মরীচিকার মায়াজাল

0
265

আইনুন নাঈমা

মায়ের সেলাই করা কাঁথার নিচে শুয়ে অমিত ভাবছে- প্রিয়মুখ গুলো কত আলোকবর্ষকাল দূরে ,কত শতাব্দী হলো তাদের সাথে দেখা হয়না। গায়ের মুক্ত বাতাস ,আদিগন্ত আকাশ ,মায়ের অনুসন্ধানী দৃষ্টির বেড়াজাল -সব ছেড়ে এই দূর দেশে ,সারি সারি অট্টালিকার ঘিঞ্জি পরিবেশে বিধিনিষেধ মুক্ত জীবন। তবুও খাপ খাওয়াতে পারছেনা সে। পড়াশুনার তাগিদে এসে সে বুঝতে পেরেছে -প্রয়োজন আর প্রিয়জন বাটখারার দুই পাল্লা কখনো সমান্তরালে থাকেনা। চোখের ভ্যাপসা উত্তাপে কষ্টের নিরাময় হয় কিন্তু গহীনের কান্না থামেনা। প্রতি রাত কাটে এভাবেই। সকাল হয় কাকের কর্কশ এলার্মে। চোখ বন্ধ করেই শিয়রে হাতড়াতে থাকে -ঘুমকাতর কারো অস্তিত্ব না পেয়ে বুঝতে পারে অনুজ পাশে নেই। ঘরের দমবদ্ধ হাওয়া শুকে দেখে -নাহ,কোথাও কফির পোড়া ঘ্রান নেই। কয়টা বাজলো ?এখনো বীথি কফি দিয়ে যায়নি নাকি ? জানালা গলে আসা সকালের আলো চোখে পড়তেই চোখের মনি ছোট হয়ে আসে।অমিত বিরবির করে বলে -ধ্যাৎত্তুরি ,ছাই লেখাপড়া।
ফ্রেশ হয়ে জানালা খোলে দিয়ে সে পড়তে বসে। রুমের মুটকো দুটো এখনো নাক ডেকে ঘুমুচ্ছে। এরা দুজন রুমে ফিরেছে মধ্যরাতে ;যখন সে ঘুমাবার প্রস্তুতি নিচ্ছিলো ঠিক তখন। দুদিন পর পর এদের মিটিং থাকে। কখনো ফিরে মধ্যরাতে ,কখনো বা ফিরেই না। কে জানে কোন অন্ধকার গলিতে ঘুমায় এরা। নিজেদের মধ্যে কি সব বলাবলি করে। বেশির ভাগই অমিত বুঝতে পারেনা। অমিতের মোবাইল বেজে উঠে। ওপাশ থেকে ভেসে আছে তার মায়ের স্নেহমাখা দরদী কণ্ঠ।
-হ্যালো অমু ,ভালো আছিস বাবা ?
-জি ,আম্মু। আমি ভালো আছি। তোমরা কেমন আছো ?
-আমার পাগল ছেলে। আমাদের নিয়ে চিন্তা করতে হবেনা বাবা। আমরা সবাই ভালো আছি।
-অনুজ পড়তে বসেছে ?আর বীথি কোথায় ?
-হুম ,বসেছে। বীথি নাস্তা বানাচ্ছে।
আরো কিছুক্ষণ কথা বলে কল কেটে দেয় অমিত।
রাত প্রায় একটা বাজে। চার দিক সুনসান নীরবতা। মাঝে মাঝে দূরে দু একটা কুকুরের হাক ডাক শুনা যাচ্ছে। অমিত সিগারেটের ঘ্রাণ পায়। এটা তার অপছন্দের তালিকায় শীর্ষে। কিছু বলার নাই।
এখানে সবাই সিনিয়র। চোখ বন্ধ করে সইতে হবে তাকে। অমিতকে এতো রাতে জেগে থাকতে দেখে সাজিদ সিগারেটের শেষ অংশটুকু জানালা দিয়ে ফেলে বললো
-কি অমু জ্ঞান সাধনা নাকি যোগ আরাধনা ?কি করো ?
