সফরে নামহীন মায়াবতী 

0
114

আবদুল্লাহ নুর আহম্মদ

আয়ান ও ফাইয়াজ—ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই উদ্যমী তরুণ, জ্ঞানের অভিযাত্রায় সহযাত্রী এবং হৃদয়ের গভীরে গাঁথা বন্ধুত্বের এক অদৃশ্য সেতুবন্ধে আবদ্ধ। আয়ান সহজ-সরল, আত্মমগ্ন; তার চিন্তার ভিত গাঁথা ধর্মীয় বিশ্বাসে, যার প্রতি রয়েছে নিঃস্বার্থ আনুগত্য। ফাইয়াজ ধর্মীয় অনুশাসনে আরও দৃঢ়—প্রত্যেকটি বিধান মেনে চলে হৃদয়ের অন্তস্তল থেকে। ভাবনায় পার্থক্য থাকলেও তাদের বন্ধনের ভিত্তি অটুট, অচঞ্চল।

তারা যেন একে অপরের আয়নায় নিজের প্রতিচ্ছবি খুঁজে পায়। কেবল বন্ধু নয়—সহচর, সহমর্মী ও জীবনের প্রতিটি বাঁকে ছায়াসঙ্গী হয়ে থাকা একান্ত আত্মীয়।

শহরের কোলাহল, যান্ত্রিক ক্লান্তি থেকে মুক্তি পেতে প্রায়ই তারা আশ্রয় নেয় প্রকৃতির স্নিগ্ধ কোলে। তাদের ভ্রমণ দলবদ্ধ নয়—দুজনেই যথেষ্ট। তারা জানে, অনেকের সঙ্গে পথ হাঁটলে অন্তরঙ্গতার সেই নির্জন সৌন্দর্য ম্লান হয়ে যায়। তাদের কাছে ভ্রমণের আসল রূপ ধরা দেয় তখনই, যখন পাশে থাকে নির্ভরতার একটিমাত্র ছায়া—প্রিয়তম বন্ধু।

এই কুরবানির ঈদে তাদের গন্তব্য—জাফলং। নীল জলের প্রতিচ্ছবি, পাথরের মায়া আর মেঘে ঢাকা পাহাড়ের কোলে কিছু নিরবিচার মুহূর্ত কাটানোর পরিকল্পনা। উৎসবের গন্ধ আর প্রকৃতির শান্ত মাধুর্য মিলে তারা খুঁজে নিতে চায় এক অনন্য আনন্দ, এক নিঃশব্দ ঈদযাপন। লোকজনে নয়, তাদের আনন্দের উৎস একে অপরেই—দু’জনেই পরিপূর্ণ এক জগত।

ঈদের বিকেলবেলায়, যখন আকাশে ছড়িয়ে পড়ে সোনালি আলো, হৃদয়ের ভেতর ফুঁটে ওঠে অনাবিল আনন্দের জোয়ার। ঠিক তখনই তারা রওনা হয় জাফলংয়ের পথে—স্বপ্নময় এক ভ্রমণের সূচনা। ট্রেনযাত্রা বেছে নেয় তারা, কারণ জানালার পাশে বসে প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য উপভোগ করার চেয়ে পরিপূর্ণ অনুভূতি আর কিছুতে নেই। সবুজ মাঠের দিগন্ত পেরিয়ে, দূরের পাহাড় আর মেঘের খেলা চোখে ভেসে ওঠে এক ছায়াশরীরের মতো। কুয়াশামাখা বাতাস এসে স্পর্শ করে তাদের মুখ—মনে হয়, যেন প্রকৃতিই তার স্নেহময় হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। শরীর ও মন এক অপার্থিব প্রশান্তিতে ডুবে যায়। এই যাত্রা শুধু ভৌগোলিক গন্তব্য নয়—এ এক অন্তরযাত্রা, অনুভবের এক নিঃশব্দ উৎসব।

লিখুন প্রতিধ্বনিতেলিখুন প্রতিধ্বনিতে

জীবনের প্রতিটি পথে, যতই ভিন্ন হোক দিশা—আয়ান ও ফাইয়াজ জানে, একসাথে থাকলেই যেকোনো যাত্রা হয়ে ওঠে অর্থপূর্ণ, স্মরণীয় এবং অপার আনন্দে পূর্ণ।দীর্ঘ ট্রেনযাত্রা শেষে তারা পৌঁছায় জাফলংয়ের মায়াবী প্রান্তরে। চারদিকে ছড়িয়ে থাকা প্রকৃতির অনিন্দ্যসুন্দর রূপ—সবুজে মোড়া তৃণলতা, শীতল হাওয়া, অবারিত নীলাকাশ, আর আকাশছোঁয়া পাহাড়—তাদের মন ছুঁয়ে যায় এক অনির্বচনীয় শান্তিতে। নিরিবিলি পরিবেশের মাঝে দাঁড়িয়ে তারা দু’জন হারিয়ে যায় সেই অপরূপ সৌন্দর্যে, যেন প্রকৃতি নিজ হাতে তাদের জন্য সাজিয়ে রেখেছে এক স্বর্গীয় আবেশ।

