সে-ও ভালোবাসতে জানে

0
93

কাজী রুফাইদা সাদিকা সুহাহ 

এই যান্ত্রিক শহরে যান্ত্রিক সব মানুষের ভিড়ে আমি বড্ড বেশি বেমানান! যেখানে সময় অপচয় রোধে কাগজ কলম কেউ ছুঁয়েও দেখেনা, সেখানে আমি একটু আধটু সাহিত্যচর্চায় আনন্দ খুঁজে পাই। তবে গত আড়াই বছর ধরে একটা বিষয় আমাকে হঠাৎ হঠাৎ চিন্তিত করে ফেলে। আমার এ জীবনের অজানার প্রতি যতটুকু কৌতুহল রয়েছে তার সবটাই মুনকে ঘিরে।

  • ইরা, একটু আসলাম! দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকলো মুন। আমি আর ও একটা বাসায় একসাথে থাকি। মেয়েটার সব ব্যাপারে অদ্ভুত সৌন্দর্যের বিস্ময় আমাকে ঘোরে ফেলে দেয়…. হঠাৎ রুমে হলোগ্রাফিক স্ক্রিনে মুনের মা ভেসে উঠলেন। মুন ভিডিও কলে কথা বললে সবসময় আমার রুমেই আসে। ভদ্রমহিলার জন্য সবসময় এর মতো এখনো আমার মায়া হতে থাকলো। কেনো জানিনা এই মায়ের এত হাহাকার সত্ত্বেও মুন ওনার সাথে থাকেনা বা দেখা করেনা। এখানেই আমার সবথেকে বেশি কৌতূহল। আজকেও মুনের মা আবেগী ডাক-হাক গুলো শুরু করলেন। ওনার পাগলের মতো কান্না দেখে আজ আমার চোখে পানি আসার উপক্রম! হটাৎ মুন বলে উঠলো, “দেখো, এমন করলে ভিডিও কল দেয়ার কোনো প্রয়োজন নেই, মা…… তোমার ইচ্ছে মতো তোমাকে সঙ্গ দিতে আমি বাধ্য না।” বলেই কলটা কেটে দিয়ে নিজের ঘরে চলে গেল মুন। এমন না যে মুন ক্রোধ বা অভিমান নিয়ে বললো…. আবার এতটুকু কষ্টও হলো না ওর। সেই একই নির্লিপ্ততা হাসি-কান্না-উত্তেজনা সবকিছুতেই! আজকে আমার বিস্ময়ের সীমা পেরিয়ে গেল!……

একজন মা কত মমতায় তার মেয়েকে আহবান করছে, সেই কন্ঠের করুণ আবেদন আমার হৃদয়ে পর্যন্ত পৌঁছে গেল কিন্তু কিছুতেই মুনকে বিচলিত করতে পারলো না! জীবনের সর্বোচ্চ কৌতূহলটা অনুভব করে অস্থির লাগছে। মুনের সামনে গেলে হয়তো ওর স্মার্টফোনের mind reader নামক কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা notification দিবে, “the person in front of you feeling unsteady” নাহ, এভাবে আর হবে না। সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম, মুনের সাথে কথা বলে আজকে আমার কৌতূহল-অবসান করেই ছাড়বো! জানতেই হবে আমাকে_কে মুন?

এখন অনেক রাত। আমি মুনের রুমের দরজা ঠেলে ঢুকে পড়লাম আর বললাম, “মুন, কি করিস? কেমন যেনো আবহাওয়াটা! শোন না, আজ রাতটা তোর সাথেই থাকি কেমন? খুব ভয় করছে….”
“ঢং করিসনা ইরা! অনুভূতির ফাঁকিঝুকি আমার কাছে চলে না! তুই কিছু একটা বলতে এসেছিস_ “curious”-ফোন এ দেখলাম! বলে ফেল বান্ধুবী?”