অমিত পৃষ্টা উল্টিয়ে বললো -এই তো পড়ছি।
-তাই নাকি। তা এতো রাত জেগে ? ভালো।
অমিত বিরক্তির আভাস ঢেকে সংক্ষিপ্ত উত্তর দিলো -হুম
-তা পড়ো ঠিক আছে। কিন্তু জেনে রেখো তোমাদের মতো কৃতবিদ্যার্থী দিয়ে দেশের উপকার নেই।
অমিত মুখ তুলে তাকালো।

লিখুন প্রতিধ্বনিতেলিখুন প্রতিধ্বনিতে

  • বুঝলাম না বিষয়টা। একটু বুঝিয়ে বলবেন ?
    -তোমার শোনার মতো সময় আছে কি ?
    অমিত এই অপমান গায়ে মাখলোনা। বই বন্ধ করে বললো -জি, বলুন এবার।
    সাজিদ চোখ বন্ধ করে। বড়ো করে শ্বাস নেয়। তারপর যা বলতে থাকে তা কতকটা এই রকম
    -লেখাপড়া শেষ করে ভালো চাকরি হবে। সরকারি কর্মকর্তা। সকলে সসম্মানে কুর্নিশ জানাবে।
    মোটা অংকের বেতন আসবে। কিন্তু এর বাইরে যে আরেকটা পৃথিবী আছে। বৈষম্য ,দুর্নীতি ,অপসংস্কৃতির যাঁতাকলে পৃষ্ট সতেরো কোটি মানুষ যে তারই দিকে তাকিয়ে আছে। তাদের প্রত্যাশার শতাংশের একাংশ ও কি সে দিতে পেরেছে ?
    অমিত মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনতে থাকে। সাজিদ পিঠ চাপড়ে বলে -মনটাকে বড় করো। দেশের জন্য বিলিয়ে দাও নিজেকে। নিজের দেশ কে ভালোবাসতে শিখো।
    সবাই ঘুমিয়ে যাওয়ার পর অমিত শুয়ে শুয়ে অন্ধকারে সাজিদের বক্তব্যের যথার্থতা ভাবতে থাকে। সত্যিই তো। ভোগ লোভী জীবনের সার্থকতা কোথায়ও নেই।
    প্রায় তিনমাস অতিবাহিত হয়ে গেছে সাজিদের দেখানো পথে। এখন আর আগের মতো কাঁথামুড়ি দিয়ে জীবন নিয়ে ভাবতে খারাপ লাগেনা। মনে হয়না মায়ের বাহুডোর থেকে আলোকবর্ষ কাল দূরে আছে। যখন যে জায়গাতে থাকে সে জায়গাকেই ভেবে নেয় মায়ের বিছানো আঁচল । জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপী গরিয়সী-এই তপস্যা বাক্য মনের মধ্যে সেটে গেছে দৃঢ় ভাবে। গ্রীষ্মের কাঠপোড়া রোদে শরীল ঘেমে পায়ের মোজা চুপসে যায়। তবো সে টায়ার জ্বালিয়ে অবিচল দাঁড়িয়ে থাকে। পুলিশ এসে ধাওয়া করে ।সে নড়ে না। বিবেক বাধা দেয় – আমি তো কাপুরুষ নয়।
    ঐদিকে অমিতের বীরত্বের বৌদলতে সাজিদের পকেট দিনকে দিন ভারী হয়ে উঠছে। একথা অমিতের জানার কোনো উপায় ছিলোনা। এমন করে আরো কিছু দিন কেটে গেলো। পরীক্ষা শুরু হয়েছে প্রথম বর্ষের। আগামীকাল পরীক্ষা। জীবনে কোনোদিন চোখে অন্ধকার দেখতে হয়নি। এখন বীরত্বের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করতে গিয়ে অন্ধকার দর্শন করতে হচ্ছে। পড়াশোনার অনেক ফাঁকফোকর রয়ে গেছে। যা একরাতে কাভার করা অসম্ভব। সে ঈশ্বর চন্দ্র নয়। না আছে তার ঈশ্বর প্রদত্ত দৈব শক্তি। অমিতের মোবাইল বেজে উঠলো। সহ সভাপতি বারেক কল দিয়েছে।
    -অমি কোঁথায় আছিস ?তারাতারি আয়। ঐ মালোর বাচ্চা চন্দ্রনাথ কে টাইট দিতে হবে।
    অমিত আমতা আমতা করে বলল
    -আমার কাল পরীক্ষা আছে। আমি যেতে পারবনা।
    বারেকের গর্জন শোনা গেলো -ওরে বাটপার ,এই মন নিয়ে পলিটিক্স করতে এসেছিস। ফাঁকিবাজ কাপুরুষ।
    অমিতের শরীলের রক্ত গরম হয়ে গেলো -আমি কখন ফাঁকিবাজি করলাম ?কাকে ঠকিয়েছি। যা তা বকছেন কেনো ?
