেছে। বৈঠা হাতে
স্রোতের প্রতিকূলে ছুটে চলে আমীর আলী।

প্রকৃতির বৈচিত্র্যে মুগ্ধকর। তাপামাত্রা আর
পানির তাপে যে অসহ্যময় পরিবেশ ছিল নিমিষেই তা
পরিবর্তন হয়ে সিগ্ধ, শান্তিময় পরিবেশে রূপ
নিয়েছে। বর্ষার আগমনে চেনা পরিবেশ অচেনা

হলেও আমীর আলীর কাছে নতুন নয়। কয়েক দিনের
টানা বৃষ্টি আর গোমতী নদীর পানিতে

টুইটুম্বর সব। কোথায় থেকে আসে এত পানি,
কোথায় চলে যায়! ভাবতে ভাবতে পরিচিত এলাকায়
নৌকা চলে আসে। ঐ তো গ্রাম দেখা যায়। বিশাল
বটবৃক্ষ বহুদূর থেকে তার গ্রামকে চিনিয়ে দেয়।
গ্রামকে দেখেই সুলতানার কথা মনে হয়। খুশীতে
ভরে উঠে মন।

সুলতানা ভিন্ন জগতের মানুষ। মানুষের চেয়ে হাঁস
মুরগী, গরু, ছাগলের সাথে ভাব বেশি। তাদের কথা
বুঝতে পারে সে। সারাদিন এদের সাথে ভাব বিনিময়
করে, কথা বলে। তার কথা হাঁস-মুরগী বুঝে নাকি সে
বুঝে হাঁস মুরগীর কথা তা উপলব্ধি করা মুশকিল।
সন্ধা ঘনিয়ে আসছে, আকাশ মেঘলা। বৃষ্টি এলো
বলে। তার ইশারায় হাঁস-মুরগী ঘরে প্রবেশ করে হৈ
চৈ করছে। যেন ডাকছে সুলতানাকে। সে এসে কিছু
একটা বললে সব শান্ত হয়ে যায়। দরজা টেনে যায়
ছাগল ও গরু ঘরের দিকে। সামান্য খাবার দিয়ে গায়ে
হাত বুলিয়ে বলে ঝড় বৃষ্টি হতে পারে। ভয় পাবি না।
শান্ত হয়ে থাকবি। মাথা নেড়ে সায় দেয় তারা।

সে রান্না ঘরে যায়। মা এখনো সেখানে। মায়ের পাশে
বসে। মা তার দিকে তাকিয়ে হাসে। আয় আমার
কাছে। কতদিন তোকে আদর করি না। মা তাকে
জড়িয়ে ধরে। অবাক হয় সুলতানা। কি হল মায়ের!
মাতো কখনো এমন করে না। হেসে উঠে সুলতানা।
রাতে খেতে বসে মা একটু বাড়তি যত্ন নেয়
সুলতানার। বাবা বরাবরের মত গম্ভীর। তরকারী
পছন্দ না হওয়ায় ছোট ভাই খাওয়া শেষ না করে
উঠে যায়।

অভাবের সংসার। বর্ষাকালে বাবার তেমন কাজ
থাকে না। মা সকালে চলে যায় অন্যের বাড়িতে কাজ
করতে। সকাল থেকে সন্ধা অবধি সব সামলে নেয়
সুলতানা। হাঁস-মুরগী নিয়ে সময় তার ভালো চলছিল।
বাঁধ সাধে আমীর আলী। নাকি সে! নিজেই বুঝতে
পারে না। গরু চড়ানো কালে আমীর আলী তাকে
সহায়তা করে। সেই থেকে ভাব। বর্ষা আসায় মাঠে
না যেতে পারায় দেখা কম হয়। সে কথা ভাবতে
ভাবতে ঘুমাতে যায়।

সকালে গরু বাহির করে গোয়ারঘর পরিষ্কার করে।
গরুকে খাবার দিয়ে সুলতানা বলে, কি গো ময়না

আজ কি আসবে আমার বন্ধু? হ্যা সূচক উত্তর
পেয়ে গরুকে আদর করে ছাগল বাহির করে হাঁস-
মুরগী ছেড়ে দেয়। দুটো হাঁসের ও তিনটি মুরগীর ডিম
নিয়ে ঘরে ফিরতে ফিরতে ভাবে সব ডিম সিদ্ধ
করতে হবে। আমীর আলীর আবার ডিম পছন্দ।