কোনো ভনিতা করে লাভ হবেনা ভেবে সরাসরি বললাম; “আজকে তোকে কিছু প্রশ্ন করবো সত্যি উত্তর দিবি। Promise কর!” মুনকে আজ প্রথমবার অবাক হতে দেখলাম। আমি বললাম,
“সত্যি করে বল তো মুন? তুই ভালোবাসতে জানিস?” আমার প্রশ্ন শুনে মুন একপ্রকার ছিটকে পরে যাবে অবস্থা… কিছু বলার আগেই আমি-বললাম-“তুই আমার মতোই মানুষ তো? নাকি…..”

“না! উল্টাপাল্টা কিছু ভাববি না। আমি মানুষ; আমি মানুষ!” তবে খুব অস্থির ভাবে কথাগুলো বলে থেমে গেল মুন। “আমি মানুষ ইরা, তবে তোদের মতো না… আর হ্যাঁ, আমি সত্যিই ভালোবাসতে জানিনা ইরা! জানিস অনেক চেষ্টা করেছি আর কাউকে না হোক মাকে মন থেকে একটু ভালোবাসার, ভালোবাসার অভিনয় করতে অনেক ক্লান্ত লাগে রে। আমার মধ্যে স্বাভাবিক মানবিক কিছু অনুভূতি input করা হয়েছিল কিন্তু তার একটা নির্দিষ্ট রেঞ্জ আছে। একটা মানুষ মারা গেলে তোর মতো আমিও দুঃখিত হবো। কিন্তু তোর কাছের মানুষ মারা গেলে তোর যে একটা out of range কষ্ট হবে, সেটা আমার কখনোই হবে না। কারণ ‘কাছের মানুষ’ শব্দটার জন্য লাগে মায়া-মমতা ভালোবাসা_যেগুলো মনে হয় মায়ের পেটে বেড়ে উঠলেই একমাত্র অর্জন করা সম্ভব। বাচ্চার অবচেতনে যে মানুষটা তাকে-কষ্ট করে পেটে ধরে, তার যত্নের প্রেমে পড়া থেকেই বোধয় ভালোবাসা অনুভূতিটার শুরু।” মুনের একটানা নিরব কথাগুলো আমাকে ঠান্ডা করে ফেলেছে; পাল্টা প্রশ্ন করার ক্ষমতা হারিয়ে সবটা শোনার অপেক্ষায় ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছি। মুন চাপা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার বলতে লাগলো, “আমার যদি স্বাভাবিক অনুভূতি থাকতো তাহলে সবথেকে বেশি আমার মায়ের প্রতি ক্রোধ জন্মাতো। আমি যে সামান্য রাগ-অভিমান- করতে পারি, তার দরুণ স্কুল life এই মায়ের থেকে দূরে চলে গিয়েছিলাম। ভেবেছি সারাজীবন দূরে থাকবো! আর আমার বাবা! আমার জীবনের সবথেকে বড় অপরাধী। জানিস? আমি আমাকে একটু একটু করে আবিষ্কার করেছিলাম-যে আমি আলাদা, অনুভূতিহীন আর নিখুঁত। আমি বাসা থেকে বের হয়ে আসার সময় সাথে করে বাবার সব রিসার্চ বুক নিয়ে এসেছিলাম… আর এনেছিলাম আমার মায়ের ১০ মাসব্যাপী লেখা Diary… তার উত্তেজনার শেষ ছিলনা কারণ তার আগত সন্তান হবে পৃথিবীর সেরার সেরা। সে রত্মগর্ভা হিসেবে পাবে পরিচিতি! একটা ভিডিও ক্লিপের চিপ ছিল Diary তে… কিভাবে Labratory-র Baby pod-এ আমি আস্তে আস্তে বেড়ে উঠি তার 360° angle এ ভিডিও! বাবা একজন বেশ প্রসিদ্ধ scientist ছিলেন। তাদের একটা Group-এর রিসার্চ ছিল- “Super intelligence in human”। দুঃখের বিষয় এই যে সেই রিসার্চ এর গিনিপিগ হয়ে উঠলাম আমি। জানিস? ক্রিসপার ক্যাস-9 জিন এডিটিং পদ্ধতিতে জিনের বিন্যাসের অদলবদল করে আমার গায়ের রঙ মাখনের মতো ফর্সা, চোখের লেন্স নীল, অপরূপ চুল-চেহারা, নিখুঁত দাঁত, নখ, ঠোঁট সব মায়ের পছন্দ মতো করে নেওয়া হয়েছিল! ইরা, ইরা, কেউ একবারও কেন ভাবেনি, রক্ত-মাংসের একটা ছোট্ট ঘর আমাকে ‘ভালোবাসা’ দিতে পারতো! কি করবো আমি super intelligence দিয়ে? বোঝার পর থেকে সব পড়া প্রয়োজনের বেশি বুঝে গিয়েও ফাঁকা খাতা জমা দিয়ে ভারসাম্য রক্ষার দায় মিটাচ্ছি রে ইরা! আমাকে কত কষ্ট করে দিনের পর দিন নাটক করে যেতে হয়। কষ্ট অনুভূত হবে না বলে এভাবে এত কষ্ট দিয়ে যাবে প্রকৃতি আমাকে?