    মোবাইলের অপর প্রান্তে বারেক আবার গর্জে উঠলো -দৈনিক পাঁচশো করে টাকা নিস্ ,আবার সাধু সাজিস। ওসব চালাকিতে কাজ হবেনা। লোক পাঠাচ্ছি। এক্ষুণি চলে আয়।
    কুয়াশায় ঢাকা ধোঁয়াটে ব্যপারটা এবার স্বচ্ছ কাঁচের মতো পরিষ্কার হয়ে গেলো-ছিঃ ছিঃ এ আমি কি করেছি। দেশপ্রেম নিয়ে ব্যবসা। এই পাপ মুখ ঢাকবো কিভাবে ?
    সে বার বার তার মাথা টেবিলে আঘাত করছে। কপাল ফেঁটে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। বারেকের সাঙ্গপাঙ্গ এসে মাথায় ব্যান্ডেজ করে নিয়ে গেলো। রাগে দুঃখে তার লোম ফুলে উঠেছে। আজ সাজিদ বাসায় থাকলে একটা এসপার ওসপার হয়ে যেতো।
    বারেক হাত নেড়ে নেড়ে বক্তব্য দিচ্ছিলো। অমিতকে দেখে থামলো। অমিতের হাত পা কাঁপছে। ইচ্ছে হচ্ছে শরীলের সর্ব শক্তি দিয়ে বারেকের মুখে চড় বসাক। বারেক এক গাল তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বললো -তোমরা দেখো আনুগত্য কাকে বলে। এই বেচারার কাল পরীক্ষা।আমার একটু হাতের ইশারায় ছোটে চলে এসেছে। তোর আনুগত্যে আমি সত্যিই মুগ্ধ।
    চারদিকে করতালির বন্যা বয়ে গেলো । অমিতের শরীর পুড়ছে জ্বরে আর ভিতর পুড়ছে বারেকের কথার দহনে -যদি সামনের রসের বোতলটা দিয়ে বারেকের রসো মুখে একটা ঘা বসানো যেতো। কিন্তু তা করার উপায় ছিলোনা। প্রাণ ভয়ে সুকর্ম সম্পাদন করতে হলো। মাথা ভোঁ ভোঁ করে ঘুরছে। কোনোকিছু আন্দাজ করতে পারছে না সে। গরু মেরে যারা জুতা দান করে পাঠক তাদের কি বলবে তা আমার জানা নেই। কিন্তু অমিত তার প্রাপ্য মজুরি থেকে বঞ্চিত হলোনা। নোট ক খানা অমিতের পকেটে গুজে দিয়ে বারেক সদলবলে চলে গেলো। শীতের মাঝ রাত। শরীলে একটিও গরম কাপড় নেই। শীতের কুহেলিকা অমিতের নাকের নালাপথ সুড়ঙ্গ ভেবে ভোঁ ভোঁ করে ঢুকে পড়লো। টলতে টলতে কোনো রকমে রুম পর্যন্ত পৌঁছে ধপাস করে শুয়ে পরে ছুট্ট চৌকিতে।

  • ঘড়ির কাটায় সাড়ে ন টা বাজলো। দেয়ালের কোনো এক কোণে একটি টিকটিকি সঠিক সময়ের স্বীকারুক্তি স্বীকার করে পালিয়ে গেলো। তবু অমিত পরীক্ষার কেন্দ্রে যাওয়ার জন্য উঠলোনা। চোখের পাপড়ি একটু খোললো -কেউ এসে খাবার রেখে গেছে টেবিলের উপর। একবাটি ভাত। পাশের বাটিতে কি একটা হলুদ রঙের ঝোল তরকারি। কাঁচের গ্লাস ভর্তি পানি। খোলা জানালা দিয়ে একটা কাক এসে নোঙরা পায়ে বসলো বাটির উপর। খাবার খেয়ে ,তৃপ্তি সহকারে গ্লাস থেকে পানি পান