দুপুরের পর গরুর ঘরের পাশে এসে আমীর আলী
অপেক্ষা করে। ময়না ডেকে উঠে। সুলতানার বুঝতে
দেরি হয় না আমীর আলী এসেছে। সে জানে আমীর
আলী এলেই ময়না এমন করে ডেকে উঠে। গরুর ঘর
বাড়ির পিছনে। তাদের দুইটি ঘর। প্রথমটি রাস্তার
পাশে। ছোট ভাই থাকে। বড়সর উঠান পেড়িয়ে
দ্বিতীয় ঘর। এই ঘরে বাবা-মায়ের সাথে সুলতানা
থাকে। সামান্য দূরে রান্নাঘর পেড়িয়ে ময়নাদের
ঘর। ঘরের পিছনে সরু খাল বর্ষার পানিতে ভরপুর।

লিখুন প্রতিধ্বনিতেলিখুন প্রতিধ্বনিতে

ময়নার ডাক শুনেই চাঙ্গা হয়ে উঠে সুলতানা। দৌড়ে
এসে জড়িয়ে ধরে আমীর আলীকে। পরম শান্তি নেমে
আসে। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে সতর্ক হয় আমীর
আলী। একটু এগিয়ে খাল পাড়ে বসে।

পানিতে পা নাচায় সুলতানা। তাকে সুখী দেখায়।
খোসা ছড়ানো ডিম আমীর আলীর মুখে তুলে দেয়
সুলতানা। খুশী হয় আমীর আলী ।

পরদিন বিকালে নৌকা নিয়ে বের হয় তারা।
চারিদিকে থৈথৈ পানি। যে দিকে চোখ যায় পানি আর
পানি। দূরে গ্রামে গাছগাছালির আবছায়া দেখা যায়।
বিল পেড়িয়ে নদীতে চলে আসে নৌকা।
ঢেউ আতঙ্ক ছড়ায়। ফিরে আসার চেষ্টা করে
ব্যর্থ হয় আমীর আলী। কিছুটা এগিয়ে আবার বিলে
প্রবেশ করতেই শুরু হয় বাতাস। মূহুর্তে অন্ধকার
হয়ে যায় আকাশ। সুলতানার মুখে ভয় না দেখে
স্বস্তি পায় আমীর আলী।

বাতাস থেমে যায়। নৌকা ধীরে ধীরে বিলে ভাসে।
পানির শব্দ, মেঘের গর্জন ছাপিয়ে বৃষ্টির ফোঁটা
নেমে আসে। সুলতানার ভেজা চুল কাঁধ ছুঁয়ে ঝুলে
পড়ে। ঠোঁটে বৃষ্টির আবেশ। আমীর আলী চুপচাপ
তাকিয়ে থাকে তার দিকে।
সুলতানা বলে, কী দেখ?

তোমায়। তোমার মধ্যে এমন কিছু আগে দেখিনি।
সুলতানা হেসে চোখ ফেরায়। নৌকা দুলে ওঠে।
আমীর আলী ধীরে ধীরে হাত বাড়িয়ে সুলতানার
ভেজা আঙুলগুলো নিজের হাতে নেয়। সুলতানা বাধা
দেয় না।

হঠাৎ দমকা হাওয়া। কেঁপে ওঠে সুলতানা। আমীর
আলী তার কাঁধে হাত রাখে। মুহূর্তে দু’জনের চোখ
এক হয়ে যায়। আকর্ষণ আর কৌতূহলের অদ্ভুত
সংমিশ্রণে সে চোখে ধরা দেয় মুগ্ধতা। সুলতানা
ফিসফিসিয়ে বলে, তুমি কি চাও?

আমীর আলী সাড়া দেয় না। শুধু তার মুখের খুব কাছে
গিয়ে থেমে যায়। বৃষ্টি কমে আসে। নিঃস্তব্ধ
চারপাশ। সেই নীরবতায় দু’জনের নিঃশ্বাসের শব্দ,
চোখের ভাষা, স্পর্শ মিলে সুখময় প্রেমের কাব্য
রচনা করে।

নৌকা যেন স্বপ্নপুরীতে ভাসে। পানিতে বৃষ্টি পড়ার
শব্দ, পানির কাঁপুনি ছুঁয়ে দেয় নৌকার গা। সেই

কাঁপুনি ছড়িয়ে পড়ে তাদের শরীরেও। সুলতানা
চুপচাপ বসে আছে। ভেজা কাপড়, শরীর কাঁপছে।

আমীর আলী বলে, শীত লাগছে?
সুলতানা কিছু বলে না, মাথা নাড়ে।
আমীর আলী নিজের গামছা সুলতানার গায়ে জড়িয়ে
দেয়। তার আঙুল ছুঁয়ে যায় সুলতানার আদ্র চিবুক।
ভেজা চুল। সুলতানা তাকিয়ে থাকে। চোখে লজ্জা,
কৌতূহল সত্বেও কোথাও যেন নিরব সম্মতি।

