কেউ কথা রাখেনি 

0
125

মায়িশা আবসারী আদীবা 

আজকাল লেখালেখি একপ্রকার ছেড়েই দিয়েছি। তবু মাঝে মাঝে যখন খাতাকলম নিয়ে বসি‌ , খাতায় ফুটে উঠে নর-নারীর জটিল মনস্তাত্ত্বিক কোনো মাথা ধরা গল্প। বকুলফুল, রুপে ও ঘ্রাণে মুগ্ধ করে চারিদিক। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে সে যখন শুকনো-নিষ্প্রাণ হয়ে পড়ে তখন কেউ ফুলের অতীত স্মৃতি রোমন্থন করে না, তেমনি আমিও শৈশবের স্মৃতিকাব্য খুলে দেখিনি বহুদিন ‌। আজ না হয় সেই কাব্যগ্রন্থ থেকেই কিছুটা আবৃত্তি শোনাই।
শ্রীকান্তের যেমন ইন্দ্রনাথ ছিল, আমার ছিল দিশা। উচ্চতায় এবং জীবনের দৈর্ঘ্যে সে আমার চেয়ে কিছুটা বড় , কাজেই দিশা আপু। একদিন সে আমায় বলল, ” এই আদীবা, ঘুরতে যাবি?”
“কোথায়?”
” গেলেই দেখবি”
আমি সভয়ে উত্তর দিলাম,”বেশি দূরে গেলে মা বকবে”
“আরে দূর কি বলছিস। ঐতো ১০ মিনিটের পথ।”
আমরা হাঁটতে শুরু করলাম এবং উপলব্ধি করলাম আমি যদি ২০ ফুট উচ্চতার কোনো দানব হতাম, তবে দিশাআপুর আশ্বাসের সত্যতা হয়তো থাকতো। কিন্তু ৬ বছরের ছোট্ট পা দুটোর ,গন্তব্যে পৌঁছতে সময় লাগলো প্রায় ঘন্টা খানেক ‌। অবশ্য পথের মাঝে আমাদের থামতে হলো বেশ কয়েকবার।তাড়াতাড়ি যাবার জন্য আমরা যাচ্ছিলাম জঙ্গলের পথ ধরে। একটা কদম গাছ পড়লো পথিমধ্যে । কে না জানে রান্নাবাটি খেলার সময় কদম ফুল কত কাজে আসে। কদমের হলুদ পাপড়ি দিয়ে খিচুড়ি, সাদা অংশ দিয়ে তৈরি হয় সেমাই আর ভেতরের গোল অংশটা দিয়ে কখনো লাড্ডু কখনো আবার ওটাকে ছোট কেটে নিরামিষ পদ তৈরি করা হয়। কাজেই দিশা আপু আর আমি ৩-৪ টা কদম তুলে নিলাম। খানিক বাদেই আকাশ ঘন করে বৃষ্টি নামলো । উঁচু নিচু লাল মাটির অতি পরিচিত পথটা ক্রমেই ভিন্ন রূপে ধরা দিল। এত এত নাম না জানা গাছের ফাঁক দিয়ে বৃষ্টি পড়ছে আমাদের গায়ে। এরকম অভিজ্ঞতা যাদের নেই, তাদের আমি কেমন করে বোঝাই কি চমৎকার সেই অনুভূতি।

আরো মিনিট দশেক হাঁটার পর পৌঁছলাম গন্তব্যে ‌। জঙ্গলের শেষ মাথায় একটা ছোট্ট বিল। আমার মনে হলো মায়ের বকার আশংকা মাথায় নিয়ে এখানে আসাটাই কেবল স্বার্থক নয় , বরং আমার গোটা জীবনটাই স্বার্থক। দিশা আপুর মামার একটা নৌকা আছে। উনি কথা দিয়েছেন দিশা আপুকে,এই বিলটা ঘুরে দেখাবেন।
” এই দিশা, ঐ পুঁচকেটা কে রে?” নৌকা থেকে ১২-১৩ বছরের একটা মেয়ে আমায় দেখিয়ে জিজ্ঞেস করল।
“আমাদের ওখানেই থাকে, বিল দেখতে এসেছে”।
” ওকে আনতে গেল কেন, আব্বার ছোট নৌকায় এতজনের জায়গা হবে?”
” এটুকু মেয়ে কত আর জায়গা নেবে। যাক না আমাদের সাথে।”
” অপু ও তো যাবে ।ওকে তুই বরং দিয়ে আয়। আব্বা তো গুড়- মুড়ি আনতে বাড়ি গেছে। তুই ততক্ষণে ওকে জঙ্গলটা পার করে দে। কিরে বাকিটা চিনে যেতে পারবি না?”
আমি কিছু বলতে পারলাম না। আহত চোখে দিশা আপুর দিকে তাকাল। দিশা আপু বলল,” থাক আমিও বরং যাই‌ । আসার পথে দেখলাম তান্নিদের বাড়ির পেছনে লজ্জাবতী ফুল হয়েছে ‌। এবেলা তুলে না আনলে, তুষার সব নিয়ে যাবে।”
কৃতজ্ঞতায় আমার চোখে জল এলো।ফিরে এলাম দিশা আপুর হাত ধরে। ততক্ষণে বৃষ্টি থেমে গেছে। ঘরে ফেরার পর মা সজোরে গালে চড় কষালেন। তারপর দীর্ঘক্ষণ জেরা আর মার খাওয়ার পর্ব শেষ হলে ব্যথায় এবং ঘোরাঘুরির ক্লান্তিতে আমি ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুমের ঘোরে শুনি জানালা দিয়ে কেউ একজন ফিসফিস করে বলছে,”খুব লেগেছে নারে, কদম ফুলগুলো ছাড়িয়ে রেখেছি।বিকেলে খেলব,খুব মজা
হবে।”