করে উড়ে গেলো -হয়তো স্বজাতি মন্ডলে খাবারের সন্ধান জানাতে। অমিতের ফোনে কল এসেছে। সারা শরীল ব্যাথা। শরীর জম্বির মতো স্থির হয়ে গেছে। হাত বাড়িয়ে টেবিল হতে মোবাইলটা নিতে ও কষ্ট হচ্ছে। আরো দুইবার কল আসলো। অমিতকে ডেকে সাড়া না পেয়ে চুপ হয়ে গেলো। মিনিট দুই পর স্বর পঞ্চমীতে তোলে আবার আবার ফোন বাজছে। অমিত অবশ হাত বাড়িয়ে দিলো টেবিলের দিকে। কিন্তু নাগাল পেলোনা। নাগাল পাওয়ার জন্য আরেকটু কাত হলো। অনামিকার স্পর্শে মোবাইলটা পরে গেলো মেঝেতে। শেষ হলো যন্ত্রেন যন্ত্রনা। ভারসাম্য রক্ষার জন্য আরেকটু নড়তেই পানি ভর্তি গ্লাসটাও পরে গেলো মেঝেতে। আর পানির শোকে পরে গেলো অমিত। গায়ে কাঁচ ফুটে রক্ত ঝরছে অনবরত। পেটে যা ছিল তাও বের হয়ে গেলো। চোখের নোনা জল ,পেটের অপাচ্য ভগ্নাংশ,গ্লাসের জল ,আর লাল তারল্যের প্রসাধনীতে এমন বীভৎস রূপ দাঁড়ালো যে -দেখে কে বলবে এই সেই অমিত। এই করুন দৃশ্য দেখার মতো কেউ তখন ছিলোনা ঘরে। একটা দর্শক অবশ্য সেখানে উপস্থিত ছিল। যদি তার পাখা না হয়ে যদি দুটি হাত থাকতো তবে হয়তো এক গ্লাস না হোক একবিন্দু জলে পিপাসিত প্রাণীটির কণ্ঠ ভিজতো। দর্শক বার বার পাখা ঝাপটিয়ে,পাখার দিকে তাকিয়ে নিজের অক্ষমতা স্বীকার করে এক বিন্দু জলের পরিবর্তে একবিন্দু অশ্রু উপহার দিয়ে উড়ে চলে গেলো। দরজা কি জানালায় আর কোনো প্রাণীর ছায়া পড়লো না। ‘পানি’,’পানি’ বলে প্রতিধ্বনির করুন তরঙ্গ ছাদ ভেদ করে আকাশে বিস্তার লাভ করলো তা আর কারো কর্ণগুহরে আঘাত করলোনা। দেয়াল ঘড়ির ঘূর্ণায়মান সেকেন্টের কাটা বুকে চাবুকের ঘা দিতে দিতে আরো এক ঘন্টা অতিবাহিত হলো। এটা যার কারসাজির জিদ করে নাম উচ্চারণ করলে সে হয় সাজিদ। শেষ পর্যন্ত সে ই এলো। রুগীর দিক দিশার খেয়াল নাই। যদি থাকতো তবে আজ এসপার ওসপার একটা হয়ে যেতো। সাজিদ এসে অমিতকে মেঝে থেকে উঠালো ;সাবান দিয়ে ভালো করে গোছল করিয়ে কাঁচের আঘাতে সৃষ্ট ক্ষত জায়গা গুলোতে ওষুধ লাগিয়ে দিলো। কোনো একটা মিষ্টান্ন জাতীয় খাবার অমিতের মুখে দিলো। বারেকের দেয়া নোট ক খানা টেবিল থেকে নিয়ে ওষুধ কেনার বাহানা করে বাহির হয়ে গেলো। ফিরলো সন্ধ্যায়। অমিতের শরীল তখনো জ্বরে পুড়ছে।সাথে অনবরত কাশি। সাজিদ হাত দিয়ে কপাল স্পর্শ করে উত্তাপ নিলো। ওষুধ আনতে ভুলেনি সে। এক হাত দ্বারা মাথা উঁচু করে আরেক হাত দিয়ে কোনো রকম পরিমাপ ছাড়াই গলায় ওষুধ ঢেলে দিলো সাজিদ। বিকট গন্ধওয়ালা ওষুধ ইতিপূর্বে পেটে গেছে বলে মনে পড়ছেনা তার। পেটের ভিতর রাম রাবণের যুদ্ধ শুরু হয়েছে। পৃথিবী ঘুরছে চরকির মতো। অমিত সহ্য করতে পারছে না। বমি করে পেট থেকে ফেলে দিতে চাইলো। সাজিদ মুখ শক্ত করে চেপে ধরে রাখতে গিলতে বাধ্য হলো।
