মোঃ নূরনবী ইসলাম সুমন
সুবহে সাদিকের আকাশে যখন আজানের সুর ভেসে উঠলো, শহরের এক কোণে গুটিশুটি মেরে শুয়ে থাকা রাস্তার শিশু রাকিব ঘুম ভাঙলো না। কারণ তার ঘুম ছিল না। রাতে পেটের যন্ত্রণায় সে শুধু চোখ বন্ধ করে রেখেছিল, যেন না দেখলেই ক্ষুধা চলে যায়।
আজ ঈদুল আজহা। শহর জুড়ে উৎসবের রঙ, মাংসের গন্ধ, কোরবানির পশুর হুঙ্কার—সবই যেন এক বদ্ধ সমাজের সীমিত মানুষের জন্য। আর অন্য প্রান্তে কিছু মানুষ কোরবানির মাংসের আশায় দাঁড়িয়ে, যাদের কুরবানির ধোঁয়ায় চোখ জ্বলে, কিন্তু পেট ভরে না।
রাকিবের বাবা ছিল একজন হেলপার, মারা গেছে ক’মাস আগে এক সড়ক দুর্ঘটনায়। মা পাগলের মতো এখন ভিক্ষা করে। কুরবানির আগের দিনেও তাদের ঘরে একটা চালের দানাও ছিল না। রাকিব জানে, কুরবানির ঈদ মানেই পেট ভরে মাংস খাওয়ার স্বপ্ন দেখা। কিন্তু এ স্বপ্ন কেবল স্বপ্নই থেকে যায়।
শহরের এক নামকরা ব্যাচেলর হোস্টেলের পাশের রাস্তায় রাকিব দাঁড়িয়ে থাকে। কোরবানির পর ছেলেরা চামড়া দেয় ফেলে। তারা বলে, “এই নে, নিয়ে যা!”—মাংস নয়, চামড়া। রাকিব জানে, চামড়াটা নিয়ে গেলে দোকানদার হয়তো ৫০ টাকা দেবে। সেই টাকায় দুটো রুটি আর একটু ডাল কিনে মা আর ছোট বোন মিতুকে খাওয়াতে পারবে।
কিন্তু তার চোখ খোঁজে মাংস। একটুকরো—শুধু একটুকরো।
সে সারা শহর ঘুরে ফিরে দেখে, বিত্তবানদের বাড়িতে মাংসের গন্ধে ভরপুর রাঁধুনিদের ব্যস্ততা, অতিথিদের আগমন। বড় বড় পলিথিন ব্যাগে করে ‘দান’ দেওয়া মাংস যারা এনে দিচ্ছে, তারা নিজেরাই মোটা, চেহারায় অনীহা। সেসব ব্যাগ গরিবদের হাতে পড়ে পঁচে যায়, ভাগাভাগি নিয়ে ঝগড়া হয়, মাংস খাওয়ার আগেই সম্মানটুকু পচে যায়।
রাকিব একবার সাহস করে বড় এক বাসার ফটকে গিয়ে বলল, “আন্টি, একটু মাংস দিবেন?” মহিলা বললেন, “তোরে কে পাঠাইছে? তোর বাসায় তো আগেই মাংস পাঠানো হইছে। ফালতু ভিক্ষা করিস না।”
রাকিব কিছু বলল না। জিভে কামড় দিয়ে চলে এল।
তবে রাকিব জানে না, তার বাসায় মাংস আসেনি। সেই মহিলার গাড়িচালক নিজের ভাগের মাংস নিয়ে গেছে, যেটা ‘দান’ করার কথা ছিল।
শহরের এক পাশে তখন সদ্য কোরবানি হওয়া গরুর চামড়া তুলে নিচ্ছে কিছু শিশু। তাদের পোশাক ছেঁড়া, হাতে ছুরি, মুখে ধোঁয়া ও রক্তের গন্ধে অস্থিরতা। রাকিব তাদের দলে যায়নি। তার মা বলেছিল, “তুই মানুষের মতো বড় হবি, মাংস না খাইলে কিছু হয় না।”
কিন্তু পেটের যন্ত্রণা বড় নিষ্ঠুর। সে যায় পুরনো কসাই বাজারে, যেখানে লোকজন বর্জ্য ফেলে দিয়েছে। সেখান থেকে এক বৃদ্ধ কোরবানির ভাঙা হাঁড় কুড়িয়ে নিচ্ছেন। সেই বৃদ্ধ রাকিবকে দেখে বলেন, “পেট খালি, না?” রাকিব মাথা নাড়ায়।
বৃদ্ধ বলেন, “এই হাঁড়টা নিয়ে যা। তোর মা জ্বাল দিলে একটু ঝোল হবে।”
রাকিব হাতে হাড় নিয়ে যায়। পেছনে ঈদের নামাজ থেকে ফেরত আসা মানুষজন তাকায়—কেউ করুণা করে, কেউ বিরক্ত হয়, কেউ দেখে না।
একদিকে লোকেরা মোটা গরু জবাই করে লাইভে দেয়। ক্যাপশন: “আলহামদুলিল্লাহ! এক লাখ ষাট হাজার টাকার গরু। গরিবদের জন্যও আলাদা ভাগ রেখেছি।” কিন্তু ভাগ পৌঁছায় না, ভাগীরা নিজেই খায়।
আরেকদিকে বস্তির ভিতর আবু কাশেম, যিনি সারা বছর কসাইয়ের কাজ করেন, ঈদে কোনো কাজ পান না কারণ ‘আল্লাহর নামে’ কোরবানির দিনে তাকে আর দরকার পড়ে না। বরং ‘ঘরোয়া কসাই’ নামে ইউটিউব দেখে মানুষ নিজেই ছুরি চালায়।
আবু কাশেম বলেন, “শুধু কোরবানি না ভাই, এই শহরে গরিবের জন্য কিচ্ছু নেই। মাংসের গন্ধ আছে, খাবার নেই। নামাজ আছে, মন নেই।”
ঈদের তৃতীয় দিন। রাকিব এখনও মাংস মুখে দেয়নি। তার মা তিন দিন ধরে কাঁদছে। মিতু পেটের ক্ষুধায় বমি করে দেয়। এক প্রতিবেশী অবশেষে তাদের অল্প একটু মাংস দিলেন—তাও বাঁসা গন্ধ বের হওয়া পুরনো। মা সেটা ধুয়ে, লবণ দিয়ে ভালো করে সিদ্ধ করলেন। রাকিব প্রথমবারের মতো মুখে দিল মাংস। তার মুখে রক্ত জমাট বেঁধে আছে যেন, গন্ধে বমি আসে, কিন্তু খায়। কারণ সে জানে, এটুকু খেয়েও না খেলে মরতে হবে।
রাতে রাকিব রাস্তায় বসে। দূরে এক গরিব বস্তিতে আগুন লেগে গেছে। মানুষ চিৎকার করছে। শহর উদাসীন। রাকিব ফিসফিস করে বলে, “আল্লাহ, তোমার নামে পশু জবাই হলো। আমাদের পেট জবাই হলো কবে?”
রাকিবদের মতো হাজারো শিশু প্রতিটি কুরবানির ঈদে একটুকরো মাংসের জন্য অপেক্ষা করে। কারও দান নয়, তাদের চাওয়া ছিল সামান্য সহানুভূতি।
কুরবানি মানে শুধুই পশু জবাই নয়। নিজের ভেতরের অহংকার, গর্ব, অবহেলা, রুক্ষতা—এসব জবাই করাই মূল শিক্ষা।
কিন্তু আমরা কি তা পারি?