লিখুন প্রতিধ্বনিতেলিখুন প্রতিধ্বনিতে

কখনো আবার স্বেচ্ছায় বাহিরে যাওয়া বন্ধ হতো।ইমন ভাইয়া বলতো,” এই আদীবা ,তোমার মাকে বলো না চড়ুইভাতির কথা । সবজির জোগাড় হয়ে গেছে, শুধু ডিমটা যদি…। ” তখন আগামী এক মাস বাহিরে যাবো না এই শর্তে বাড়ি থেকে ডিম আনতে হতো।
আষাঢ়ের দিনে কিন্তু সব বন্ধ। তখন সারাদিন অপেক্ষা করতাম বাবা কখন বাড়ি ফিরবে । তার সদ্য কেনা মোবাইল ফোনে হঠাৎ বেজে উঠতো সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের,” কেউ কথা রাখেনি।”
বাবা কল রিসিভ করে কথা বলতে বাইরে চলে যেতেন। আমার মাথায় তখন কিন্তু অন্য এক চিন্তা । সবে মাত্র ছয়, কর গুনে দেখতাম তেত্রিশ হতে আরো সাতাশ বছর বাকি। কি সর্বনাশ! এতগুলো বছর অপেক্ষা করতে হবে?

পৃথিবীর সবকিছুরই পরিসমাপ্তি ঘটে। সেই ছোট্ট মেয়েটির অপেক্ষার ও পরিসমাপ্তি ঘটেছে । আজ আমি তেত্রিশে পা দিলাম ।ছোটবেলার সেই ইচ্ছেটা যায়নি আজো। এখনো মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে গলা ছেড়ে চিৎকার করে বলি “কেউ কথা রাখেনি, তেত্রিশ বছর কাটলো কেউ কথা রাখেনি।”

Previous articleগল্পের প্রতিধ্বনি ২.০ || গল্প লেখা প্রতিযোগিতা
Next articleবড় ভাই বড় নাই
প্রতিধ্বনি
প্রতিধ্বনি একটি অনলাইন ম্যাগাজিন। শিল্প,সাহিত্য,রাজনীতি,অর্থনীতি,ইতিহাস ঐতিহ্য সহ নানা বিষয়ে বিভিন্ন প্রজন্ম কী ভাবছে তা এখানে প্রকাশ করা হয়। নবীন প্রবীণ লেখকদের কাছে প্রতিধ্বনি একটি দারুণ প্ল্যাটফর্ম রুপে আবির্ভূত হয়েছে। সব বয়সী লেখক ও পাঠকদের জন্য নানা ভাবে প্রতিধ্বনি প্রতিনিয়ত কাজ করে চলেছে। অনেক প্রতিভাবান লেখক আড়ালেই থেকে যায় তাদের লেখা প্রকাশের প্ল্যাটফর্মের অভাবে। আমরা সেই সব প্রতিভাবান লেখকদের লেখা সবার সামনে তুলে ধরতে চাই। আমরা চাই ন্যায়সঙ্গত প্রতিটি বিষয় দ্বিধাহীনচিত্ত্বে তুলে ধরতে। আপনিও যদি একজন সাহসী কলম সৈনিক হয়ে থাকেন তবে আপনাকে স্বাগতম। প্রতিধ্বনিতে যুক্ত হয়ে আওয়াজ তুলুন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here