    -আরে খা খা। দেখবি কাল সকালেই সব ঠিক হয়ে গেছে। ঝড় ঝরে শরীলে ফুরফুরে মন নিয়ে মিছিলে যাবি দেখিস।
    সাজিদের আশ্বাসে বিশ্বাসী হয়ে গভীর ঘুমে নেতিয়ে পড়লো অমিত।
    ঘুম ভাঙলো পর দিন দুপুর বারোটায়। সাজিদের কথাই ঠিক। দিন দুই পর বিছানা থেকে উঠলো ঠিকই। তবে ওষুধের গুনে হাজিরা দিতে হলো বারেকের আস্তানায়। মাঝে মাঝে হাজিরা দিতে হয় অন্ধকার অলিগলিতে। কিছু উপরি পাওনা জুটে। তবে তা ওষুধের খাতিরে ভুলে যেতে হয়। এর মধ্যে কয়েকবার লাল ঘরের নিমন্ত্রণ ও জুটেছে। তবে বারেক আছে বলেই রক্ষা। নিমন্ত্রণের খাতা থেকে নাম বাদ পড়তে দেরি হয়না। ওষুধের গুনাগুন গাইতে গুনের নামতা মুখস্থ করতে হয় -এমনেই অবস্থা সৃষ্টি হলো অবশেষে। ওষুধের গুনে অন্ননালী অন্নপাপ মুক্ত হওয়ার জন্য ভীম একাদশী পালন করতে শুরু করলো। চুলের দৈর্ঘ্য যতোনা বাড়ছে ,দেহের প্রস্থ তার দ্বিগুন কমছে। এই দ্বিবিধ সমীকরণ যুগলের সমাধান বীভৎস রূপ ধারণ করলো। দেখে কে বলবে এই আমাদের সেই অমিত।
    ওইদিকে অমিতের পিতা নাজিম পোস্টমাস্টারকে নেওয়ার জন্য যমরাজ অনবরত পোস্ট কার্ড পাঠাচ্ছে।
    পঁয়ত্রিশ বার কল দেওয়ার পর ও যখন অনুজ অমিতের ফোন বন্ধ পেলো তখন আম্বুলেন্স ছাড়ার ইশারা দিয়ে পোস্টমাস্টারের পাশের সিটে ধপাস করে বসে পড়লো। কিন্তু বাদ সাধলো অমিতের মা।
    -আর একটু অপেক্ষা করো। আমার অমিত আসবে যে।
    -আসবে কিনা ছাই। এতো বার কল দিলাম। ফোনটাই বন্ধ করে রাখছে। ওর আশা বাদ দাও। ড্রাইভার আঙ্কেল ,গাড়ি স্টার্ট দেন।
    গাড়ির এক কোনায় বীথি বসে আছে। চুপ চাপ একমনে অসুস্থ পিতাকে দেখছে। হয়তো ভাবছে পরবর্তী অন্ধকার জীবনের কথা। গাড়ি ছাড়ার কথা শুনে চমকে উঠে বললো
    -আঙ্কেল আরেকটু অপেক্ষা করে দেখা যাক। ভাইয়া ফোন ধরে কিনা।
