মুহাম্মদ মুহিউদ্দীন ইবনে মোস্তাফিজ
শৈশবের স্মৃতি বড়ই অদ্ভুত। কিছু স্মৃতি এমনভাবে হৃদয়ে গেঁথে যায়, যা কখনো ধূসর
হয় না। সময়ের স্রোত যতই আমাদের নিয়ে যাক ভবিষ্যতের দিকে, এই স্মৃতিগুলো
যেন পেছনে টেনে ধরে রাখে। আমার শৈশব, মা-বাবার ভালোবাসা, তাদের কঠোরতা
আর স্নেহের অপূর্ব মিশেল সবকিছু মিলিয়ে এক অমূল্য সম্পদ। সেই স্মৃতির পাতায়
আজও জ্বলজ্বল করে একটি ঘটনা, দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্র ছিলাম তখন।
সেদিন স্কুল থেকে ফিরেই মাঠে খেলতে চলে গিয়েছিলাম। খেলার মধ্যে হঠাৎ করে
বলটি মাঠের পাশের একটি ডোবায় পড়ে যায়। আমি ছুটে গেলাম বল তুলতে। কিন্তু
ডোবাটি তেমন একটা পরিষ্কার ছিল না। পানির নিচে লুকিয়ে থাকা একটি ভাঙা টিউব
লাইটে পা কেটে যায়। তখন বুঝতেই পারিনি যে পা কেটেছে। কেবল একটা ঝাঁঝালো
জ্বালা অনুভব করছিলাম। এরপর দেখি পানিটা লাল হয়ে যাচ্ছে। আমি তো দারুণ মজা
পেলাম ভাবলাম, আমার পায়ের জাদুতে পানি লাল হয়ে যাচ্ছে!
তবে সেই জাদু বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। জ্বালা তীব্র হয়ে উঠলো, এবং হাঁটতে কষ্ট
হচ্ছিল। কিন্তু মায়ের কথা মনে পড়তেই সাহস করে কিছুই বললাম না। ভাবলাম, যদি
বলে দিই, তাহলে সেই পরিচিত বাঁশের লাঠির আশীর্বাদ আবার পিঠে পড়বে! ঘরে
ফিরে চুপচাপ এক কোণে বসে রইলাম। কিন্তু পা থেকে রক্ত পড়ে ঘরের মেঝেতে ছোট
ছোট লাল ফোঁটা তৈরি করছিল। মা সেই ফোঁটা দেখে আঁতকে উঠলেন।
এই রক্ত! কার রক্ত?
আমার চোখে-মুখে ভয়ের ছাপ স্পষ্ট। মা কাছে এসে দেখলেন, আমার ডান পা রক্তে
ভেসে যাচ্ছে। তারপর খুব কোমল গলায় জিজ্ঞেস করলেন, কী হইছে? আমি তখন
মাথা নিচু করে বললাম, ডোবার পাশে খেলতে গিয়ে পা কেটেছে।
মা আর কিছু বললেন না। সঙ্গে সঙ্গে আমাকে কোলে তুলে নিয়ে ফার্মেসির দিকে
ছুটলেন। যাওয়ার পথেই বাবার দোকান পড়ে। সেখান থেকে টাকা নিয়ে ডাক্তার
দেখাতে নিয়ে গেলেন। ডাক্তার ওষুধ দিলেন, ব্যান্ডেজ করলেন। ফিরতে ফিরতে
সন্ধ্যা। তখন মা বাবাকে বললেন, ছেলের পা কেটেছে টিউব লাইটে। ডাক্তারের কাছ
থেকে এসেছি।
বাবা প্রথমে খুব চিন্তিত হয়ে পড়লেন, তারপর বললেন, এই জন্য বলেছিলাম মাঠে
গিয়ে খেলিস না। তোর পা থাকলে খেলবি, না থাকলে পড়ে থাকবি ঘরে!
তারপর সন্ধ্যার পর সেই চেনা দৃশ্য! বাঁশের লাঠি তুলে নিয়ে বললেন, কেন টিউব
লাইটে পা কাটলি বল!