ইরা? বাবার রিসার্চ নোটটা এতদিনে আয়ত্ব করে ফেলেছি। আমাকেও তো বিয়ের পর এমন একজন সন্তানকে আনতে হবে, যে বোকার মতো তার যান্ত্রিক মা’কে ভালোবেসে ঠকবেনা!

লিখুন প্রতিধ্বনিতেলিখুন প্রতিধ্বনিতে

এতক্ষণে মুখ খুললাম আমি। হতবাক হয়ে বিস্ফোরিত চোখে মুনের দিকে তাকিয়ে বললাম, “মুন? কি-সব বলছিস তুই?”

আমার চোখের দিকে তাকিয়ে মুন হাত দিয়ে আমার গাল বেয়ে পড়া অশ্রুকণা ধরলো। একটা ক্লান্ত হাসি দিল। ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। এই মৃদু আলোতে অপূর্ব লাগছিল সেই হাসি। হঠাৎ অসহায়ের মতো আমার দিকে তাকিয়ে মুন বললো, “তুই কাঁদছিস ইরা? কেন কাঁদছিস রে? হৃদয় ছুঁয়ে গেছে তাইনা? এই অসহায় super intelligent মেয়েটার হাহাকার তোর হৃদয়ের এত গভীরে পৌঁছেছে?”

আমি আরও জোরে কাঁদতে শুরু করলাম ওর কোমল কন্ঠের হাহাকার শুনে। মনে হচ্ছে এক জীবনে ওর মতো নিরুপায় সব ক্লান্তি এসে ভর করেছে ওর অপূর্ব কন্ঠে। নিরুপায়ের সাহায্য চাওয়ার ভঙ্গিতে দুহাত দিয়ে আমার হাত ধরলো। ধরে নিজের বুকের কাছে হাতটা লাগালো, আমি পাগলের মতো হেঁচকি দিয়ে কান্নাটা হঠাৎই কোনো এক বিস্ময়ে থামিয়ে দিলাম!

মুন আস্তে আস্তে বলতে লাগলো,

“ইরা, দেখ, আমারও একটা হৃদয় আছে। হয়তো গঠনে তোর হৃদয়ের থেকে অনেক নিখুঁত। কিন্তু, দেখ আমার এত হাহাকার আমার হৃদয় ছুঁতে পারছেনা। আমায় একটু শিখাবি? কিভাবে কাঁদতে হয়? কিভাবে কষ্ট পেলে শ্বাস বন্ধ হয়ে আসে বলবি? আমি একটু কাঁদতে চাই ইরা। আমি অন্তত নিজেকে একটু ভালোবাসতে চাই।”

