ইউনুস মোহাম্মদ
রুবেল দুই হাজার সালে প্রথম বিদেশে গিয়েছিল।তখন সে বিয়ে করে নাই।বিদেশে গিয়ে বাড়িতে ঘরবাড়ি তুলে পাকা পোস্তাই করে।তখন সে অনেক টাকা কামাই করতো।ফলে অল্প দিনেই বাড়ির অবস্থা পাল্টে যায়।বাড়িতে জোড়া চার চালার নতুন ঘর উঠে।কিছু দিনের ব্যবধানে আরো দুই ভাইকে বিদেশে নেয় রুবেল।তারা গিয়ে রুবেলের মতোই টাকা কামাই করে।এখনকার মতো তখন সৌদি আরবে এতো মানুষের সমাগম ছিলো না।মানুষ কম ছিলো।তাই তাদের কদর ছিলো।সারা বছর ধরে কাজ করেও কাজ শেষ করতে পারতো না।নিজেদের ওয়ার্কশপ ছিলো।তিন ভাই কাজ রেখে একত্রে কাজ করতো।
এভাবেই সময় যাচ্ছিলো।একদিন একটা ভয়ংকর দূর্ঘটনা ঘটে।রুবেল এক্সিডেন্ট করে সেখানে।কাজ করার সময় উপর থেকে পড়ে যায়।নিচে থাকা একটা খাড়া রড রুবেলের কপাল ভেদ করে মাথার সামনে দিয়ে বেড়িয়ে যায়।মারা যাবার মতো অবস্থা হয়েছিলো।এক সপ্তাহের মধ্যে কারো সাথে কথা বলতে পারেনি।বাড়িতেও তার সাথে কারো কথা হয়নি।বাড়ির সবাই ধরে নিয়েছিলো রুবেল মারা গেছে।কিন্তু বাড়ির মানুষকে সেই দুঃসংবাদটা দিতে চাইছে না কেউ।তার বাবা জয়নাল খুবই ভেঙে পড়েছিলো।কতো যে আল্লাহর কাছে কান্নাকাটি করেছে তার কোনো হিসেব নেই।নাওয়া খাওয়ার কথা ভুলে গিয়েছিলো।রুবেল বাড়ির বড় ছেলে।সংসারেরও প্রথম সন্তান।তার প্রতি মায়াটা বেশিই ছিলো।বিশেষ করে জয়নাল।জয়নাল শুধু বলতো,আল্লাহ তুই আমার বাজানরে ফিরাইয়া আইনা দে।এই কথা বলতো আর কাঁদতো।কিন্তু রুবেলের মাকে তেমন করতে দেখা যায় নাই।তার ভেতরটা বড় শক্ত ছিলো।এলাকার সবাই জানে সেই কথা।
রুবেলের বাঁচার কোনো কথাই ছিলো না।কিন্তু আল্লাহ হয়তো রুবেলের বাবার দোয়া কবুল করেছিলো।দুই মাস চিকিৎসার পর রুবেল ভালো হলো।তারপর সে বাড়ি এলো।রুবেল কিছুটা মানুষিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ে।ব্রেনে আঘাত লেগেছিলো।সেই জন্যই এই মানুষিক ভারসাম্যহীনতা।বাড়ি আসার দুই তিন মাস পর যখন সে নিজে নিজেই চলাফেরা করতে পারলো তখন দেখা গেল সে ছোট ছেলে পেলেদের সাথে হাসি ঠাট্টা করে।তাদের সাথে মেশে।যেটা আগে তাকে করতে দেখা যায় নাই।এবং যেটা তার জন্য বেমানান।কপালের যেখানটায় রড ঢুকে গিয়েছিল সেখানে চোখে পড়ার মতো একটা চিহ্ন তৈরী হয়েছে।দেবে আছে জায়গাটা।দূর থেকে সেটা বোঝা যায়।
ছয় মাস পর রুবেলকে বিয়ে দেয়া হলো।বউ সুন্দুর।তবে শরীরে হ্যাংলা।তেমন হাসিখুশি না।রুবেলের হাতে টাকা নেই।সংসার চালানো দরকার।এদিকে রুবেল মানুষিক ভারসাম্যহীন।দেরিতে হলেও বউ বিষয়টি জেনে যায়।এটা নিয়ে বউয়ের মন খারাপ থাকে।বাড়িতে অশান্তি।ছয় মাস পর ভাইদের সহযোগীতায় রুবেল আবার বিদেশে গেল।কিন্তু সেখানে গিয়ে কাজ করতে পারে না।পাগলামি করে।অগ্যতা আবার সে দেশে ফিরে এলো।
এরপর বারো বছর কেটে গেছে।
