মোঃ আহসান হাবীব মুন্না
রাত তখন প্রায় ২টা। ঘরের ঘড়ির কাঁটা যেন কানে বিঁধছে—টিক… টিক… টিক… একঘেয়ে সেই শব্দ কেমন জানি অস্থিরতা বাড়িয়ে দিচ্ছে রুদ্রর মধ্যে। মনের মধ্যে এক অদ্ভুত অস্থিরতা, যেন চারপাশে কেউ আছে। অথচ স্পষ্টভাবে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। ঘরের আলো নিভে আছে, শুধুমাত্র জানালা দিয়ে আসা স্ট্রিট লাইটের হালকা আলোয় ছায়া আর আলো মিশে একটা অদ্ভুত পরিবেশ তৈরি করেছে।
রুদ্রর ঘুম আসছে না। বিছানায় গড়াগড়ি করতে করতে হঠাৎই তার মনে হলো—ঘরের দরজাটা একটু খোলা। ঠিকভাবে লাগানো হয়নি? কিন্তু সে তো নিশ্চিত ছিল, ঘুমোতে যাওয়ার আগে সব বন্ধ করেই শুয়েছিল।
সে ধীরে ধীরে উঠে দরজার দিকে গেল। দরজার ওপাশে যেন কেউ দম চেপে দাঁড়িয়ে আছে—এমন অনুভব হচ্ছিল। কিন্তু খুলে দেখল, কেউ নেই। অথচ… ঘরের ভিতর আসার পর, সে পরিষ্কার বুঝতে পারল—কেউ তাকে ফলো করছে। সেই নিঃশব্দ উপস্থিতি… সেই ভারী নিঃশ্বাসের মতো অনুভূতি…
রুদ্রর মাথার মধ্যে তখনই ভেসে উঠল আগের সপ্তাহের সেই ঘটনা। বন্ধুদের সঙ্গে ট্রিপে গিয়ে সে একটা পুরনো পরিত্যক্ত বাড়িতে গিয়েছিল। বাড়িটা ছিল সবার অজানা, শহর থেকে অনেক দূরে। বন্ধুদের বারণ সত্ত্বেও সে একাই ঢুকে গিয়েছিল ভিতরে। আর সেখান থেকেই শুরু হয় অদ্ভুত সব কাণ্ড…
সে বাড়ির দেয়ালে আঁকা ছিল এক আজব চিহ্ন—একটা ঘড়ির মতো, কিন্তু ঘড়ির কাঁটা পিছনের দিকে চলছিল। আর তার নিচে লেখা ছিল, “যে সময়কে উল্টো পথে হাঁটায়, সে নিজের ছায়াকেও হারিয়ে ফেলে।” রুদ্র সেই চিহ্নটায় হাত দিয়েছিল… আর সেদিন রাতেই প্রথম সে দেখেছিল সেই ছায়া মানুষটিকে।
ছায়া নয়, বলা চলে এক ধরনের বিকৃত প্রতিচ্ছবি। ঠিক যেন রুদ্রর মতো দেখতে, কিন্তু চোখদুটো কুয়াশাচ্ছন্ন, ঠোঁটে অদ্ভুত বিকৃত হাসি, আর চলাফেরায় এক ভয়ানক স্থিরতা।
প্রথম দিন সে ভেবেছিল, হয়ত কল্পনা। কিন্তু তারপর থেকে দিনে দিনে সেই প্রতিচ্ছবিটা তার চারপাশে ঘনিয়ে আসছিল। প্রথমে আয়নায়… তারপর কাচে… শেষে খোলা চোখে।
রুদ্র অনেকবার চেষ্টা করেছে সেটা ভুলে যেতে। কাউকে বলতে পারেনি, কারণ সবাই তাকে পাগল ভাবত। এমনকি সে মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছেও গিয়েছিল। কিন্তু তারা বলেছে—”তুমি অনেক মানসিক চাপ নিচ্ছো, বিশ্রাম নাও।”
কিন্তু রুদ্র জানে—এটা কেবল মানসিক ব্যাপার নয়। এটা বাস্তব। প্রতিদিন রাতে, সে অনুভব করে কেউ তার ঘাড়ের কাছে নিঃশ্বাস ফেলছে। আর আজ রাত… সব কিছু যেন চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে।
হঠাৎ করেই ঘড়ির কাঁটা বন্ধ হয়ে যায়। সম্পূর্ণ নিস্তব্ধতা।
আর তখনই… আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা রুদ্র বুঝতে পারে—সে আয়নায় নেই। ওখানে যে দাঁড়িয়ে আছে, সেটা সে নয়।
ছায়া সেই মৃদু বিকৃত হাসি দিয়ে বলে উঠল—
“তুমি সময়কে উল্টে দিয়েছো। এখন তোমার জায়গায় আমিই থাকব।”
রুদ্র চিৎকার করতে চাইল, কিন্তু গলা দিয়ে কোনো শব্দ বের হলো না। শরীর জমে গেল, হাত-পা নড়ছে না। সেই ছায়া ধীরে ধীরে এগিয়ে এলো। এরপর…
…সব অন্ধকার হয়ে গেল।
পরদিন সকালে পুলিশ আসে এক আত্মহত্যার খবরে।
ঘরের মধ্যে ঝুলন্ত দেহ পাওয়া যায় রুদ্রর।
ঘরের আয়নাতে তখনো সেই চিহ্ন আঁকা—
“সময় যে পেছনের দিকে হাঁটে,
সে নিজেকে সামনে খুঁজে পায় না।”