মুন অনবরত এই ধরণের কথা বলেই যাচ্ছে। একটু ভালোবাসতে চাই, একটু কাঁদতে চাই, একটু কষ্ট পেতে চাই… হঠাৎ মাথা তুলে দেখি মুনের দুচোখ ভরা পানি। ভোরের আলোয় বড় বড় পাপড়ি গুলোতে মুক্তোর মতো চকচক করছে। আমি হতবাক হয়ে মুন বলে একটা চিৎকার করে মুনকে জোরে বুকের মাঝে টেনে নিলাম। মুন সাথে সাথে ডুকরে কেঁদে উঠলো; নাক থেকে রক্ত পরতে থাকলো…. আমার বুকের মাঝে শক্ত করে নিজের মুখ গুজে বললো, “আমি আমার জীবনের বাধ ভাঙা কষ্ট বুকের মধ্যে অনুভব করছি ইরা! ইরা আমি তোর আলিঙ্গনে আকাশ-সমান মমতা অনুভব করছি। পাগলের মতো কাঁদতে কাঁদতে নিজের হঠাৎ পাওয়া অনুভূতিগুলো চিৎকার করে বলতে লাগলো…. হঠাৎ ওর স্মার্টফোনটি ঘরঘর রকম বিকট শব্দ করতে লাগলো…Notification আসলো….

“Unable to identify the feeling. The sensor is not working due to extreme unknown feeling.”

ফোনটা অফ হয়ে গেলো load নিতে না পেরে! হঠাৎ সব কান্না থামিয়ে দুজনই ফোনের দিকে বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইলাম….

     (1 সপ্তাহ পর)

মুন এখন ভালোবাসতে জানে। মায়ের পেটে যে ভরসার আশ্রয় সে পায়নি, সেটা নাকি সে আমার বুকে পেয়েছে। তাই সে সবচেয়ে বেশি আমাকেই নাকি ভালোবাসে। মুন ওর বাবার সব রিসার্চ note পুড়িয়ে ফেলার পর Diary-টা ওর মাকে ফেরত পাঠিয়েছে। সাথে লিখেছে_

“তুমি আমার মাধ্যমে পৃথিবীর লোকের বাহবা চেয়েছিলে; তোমায় ক্ষমা করে এর চেয়েও দামি কিছু দিলাম- ‘সন্তানের ভালোবাসা’! ভালোবাসি মা”…..

পরবর্তীতে সাহিত্যিক হিসেবে আত্মপ্রকাশ ঘটিয়েই celebrity হয়ে যাই। বইটা এই যান্ত্রিক যুগেও ব্যাপক সাড়া ফেলে। ও হ্যাঁ, বইটা ছিল মুনকে নিয়ে লেখা বিশাল একটা গল্প_”সে-ও ভালোবাসতে জানে”।

Previous articleমরীচিকার মায়াজাল
Next articleগুটি আমের ঢিল
প্রতিধ্বনি
প্রতিধ্বনি একটি অনলাইন ম্যাগাজিন। শিল্প,সাহিত্য,রাজনীতি,অর্থনীতি,ইতিহাস ঐতিহ্য সহ নানা বিষয়ে বিভিন্ন প্রজন্ম কী ভাবছে তা এখানে প্রকাশ করা হয়। নবীন প্রবীণ লেখকদের কাছে প্রতিধ্বনি একটি দারুণ প্ল্যাটফর্ম রুপে আবির্ভূত হয়েছে। সব বয়সী লেখক ও পাঠকদের জন্য নানা ভাবে প্রতিধ্বনি প্রতিনিয়ত কাজ করে চলেছে। অনেক প্রতিভাবান লেখক আড়ালেই থেকে যায় তাদের লেখা প্রকাশের প্ল্যাটফর্মের অভাবে। আমরা সেই সব প্রতিভাবান লেখকদের লেখা সবার সামনে তুলে ধরতে চাই। আমরা চাই ন্যায়সঙ্গত প্রতিটি বিষয় দ্বিধাহীনচিত্ত্বে তুলে ধরতে। আপনিও যদি একজন সাহসী কলম সৈনিক হয়ে থাকেন তবে আপনাকে স্বাগতম। প্রতিধ্বনিতে যুক্ত হয়ে আওয়াজ তুলুন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here