বাড়ির ভেতর এখন রুবেলের অবস্থাই সবচেয়ে খারাপ।অন্য দুই ভাই কোটি টাকার সম্পত্তি করেছে।মেঝোটা কয়েক স্থানে জায়গা রেখেছে।সেসব জাগার দাম কোটি টাকা।রুবেলের আয়ের ভালো কোনো পথ নেই।এখন সে একটা গ্রীল ওয়ার্কশপে মাসে পনেরো হাজার টাকা বেতনে কাজ করে।তার এক মেয়ে সেয়ানা।ছেলে আছে একটা।ছেলের বয়স দশ বছর।কোনো রকমে খেয়ে পরে বেঁচে আছে সে।
এই বছর কোরবানিতে মেঝোটা এক লক্ষ ষাট হাজার টাকা দামের গরু কিনেছে।কোরবানি দিবে সে।রুবেল জানেই না তার ভাই কোরবানির গরু কিনেছে।আজ সে সেই কথা বললো আক্ষেপের সাথে।বললো,আমার ভাই কোবানি দিবো আমি জানি না।গরু কিনলো তাও কইলো না কিছু।গরু দেখবারও যাইতে কইলো না।গরীব অইলে মায়ের পেটের ভাইও অবহেলা করে।জানে আমার কিছু নাই।
রুবেল এই কথা বলছিলো এক দোকানের সামনে বসে।দোকান বাড়ির কাছেই।আজ সে কাজে যায় নাই।কোরবানির ইদ উপলক্ষে কাজ বন্ধ।রুবেলের হাতে একটা কাচি।কাচিটা হাতে নিয়ে সে উঠে গেল।
বাড়ির সামনে বাহির বাড়িতে জুবেলের গরু বাঁধা।বেশ আটোসাটো লাল রংয়ের গরু।চোখের চারদিকে কালো।যেন কালো চশমা পরে আছে।দুই দিন পর কোরবানি।গরু গোসল করিয়ে এনে বাহির বাড়িতে বেঁধেছে জুবেল।গরু কিনতে জয়নাল সাথে গিয়েছিল।জয়নাল এখন জুবেলের পক্ষে।জুবেল যদি একটা অন্যায়ও বলে তার বাপ জয়নাল সেটাই মেনে নেয়।রুবেল এর জন্য জুবেলের টাকাকে দায়ী করে।আজও সে সেই কথাই বললো।বললো,যার ট্যাকা আছে বাপ মায় তার কথাই কয়।
এছাড়া জুবেলের সাথে রুবেলের মিলমিশ নেই।অনেক দিন ধরে রুবেলের ঘর ঘিরে রেখে উঁচু করে ইট পালা দিয়ে রেখেছে জুবেল।সরাতে বললে সরায় না।ইটের স্তুপের জন্য একটু বাতাস ঢোকে না তার ঘরে।এটা সেটা নিয়ে দুই ভাইয়ের মধ্যে সম্পর্ক ভালো নেই।
রুবেলের বউ,র সাথেও কোনো জায়ের সাথে সম্পর্ক ভালো নেই।তারা ছাড়া সবাই খেয়েদেয়ে ভালো।
রুবেল বাহির বাড়িতে এসে গরুটা দেখল।গরুর দিকে এক নজর তাকালো।লাল গরু।আগেও একবার দেখেছে।বাহির বাড়িতে একটা পাকা ব্যাঞ্চ।বেঞ্চে জুবেল বসে আছে।সাথে তার ছেলে।রুবেল কাচি হাতে নিয়ে বাড়ির ভেতরে চলে গেল।
প্রতি বছর রুবেলের শ্বশুর বাড়ি কোরবানি দেয়।এবছর তারা কোরবানি দিবে না।রুবেলের শ্যালক বিদেশে যাচ্ছে। ভিসা ধরেছে তার জন্য।এবার তারা কিছু টাকা ঋণ।ঋণ থাকলে কোরবানি হয় না।
রুবেল বাড়ির ভেতর যাওয়ার পর রুবেলের ছেলেটা জিজ্ঞেস করলো,আব্বা কাকাগো গরু কয় আজার ট্যাকা অইছে?
রুবেল উত্তর দিলো,যা অইবার অইছে আব্বা।আমাগো ওইডা জানুন লাগবো না।
গরুডা অনেক সুন্দর আব্বা।তুমি দেখচাও?
দেখছি।
ইট পালা দিয়ে বাড়ির সামনের দিকটা ঘিরে রেখেছে জুবেল।রুবেলের বউ এই কথা বলতে, বলতে হয়রান।তবু ইট সরায় না।সামান্য বাতাস ঢোকে না ঘরে।রুবেলের বউ এখনও সেই কথা বললো।ইট সরাইয়া দেয় না ক্যাঁ?