হঠাৎ নৌকার দুলুনিতে তারা আরো কাছাকাছি চলে
আসে। তুমি কি জানো, নদী কিন্তু সব কথা শুনে।
আমীর আলী ফিসফিসিয়ে হাসে। তাহলে নদীকে
শুনিয়েই বলি, আমি তোমায় ভালোবাসি।

সুলতানা মুখ নামিয়ে নেয়। তার লাজুক মুখে এমন
এক টান আছে যা আমীর আলীকে আরো কাছে টেনে
নেয়। সে ধীরে ধীরে সুলতানার কপালে চুমু দেয়।
তারপর চোখে। সুলতানার নিঃশ্বাস থেমে আসে
কয়েক মুহূর্তের জন্য।

আমীর আলী কাঁধে মাথা রাখে সুলতানা। নৌকার
তলার ছলছল শব্দের মতো তাদের স্পর্শগুলোও

শব্দহীন। নিমিষেই মিশে যায়। আমীর আলীর হাত
ধীরে ধীরে নামছে। সুলতানার আঙুল ছুঁয়ে যাচ্ছে তার
বুকে। তাড়াহুড়া নেই। চঞ্চলতা নেই আছে শুধু
গভীর, স্নিগ্ধ নিবেদন।

বৃষ্টি থেমে যায়। আকাশে সন্ধ্যার নীলাভ আলো।
চারপাশের নিস্তব্ধতায় সুলতানা লেপটে থাকে
আমীর আলীর বুকে। তার চোখে তখন আর লজ্জা
নেই। আছে অদ্ভুত প্রশান্তি। বৃষ্টির শেষ
ফোঁটাগুলো নৌকার কাঠে পড়ে সুর তোলে।

নৌকা এখনো আস্তে আস্তে দুলছে। সুলতানা উঠে
বসে। তার চোখে নতুন আলো। সে বলে, জানো, আমি
কখনো কাউকে বিশ্বাস করতে পারিনি। আমার মনে
হতো সবাই শুধু চায়। কেড়ে নিতে চায়। আমীর আলী
মুখ তুলে বলে, আমি চেয়েছিলাম তোমার কাছে
আসতে। কিন্তু এখন বুঝছি, তোমার কাছে থাকাটাই
অনেক বেশি। এই মুহূর্তের জন্য আমি ধন্য।
সুলতানা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে, আমি নদীর
মানুষ, বাঁধা মানি না। তবুও তোমার সাথে ঘর

বাঁধতে ইচ্ছে করে। আমীর আলী বলে, তাহলে তো
ভালোই হল। আমার বুকই হোক তোমার ঘর।
যেখানে ভয় নেই, অনাচার নেই, শুধু আছে আশ্রয়।

আকাশে হঠাৎ তারা দেখা যায়। সুলতানা আঙুল
তুলে দেখিয়ে বলে, ওই তারা দেখে একটা ইচ্ছা
করো। আমি তো করেই ফেলেছি, তুমি? সুলতানা
চোখ বন্ধ করে হাসে। হেসে উঠে আমীর আলীও।
আবারো বৃষ্টি শুরু হয়। মুষলধারে বৃষ্টি। বৃষ্টির
সুরে হাসির মুগ্ধতা ভালোবাসার গান হয়ে আগামীর
বীজ বুনে।.,.

Previous articleমোবাইল বিস্কুট 
Next articleআয়নার ওপারে
প্রতিধ্বনি
প্রতিধ্বনি একটি অনলাইন ম্যাগাজিন। শিল্প,সাহিত্য,রাজনীতি,অর্থনীতি,ইতিহাস ঐতিহ্য সহ নানা বিষয়ে বিভিন্ন প্রজন্ম কী ভাবছে তা এখানে প্রকাশ করা হয়। নবীন প্রবীণ লেখকদের কাছে প্রতিধ্বনি একটি দারুণ প্ল্যাটফর্ম রুপে আবির্ভূত হয়েছে। সব বয়সী লেখক ও পাঠকদের জন্য নানা ভাবে প্রতিধ্বনি প্রতিনিয়ত কাজ করে চলেছে। অনেক প্রতিভাবান লেখক আড়ালেই থেকে যায় তাদের লেখা প্রকাশের প্ল্যাটফর্মের অভাবে। আমরা সেই সব প্রতিভাবান লেখকদের লেখা সবার সামনে তুলে ধরতে চাই। আমরা চাই ন্যায়সঙ্গত প্রতিটি বিষয় দ্বিধাহীনচিত্ত্বে তুলে ধরতে। আপনিও যদি একজন সাহসী কলম সৈনিক হয়ে থাকেন তবে আপনাকে স্বাগতম। প্রতিধ্বনিতে যুক্ত হয়ে আওয়াজ তুলুন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here