সাবরিনা তাহ্সিন
পবিত্র মাহে রমজানের শেষ কিছুদিন বাকি।সামনেই ঈদের ছুটি।শুরু হবে নাড়ীর টানে বাড়ি ফেরার তোড়জোড়।
ইকবাল হাসানের ছোট পরিবারেও সেই প্রস্তুতি চলছে।ইকবাল হাসানের একমাত্র মেয়ে মিষ্টি বায়না ধরেছে এইবারের ঈদের দিনগুলো সে তার নানাবাড়ী যশোরের ঝিকরগাছায় কাটাবে।মেয়ের কথায় আফসানা বেগম খুশি হলেও কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ে।কারণ, এতো দূরের জার্নিতে মেয়ে আবার অসুস্থ না হয়ে পড়ে।
আফসানার চিন্তার বিষয়ে অবগত হয়ে ইকবাল হাসান স্ত্রীকে অভয় দিয়ে বলে ,” কী আফসানা! তুমি কী খুশি হও নি ? মেয়ে এতো দূরের জার্নিতে অসুস্থ হয়ে পড়বে কী না ,এ নিয়ে চিন্তিত! এতো চিন্তা করো না তো! আর আমরা তো রাতের ট্রেনেই যাবো।ট্রেনে গেলে কোনো সমস্যা হবে না।”
ইকবালের কথায় আফসানা বেগম একটু আশ্বস্থ হয়।তারপর বলে ,” আর মাত্র সাতদিন পর ঈদ।ঈদের কিছু কেনাকাটা করা বাকি।আর ট্রেনের টিকেট আগে আগেই কেটে রাখা দরকার। পরে ট্রেনের টিকেট যদি না পাওয়া যায়!”
ইকবাল বলে ,” আচ্ছা ,ঠিক আছে।আমি অনলাইনে ট্রেনের টিকেট কেটে রাখছি।আর তোমাদের যা কেনাকাটা করার করে নিও,আলমারিতে টাকা রেখে যাচ্ছি।আমার অফিসে কিছু কাজ আছে।”
নানাবাড়ী ঈদ করতে যাবে , এই খুশিতে মিষ্টির আনন্দের সীমা নেই। মিষ্টির স্কুলেও ঈদের ছুটি শুরু হয়ে গেছে।তাই,মা-মেয়ে বের হয় ঈদের কেনাকাটা করার জন্য। শপিংমলে ঘুরতে ঘুরতে গোলাপি রঙের সুন্দর একটা ফ্রক মিষ্টির পছন্দ হয়ে যায়। আফসানা বেগম মেয়ের জন্য গোলাপী রঙের ফ্রকটি কিনে দেয়।আফসানা নিজের জন্য জলপাই রঙের একটা শাড়ী কিনে আর ইকবালের জন্য কিনে হালকা আকাশী রঙের পাঞ্জাবী।
ঈদের কেনাকাটা শেষ করি মা-মেয়ে বাসায় ফিরে আসে।ইকবাল হাসানও অফিসের কাজ শেষ করে বাসায় আসে।মিষ্টি ও আফসানাকে ডেকে বলে ,” কই গো ,কোথায় তোমরা! একটা সুখবর আছে,এসো।”
সুখবর শুনে ,মা-মেয়ে একসাথে ছুটে এলো ড্রয়িংরুমে। মিষ্টি বললো ,” কী সুখবর, বাবা ?বলো ,তাড়াতাড়ি বলো।”
ইকবাল জবাব দেন ,” আমার অফিসেও দুই দিন পর থেকে ঈদের ছুটি।তাই ট্রেনের টিকেট ফেলেছি।ঢাকা থেকে মধ্যরাতে ট্রেন ছাড়বে।”
আফসানা বেগম বলেন ,” আরে বাহ্।এতো আসলেই খুশির খবর। আমরা তাহলে কবে যাচ্ছি ?”
ইকবাল জবাব দেন , “৭ তারিখ তো ঈদের দিন। আমরা যাচ্ছি ঈদের তিনদিন আগে, মানে চার তারিখ দিবাগত রাতে। “
আফসানা বেগম বলেন ,” তাহলে তো তিনদিন পরই যাচ্ছি ।এখনই তো ব্যাগ গুছিয়ে রাখতে হবে।ও ,আমরা মা-মেয়ে ঈদের কেনাকাটা করেছি। “
ইকবাল বলেন, ” হুম, এখনই ব্যাগ গুছিয়ে রাখো। আর কী কেনাকাটা করলে ফ্রেশ হয়ে এসে দেখছি। “
ইকবাল হাত-মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে আফসানাদের ঈদের কেনাকাটা দেখে। গোলাপী রঙের ফ্রকটা হাতে নিয়ে মেয়ের গাঁয়ে ধরে বলে ,” আরে বাহ্।আমার মিষ্টি পরী।”
জলপাই রঙের শাড়ীটা হাতে নিয়ে বলে ,” আফসানা, এই শাড়ীটা তুমি পড়লে দারুণ মানাবে।”ইকবালের কথা শুনে আফসানার ঠোঁটে লাজুক হাসি খেলে যায়।
আফসানা আকাশি রঙের পাঞ্জাবিটা ইকবালের হাতে দিয়ে বলে ,” এই নেও ,এই পাঞ্জাবিটা তোমার জন্য। “
ইকবাল বলে,” এটা আমার জন্য! তোমার পছন্দের প্রশংসা করতে হয়।অনেক ধন্যবাদ। “