প্রতিটি বৃক্ষে, প্রতিটি পাথরে, নদীর কোল ঘেঁষে ছুটে চলা হাওয়ায়, তারা যেন অনুভব করে এক মহাশক্তির ছোঁয়া। বিস্ময়ে বিমুগ্ধ হয়ে পরস্পর বলে ওঠে—“কি অপরূপ সৃষ্টি! আর সেই স্রষ্টা, মহান আল্লাহ, না জানি কতটা আলোয় উদ্ভাসিত! এমন রূপ, এমন শোভা শুধু তিনিই দান করতে পারেন।”

হঠাৎ তাদের দৃষ্টি যায় দূরের এক পাহাড়চূড়ার দিকে—সেখানে ছোট ছোট কিছু ঘর দাঁড়িয়ে আছে নিঃশব্দে, যেন কোনো এক অতীতের গল্প বলছে। কাঠ ও খড়ের ছাউনিতে ঘেরা সেই ঘরগুলো দেখতে যেন প্রাচীন কুঁড়েঘরের মতো, তবুও তাদের মাঝে এক অপার্থিব টান। আগ্রহ নিয়ে তারা কাছে গিয়ে জানতে পারে—এই ঘরগুলো ভ্রমণপিয়াসীদের রাতযাপনের জন্য ভাড়া দেওয়া হয়।

প্রকৃতির এত কাছে থাকার এমন সুবর্ণ সুযোগ তারা হাতছাড়া করে না। দুজনেই নির্দ্বিধায় সিদ্ধান্ত নেয়—যতদিন তারা এখানে থাকবে, এই পাহাড়চূড়ার ঘরেই কাটাবে দিনরাত্রি। তারা চায় প্রতিটি প্রভাতে পাখির ডাকে জাগতে, সন্ধ্যায় পাহাড়ের নীরবতায় ডুবে যেতে, আর রাত্রির নক্ষত্রভরা আকাশের নিচে প্রকৃতিকে অন্তরে অনুভব করতে।

এ যেন ছিল এক অনন্ত ভালোবাসার শুরু—মানুষ আর প্রকৃতির মাঝে, সৃষ্টি আর স্রষ্টার মাঝে এক নিঃশব্দ, অথচ গভীর সংলাপ।

আজ আকাশে যেন পূর্ণিমার চাঁদ তার অপার রূপে উদ্ভাসিত—আলো ঝিকমিক করছে, চারপাশে ছড়ানো তারাদের মায়াবী ঝলক। এক অপূর্ব দৃশ্য! ঠিক এমন এক রাতে তারা দু’জনে সিদ্ধান্ত নেয় আজ অর্ধরাত্রি কাটাবে ঘরের ছাদে।

যেই কথা, সেই কাজ। এশার নামাজ আদায় করে তারা ছাদের দুই কোণে দুইটি চেয়ারে বসে, হাতে ধরা দু’কাপ ধোঁয়া ওঠা কফি। কফিতে চুমুক দিতে দিতে ডুবে যায় অন্তরঙ্গ আলাপে। চাঁদের আলোয় তাদের মুখাবয়বে ফুটে ওঠে এক অনন্ত প্রশান্তি।

হঠাৎ আইয়ানের চোখ পড়ে দূরের এক পাহাড়ের ঘরের ছাদের দিকে। সেখানে, চাঁদের আলোয় ভাসমান এক অবয়ব—কে যেন দাঁড়িয়ে আছে। উজ্জ্বল চাঁদের নিচে সেই দৃশ্য যেন তাকে বিমোহিত করে। সে ছুটে যায় ছাদের কিনারে। দূর থেকে আবছা আলোয় যা সে দেখে, তা যেন এক মায়াবতী—রহস্যে মোড়া, জ্যোৎস্নায় গাঁথা এক অপরূপ রূপকথার চরিত্রআইয়ান আনমনে গুনগুন করে গাইতে থাকে—

“নিশিথে পূর্ণিমার নরম আলো,
তারার ঝিলমিল স্বপ্নের ঢলো,
ছাদের উপরে মায়াবতী হাঁটে—
চোখে তার জ্যোৎস্না, মৌনতা সাথে।”

সে দাঁড়িয়ে থাকে ছাদের এক কোণে, নিঃশব্দে।
তার চোখ বারবার ছুটে যায় ঐ মায়াবতীর দিকে।
মনে জাগে এক অদ্ভুত টান,
বারবার দেখতে ইচ্ছে করে তাকে।