আমার চোখে পানি, কিন্তু তখনও বুঝি না এই কঠোরতা ভালোবাসারই রূপান্তর।
অন্য আরেকটা ঘটনা ছিল আরও ভয়ানক। তখন হয়তো তিন কি চার বছর বয়স।
বিকেলবেলা মা সুই-সুতা দিয়ে গাতা সেলাই করছিলেন। আমি মায়ের পাশে বসে
পড়াশোনা করার ভান করছিলাম। আসলে তো দুষ্টামিই করছিলাম। পাশে রাখা ছিল
একটি লম্বা বাঁশের লাঠি, মা মাঝে মাঝে যেটা ব্যবহার করতেন শাসনের জন্য।
দুষ্টামি করতে করতে এক সময় সেই লাঠি মুখে ঢুকিয়ে দিলাম। কৌতূহল বশত!
হঠাৎ লাঠিটা গলার মধ্যে আটকে গেল। মা বিস্ময়ে আর আতঙ্কে চিৎকার করে
উঠলেন। চোখের সামনে দৃশ্যটা ঝাপসা হয়ে গেল। সেই মুহূর্তে মা জ্ঞান হারালেন।
আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। পরে শুনেছি, মা আমাকে কোলে নিয়ে ছুটে যান
প্রতিবেশীর ঘরে। সেখান থেকে স্থানীয় ডাক্তার ডেকে আনেন। আমার গলা থেকে
লাঠির টুকরো বের করতে অনেক কষ্ট হয়েছে। আজও সেই স্মৃতি মা যখন বলেন,
চোখে জল চলে আসে।
আমার মা ছিলেন আমার জীবনের প্রথম শিক্ষক। তার হাত ধরেই আমার পড়াশোনার
শুরু। মা বেশি পড়শোনা করেনি। যতটুকু করেছে তা দিয়ে আমাদের ভাইদের শিক্ষা
দিয়েছে। তার অল্প শিক্ষা কিন্তু তার শেখানো আদব, আক্বিদা, নামাজের সঠিক
রীতি আজও আমার জীবনে পথ দেখায়। তিনি নিজের সামান্য জ্ঞানের সবটুকু আমার
মাঝে ঢেলে দিয়েছেন। ঘুম থেকে উঠা থেকে শুরু করে রাতে ঘুমানো পর্যন্ত প্রতিটি
কাজেই মায়ের স্নেহ মিশে থাকতো।
স্কুলের হোমওয়ার্ক, পাঠ্য বই পড়ানো, এমনকি পরীক্ষার আগে আমাকে মুখস্থ
করিয়ে দেওয়া সবকিছুই মা করতেন নিষ্ঠার সঙ্গে। বাবাও অবদান রেখেছেন। তিনি
রোজ সকালে দোকানে যাওয়ার আগে আমার খোঁজ নিতেন। কী পড়ছি, কোন বই লাগবে,
পেন্সিল ফুরিয়ে গেছে কি না সব জানতে চাইতেন। দোকানে কাজের ফাঁকেও আমার
জন্য কিছু না কিছু কিনে আনতেন। একবার আমাকে একটা ছোট টিনের বাস্কেট কিনে
দিলেন, বললেন, এটা তোর বই রাখার জন্য।
আমার জীবনের সবচেয়ে বড় অবদান হল যে আমি আজ একজন আলেম হতে পেরেছি।
তার পেছনে সবচেয়ে বেশি অবদান আমার মায়ের। তিনি কখনো হাল ছাড়েননি। যখন
আমি ক্লান্ত হয়ে পড়তাম, মা বলতেন, তুমি আলেম হবে, মানুষের জন্য আলোর পথ
দেখাবে। বাবাও সমর্থন দিয়েছেন, কিন্তু মায়ের আবেগ ছিল আরও গভীর। মা
বলতেন, আমার বুকের দুধ যেন বৃথা না যায়, আমি চাই তুমি দ্বীন শিখো, মানুষের হক
বোঝো।
মায়ের সেই দোয়া আজও আমাকে রক্ষা করে। বহুবার পড়াশোনায় ব্যর্থ হয়ে হতাশ
হয়ে পড়েছি। কিন্তু মা পাশে ছিলেন, বলতেন, হতাশ হলে চলবে না। তুমি তো আমার
স্বপ্ন।
বাবা ছিলেন নীরব ত্যাগের প্রতিচ্ছবি। মা যেমন সামনে থেকে ভালোবাসা ঢেলে