    সন্ধ্যার আবছা আলো অন্ধকারে রূপ নিলো। দু একটা কৌতুহলি লোক উঁকি দিচ্ছে কাঁচ ভেদ করে।পাশের দুতলার একটা ঘরের জানালা দিয়ে অল্প একটু আলো আসছিলো। কেউ একজন এসে সেটাও বন্ধ করে দিয়ে গেলো। ঝম ঝম করে বৃষ্টি শুরু হলো। ঝাপসা চোখে অমিতের আশায় কয়েকবার বাইরে তাকালো অমিতের মা। এবার কেউ বাদ সাধলোনা। গাড়ি চলতে শুরু করলো মরা কান্না কাঁদতে কাঁদতে। কিছু দূর যাওয়ার পর গাড়ি স্থির হয়ে গেলো। সমস্যা খোঁজার জন্য ড্রাইভার রেইনকোট পরে বাইরে বেরিয়ে এলো। অনুজ ও পিছু পিছু একটি ছাতা নিয়ে বাইরে বের হলো। হঠাৎ মৌমাছির মতো কিছু লোক ঘেরাও করলো গাড়ি। বৃষ্টি শুরু হতে না হতেই গলিতে পানির বন্যা বইতে শুরু করেছে। এমনিতেই অন্ধকার রাত তার উপর লোক গুলোর মুখ কালো কাপড়ে ঢাকা। চেনা কঠিন। কিন্তু এদের উদ্দেশ্য বুঝতে দেরি হলোনা। ড্রাইভারের কাছে টাকা আর ফোনটা ছিনিয়ে নিলো। সাথে কয়েকটা নাক বরাবর ঘুষি। অনুজ ফেরাতে গেলে তাদের কেউ একজন অনুজ এবং ড্রাইভার কে ছুরি দিয়ে আঘাত করে বসে। বর্জপাতের আলোতে রক্তমাখা ছুরিটা চক চক করছে। বৃষ্টি আরো জোড়ে শুরু হয়েছে। নোঙরা পানিতে ডোবায়মান দুটি প্রাণী ‘পানি ‘,’পানি ‘ বলে বলে গোংড়াচ্ছে। দূরে কোথাও বজ্রপাত হলো। পোস্ট কার্ডের অন্য জবাব দিয়ে এরা গাড়ির পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছিলো। ওদের মধ্যে একজন বললো -এখন আমরা কোথায় যাবো ?
    প্রায় ঘুমের ঘোরে এই কথা কানে বাজলো অনুজ অমিতের জননীর- এ যে তার অমিতের কণ্ঠ। তার কোথাও যাওয়ার জায়গা নাই নাকি ?পাগলের মতো গাড়ির দরজা খুলে বৃষ্টির মধ্যেই ছুটলো ডাকাত দলের পিছু পিছু -বাবা অমিত ….অমিত ….দাড়া বাবা
    পিছন থেকে অনুজের ভাঙা কণ্ঠ ..মা ….পানি দাও।

Previous articleসুর নাকি স্বর
Next articleসে-ও ভালোবাসতে জানে
প্রতিধ্বনি
প্রতিধ্বনি একটি অনলাইন ম্যাগাজিন। শিল্প,সাহিত্য,রাজনীতি,অর্থনীতি,ইতিহাস ঐতিহ্য সহ নানা বিষয়ে বিভিন্ন প্রজন্ম কী ভাবছে তা এখানে প্রকাশ করা হয়। নবীন প্রবীণ লেখকদের কাছে প্রতিধ্বনি একটি দারুণ প্ল্যাটফর্ম রুপে আবির্ভূত হয়েছে। সব বয়সী লেখক ও পাঠকদের জন্য নানা ভাবে প্রতিধ্বনি প্রতিনিয়ত কাজ করে চলেছে। অনেক প্রতিভাবান লেখক আড়ালেই থেকে যায় তাদের লেখা প্রকাশের প্ল্যাটফর্মের অভাবে। আমরা সেই সব প্রতিভাবান লেখকদের লেখা সবার সামনে তুলে ধরতে চাই। আমরা চাই ন্যায়সঙ্গত প্রতিটি বিষয় দ্বিধাহীনচিত্ত্বে তুলে ধরতে। আপনিও যদি একজন সাহসী কলম সৈনিক হয়ে থাকেন তবে আপনাকে স্বাগতম। প্রতিধ্বনিতে যুক্ত হয়ে আওয়াজ তুলুন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here