মিষ্টি ক্যালেন্ডারে দিন গুনতে থাকে। দেখতে দএখতে অপেক্ষার প্রহর শেষ হয়। ইকবাল হাসান পরিবারের সাথে ইফতারি করে।তারাবিহ নামাজ পড়ে এসে ইকবাল পরিবারের সাথে রাতের খাবার খেয়ে নিজে তৈরী হয়ে নেয়।মিষ্টি ও আফসানাকে তাড়াতাড়ি তৈরী হতে বলে।রাত তখন ১০:৩০ মিনিট। ইকবাল হাসান মিষ্টি ও আফসানাকে নিয়ে সি.এন.জি সহযোগে কমলাপুর স্টেশনের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে।স্টেশনে পৌঁছাতে পৌঁছাতেই প্রায় ১১:০০ টা বেজে যায়। ট্রেন ছাড়তে আরও ঘন্টাখানেক সময় বাকি।তাই, তারা ওয়েটিং রুমে গিয়ে অপেক্ষা করে।দেখতে দেখতে কীভাবে যেন এক ঘন্টা সময় পার হয়ে গেলো!বেনাপোল এক্সপ্রেসের হুইসেল বেজে উঠে।মিষ্টি বাবার কোলে ঘুমিয়ে গিয়েছিল।ইকবাল এক হাতে ব্যাগ আর অন্য হাতে মেয়েকে কোলে করেই তাদের বগি খুঁজতে থাকে। আফসানা বেগমও একটা লাগেজ নিয়ে ইকবালের পিছন পিছন ছুটতে থাকে। অতঃপর নির্ধারিত বগিতে তারা তাদের আসন গ্রহণ করে।ট্রেন ছাড়তে ২০ মিনিট বিলম্ব ঘটে।১২:২০ মিনিটে ট্রেন যশোরের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে।
আফসানা ও ইকবালের মাঝখানে মেয়ে মিষ্টি তখন ঘুমিয়ে পড়ে।সেহরিতে উঠে খেতে হবে।তাই ইকবাল -আফসানাও ঘুমিয়ে পড়ে।ট্রেন চলতে শুরু করে।নিরিবিলি শূন্য ঘুটঘুটে অন্ধকারে ট্রেন দুরন্ত গতিতে ছুটে চলে।৪:৩০ ঘটিকায় সেহরীর শেষ সময়।কিন্তু ২:৩০ মিনিটে ট্রেনের হুলুস্থূল শব্দে ইকবালের ঘুম ভেঙ্গে যায়।কিছু বুঝে উঠার আগেই দেখে,চারদিক ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন। কাউকে জিজ্ঞেস করার কোনো অবকাশ নেই। দূর থেকে আওয়াজ ভেসে আসছে…..”ট্রেনে আগুন! “
ইকবাল বুঝতে পারে না যে, এটা সত্য!নাকি সে স্বপ্ন দেখছে! আর জানালার পাশে থাকার কারণে তিনি বেরও হতে পারছিলেন না।ততক্ষণে আগুনের স্ফুলিঙ্গ চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে।ইকবালদের সিট ” ঙ” বগির মাঝামাঝিতে ছিলো। ” গ” বগির শেষের দিক থেকেই আগুনের সূত্রপাত ঘটেছে বলে অনুমান করা হয়।মুহূর্তেই সব কিছু পুড়ে ছাই। ইকবালের জীবন বাঁচানোর অনেক সুযোগ ছিলো।কিন্তু তিনই স্বার্থপর হতে পারলেন না।আগুনে ঘুমন্ত স্ত্রী-কন্যার দেহ পুড়ে অঙ্গার হয়ে গেছে।চোখের সামনে এই হৃদয়বিদারক দৃশ্য একজন বাবার কাছে,স্বামীর কাছে কতোটা বেদনার হতে পারে! সেখানে ইকবাল কাদের নিয়ে বেঁচে থাকবেন!তাই তিনি আগুনের কাছে নিজেকে সমর্পিত করেন।একটা আনন্দযাত্রার এমন বিষাদঘন পরিণতি হতে পারে ,তা কেউ ভাবতে পারে নি।চারদিকে কালো ছাই, আগুনে পোড়া গন্ধ, দগদগে ক্ষতচিহ্ন ।আফসানা তার মা-বাবাকে আগেই জানিয়ে রেখেছিলো, ঝিকরগাছা যাওয়ার কথা। আফসানার মা-বাবা যখন টেলিভিশনে বেনাপোল এক্সপ্রেসের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা জানতে পারলেন, তখন আফসানার বাপের বাড়িতেও শোকাচ্ছন্ন পরিবেশের অবতারণা ঘটে।অনেক মরদেহ পুড়ে অঙ্গার হয়ে গেছে। আর যারা জাগ্রত ছিলো,তারা প্রাণপণে ছুটে জীবন বাঁচাতে পেরেছে।অঙ্গার দেহ শনাক্ত করা সহজ নয়।তবুও কেউ কেউ নিজেদের হারানো স্বজনদের ক্ষতচিহ্ন খুঁজতে এসেছেন অঙ্গার হওয়া বগিগুলোতে ।
ঈদের আনন্দ ম্লান হয়ে গেছে আফসানাদের ঝিকরগাছা বাড়িতে। মেয়ে ,নাতনি,মেয়ে -জামাইয়ের এমন অনাকাঙ্খিত মৃত্যু কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছে না আফসানার মা-বাবা। মায়ের আহাজারি ,ভাই-বোনের
গগনবিদারি কান্না ,বাবার বিলাপে চারপাশে শোকের মাতম বিরাজ করছে।