দিতেন, বাবা তেমনি পেছন থেকে ছায়ার মতো আগলে রাখতেন। ঠাণ্ডা মাথার মানুষ,
কঠোর হলেও ভিতরে ছিলেন নরম। পরিবারের জন্য দিনের পর দিন দোকানে বসে
কাটিয়েছেন। নিজের কোনো বিলাসিতা ছিল না, কিন্তু আমাদের চাহিদা পূরণে কোনো
ত্রুটি রাখেননি। আমি যখন জামা চাইতাম, বাবা বলতেন, ভালই তো আছে পুরানটা।
তারপরও ঈদের দিনে আমার হাতে নতুন জামা তুলে দিতেন।
মা-বাবার এই ভালোবাসা, এই নিঃস্বার্থ ত্যাগ, এই সীমাহীন মমতা আমাদের
জীবনের মূল ভিত্তি। তারা কখনো চাই না সন্তানেরা তাদের ফিরিয়ে দিক কিছু, তারা
শুধু চায় সন্তানের সাফল্য, নিরাপত্তা আর শান্তি। অথচ আমরা বুঝি না। যখন তারা
ক্লান্ত হয়ে পড়েন, বার্ধক্য এসে যায়, তখন আমরা তাদের বোঝা ভাবি। শৈশবের
সেই রাতগুলো, যখন মা নিদ্রাহীন চোখে আমার কপালে হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়িয়েছেন,
সেই কষ্ট কি আমরা ফিরিয়ে দিতে পারি?
আজ আমি যখন বড় হয়েছি, সমাজে কিছুটা অবস্থান তৈরি হয়েছে, তখন বুঝি মা-
বাবার অবদান কতটা গভীর। তারা আমার জন্য কেঁদেছে, হাসেছে, না খেয়ে থেকেছে,
নির্ঘুম রাত কাটিয়েছে। তাদের ভালোবাসা ছিল নিখুঁত, নিষ্পাপ। শৈশবের সেই পায়ে
কাটার ক্ষত কিংবা গলায় লাঠি আটকে যাওয়া ঘটনাগুলো নিছক দুর্ঘটনা নয় সেগুলো
মা-বাবার ভালোবাসার উত্তম সাক্ষী।
আজ যখন মায়ের চোখে চশমা দেখি, বাবার মুখে দাড়ির মধ্যে সাদা চুল দেখি, মনে হয়
এই মানুষগুলোই তো একদিন আমাকে কাঁধে নিয়ে খেলিয়েছেন, পথ দেখিয়েছেন, স্নেহে
বেঁধে রেখেছেন। এখন সময় এসেছে তাদের ভালোবাসা ফিরিয়ে দেওয়ার।
মা-বাবা শুধু জন্ম দেন না, তারা জীবন গড়ে দেন। সন্তানের প্রতিটি শ্বাসে তাদের
দোয়া জড়িয়ে থাকে। তাদের অবদান কোনো ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। সেই ছোট্ট
শিশু যে একদিন মাঠে দৌড়ে বেড়াত, যার পা কেটে গেলে মা ছুটে যেত ডাক্তার খুঁজতে,
সেই শিশুই আজ নিজের সন্তানকে বুকে জড়িয়ে ভাবে, আমার মা-বাবাও কি এমন
ভালোবাসতেন আমাকে?
হ্যাঁ, তারা ভালোবাসতেন। তারা নিঃস্বার্থভাবে সবটুকু উজার করে দিতেন। তাদের
ভালোবাসা কোনো প্রতিদান চায় না, শুধু চায় সন্তানের সাফল্য ও সম্মান। মা-বাবার
ভালোবাসা একটি পবিত্র ছায়া, যে ছায়া না থাকলে কোনো সন্তান আলোর মুখ দেখে
না।
তাদের জন্য প্রতিটি সন্তানের কর্তব্য সেই ভালোবাসাকে মর্যাদা দেওয়া, তাদের
প্রতি কৃতজ্ঞ থাকা এবং যতদিন তারা আছেন, যত্নে, সম্মানে ও ভালোবাসায়
তাদের ঘিরে রাখা।
আমার শৈশবের রক্তের দাগ ও ভালোবাসার ছায়া আজও হৃদয়ে গেঁথে আছে। এই
স্মৃতি, এই ভালোবাসা আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সম্পদ।