রুবেল বললো,কইলাম কতোবার।কয় সরামু।
রুবেল যখন সবার সাথে একসাথে ছিলো জুবেল তখন জায়গা রেখেছিলো।এখানে রুবেলেরও টাকা ছিলো।সেই জায়গা এখন সে পুরোটাই নিজের বলে দাবী করে।বলে তর ট্যাকায় জায়গা রাহি নাই।আমার ট্যাকা দিয়া রাখছি।রুবেলের বাপও এই কথা মেনে নেয়।রুবেল এই কথা কারো কাছে প্রকাশ করে না।নিজের বাপ ভাই যদি নিজের সাথে অন্যায় করে তাহলে এই বিচার কারো কাছে দেয়া যায় না।কেউ আমলেও নেয় না।রুবেলের বেলায়ও তাই হয়েছে।
কোরবানির দিন গরু কাটার সময় এই বাড়ির সব পোলাপানকে দেখা গেল।কিন্তু রুবেলের ছেলেকে দেখা গেল না।সমাজের মুন্সি এসে পাঁচ ছয়জনে চেপে ধরা গরুর গলায় ধারালো ছুরি চালিয়ে দিলো।ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটে গেল অনেক দূর।তাই দেখে বাড়ির ছোট পোলাপান আনন্দে হাত তালি দিয়ে উঠলো।মুন্সি আজ খুব ব্যস্ত।বড় একটা ছুরি নিয়ে বাড়ি বাড়ি দৌড়াদৌড়ি করছে।তার দুই হাত রক্তে ভেজা।সাদা পাঞ্জাবিতে রক্তের দাগ।
রুবেলের বউ ছেলেকে আসতে দেয় নাই জুবেলের গরুর কাছে।যাদের সাথে মিলমিল নেই তাদের কাছে কেন ভীড়বে ছেলে?
ছেলেটা ঘরের ভেতর বসে,বসে মোবাইল দেখে।বাহির বাড়িতে মাংস বানানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে।দুই চারজন আত্মীয় স্বজন আর জুবেলের দুই শালা সুমুন্দি এসেছে মাংস বানাতে।রুবেলকে আজও কিছু বলা হয় নাই।সে অবশ্য আরেক আত্মীয় বাড়ি গেছে মাংস বানাতে।আজ বাড়ির মহিলাদের বড় ব্যস্ততা।তারা আছে গরুর ভূরি নিয়ে।
রুবেলের বউ ছাড়া এই বাড়ির সব জায়েরা ভূড়ি পরিষ্কার করায় ব্যস্ত।
তখন বিকেল বেলা।রুবেলের বউ চুলায় মাংস রান্না করছে।টগবগ করে চুলায় গরুর মাংস ফুটছে।এমন সময় রুবেলের মা বোলে করে মাংস নিয়ে এলো।জুবেলের গরুর মাংস।সবাইকে মাংস দিয়েছে সময়মতো।কিন্তু তাকে মাংস দেবার কথা মনে নেই।
বোলের ভেতর দুই কেজি পরিমাণ মাংস হবে।কোরবানির মাংস বিলি করা হয়ে গেছে আরো এক দেড় ঘন্টা আগে।অন্যান্য ঘরে মাংস রান্না করে খাওয়াও হয়ে গেছে।রুবেলের মা মাংস নিয়ে এসে সেই কথাই বললো।বললো যে তোমাগো নাম লিস্ট করছে।কিন্তু দিবার মনে নাই।
রুবেল ঘর থেকে বেড়িয়ে এসে বললো,আমাগো মাংস লাগবো না।মাংস পাইছি আমরা।নিয়া যাও।
রুবেলের মুখটা কঠিন।তার ভেতরটা রাগে ফেটে যাচ্ছে।সুতরাং কথার ভেতরেও সেই কাঠিন্যতা বেড়িয়ে এলো।
সে মাংস রাখবে না বলে দিলো।
কিন্তু মা মাংস রাখার জন্য বারংবার বলতে লাগলো।
রুবেল এবার তার ভেতরে জমে থাকা কথা বলতে লাগলো। কার মাংস রাহুম।আমি কি ওর ভাইনি?ভাই যদি অইতাম তাইলে সবকিছু জানতাম।ও গরু কিনে আমি জানি না।ও বাইরের মানুষরে গরু বানাইবার কয়,আমারে কয় না।আমি এই বাড়ির জইন্য কিছু করি নাই।ওরে বিদেশে নেই নাই।আইজ ও আমারে চিনে না।তোমরাও আমারে অবহেলা করো।অন্য পোলাগো টেকা আছে তাগো কথা কও।আমার টেকা নাই।আমার কেউ নাই।
অনেক কথা বলার পরও রুবেল মাংসটা না রেখে পারলো না।একেতো কোরবানির মাংস তার ওপর তার মা নিয়ে এসেছে।না রাখলে মা অপমান হয়।তাই তাকে মাংসটা রাখতে হলো।