এসময় ফাইয়াজ এসে বলে,
— “কিরে, ঐখানে দাঁড়িয়ে কী গুনগুন করছিস?”
আইয়ান হালকা হেসে বলে,
— “দোস্ত, এক অপূর্ব মায়াবতীকে দেখছি। ওকে দেখতে খুব ইচ্ছে করছে।”
ফাইয়াজ কাঁধ উঁচিয়ে বলে,
— “এই ছাদে তুই মায়াবতী কোথায় পেলি?”
আইয়ান চোখে ইশারা করে বলল,
— “দেখে নে পিছনে।”

ফাইয়াজ পিছনে ঘুরে তাকিয়ে দেখে— সত্যিই এক মায়াবতীপ্রায় তরুণী ছাদের অন্য প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে, চুপচাপ, জ্যোৎস্নায় ঘেরা।

সে কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
— “দেখে লাভ কী? দুইদিন পরে চলে যাব আমরা আর এসব আমাদের শরিয়তে নিষিদ্ধ।”
আইয়ান শান্ত গলায় জবাব দেয়,
— “আরেহ, আমি তো কোনো অবৈধ সম্পর্কে যাচ্ছি না। যদি মনে থেকে যায়, পছন্দ হয়— তাহলে বিয়েটা তো করতে পারি। ইসলাম সেটাই তো বলে।”

ফাইয়াজ তার কথা শুনে হেসে ওঠে।
দুজনেই হেসে ওঠে অদ্ভুত এক উষ্ণতায়,
তারপর গল্প করতে করতে নিজেদের ঘরে চলে যায়, ফাইয়াজ বিছানায় গিয়ে রাতের নিস্তব্ধতায় হারিয়ে যায়।
“আর আইয়ানের চোখে ঘুম নেই। বারবার ভেসে আসে ছাদের সেই মায়াবতীর দৃশ্য। যাকে সে ভালো করে দেখেইনি, সেই অচেনা রূপের জন্যই এত আকুলতা! ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ সে ডুবে যায় ঘুমের গভীর সাগরে।”সকালের ঘুম ভেঙেই হঠাৎ জরুরি এক ডাকে ছুটে যেতে হয় ঢাকায়। যদিও পরিকল্পনায় ছিল এক নিঃশ্বাসে কেটে যাবে আজকের দিনটা, নীরব, শান্ত আর অলস। তবুও বাস্তবতা সবসময় কবিতার মতো মসৃণ হয় না। অথচ আইয়ানের মন যেন এক অজানা টানে স্থবির হয়ে আছে, ঠিক যেন কোনো অদৃশ্য সুতোয় বাঁধা পড়ে গেছে সে। কী সেই টান? কী সেই টানাপড়েন?

বুকের গভীরে যেন এক নাম না জানা আবেশ, এক মুখ—যার নাম জানে না, কেবল অনুভব করতে পারে। সে মুখই আজ বারবার ভেসে ওঠে চোখের সামনে। শহরের কোলাহল নয়, মনের গহীনে সেই মায়াবতীর মৃদু হাসি, তার চাহনি, তার অস্তিত্বই যেন নান্দনিক এক আবেশ হয়ে ছড়িয়ে পড়ে।

আইয়ান মগ্ন হয়ে যায় আপন ভুবনে। অন্তরাল থেকে যেন ভেসে আসে এক মৃদু সংলাপ—

— “ঐই মায়াবতী, তোমার নাম জানি না, কিন্তু আমি তোমায় মায়াবতী বলেই ডাকব।”
— “তাহলে ডাকুন… হয়তো সে নামেই আমার গল্প শুরু হবে।”
— “তোমাকে কেন ভুলতে পারছি না?”
— “আমি কি বলব… নাকি হৃদয়ের অজান্তে প্রেম ঢুকে পড়েছে?”

একটি মৃদু হাসির ছায়া যেন তার ঠোঁটে খেলে যায়—এক আলোর রেখা, এক মায়ার খেলা।

— “আমি তো যাচ্ছি… তবে আর কি কখনো দেখা হবে না?”
— “যদি মন সত্যি করে ডাকে, তবে দেখা হবেই। পৃথিবী ছোট নয়, কিন্তু ভালোবাসা তার চেয়েও বিস্তৃত।”

ঠিক সেই মুহূর্তে ফাইয়াজের ডাক এসে ছিন্ন করে দেয় এই কল্পনার সূক্ষ্ম জাল। বাস্তবের মাটিতে নেমে আসে আইয়ান।

তবু মন পড়ে থাকে পেছনে—এক নামহীন মায়ায়, এক অপরিচিত মুগ্ধতায়।
চোখের কোনে স্বপ্নের রেখা নিয়ে, হৃদয়ে এক অচেনা যন্ত্রণার স্পর্শ নিয়ে
ঢাকার দিকে রওনা হয় সে—
যেখানে অপেক্ষা করে দায়িত্ব,
আর পেছনে পড়ে থাকে এক অনিশ্চিত প্রেমকথার সূচনা।কিন্তু ঢাকার কংক্রিটের ভিড়ে আইয়ানের মন কিছুতেই স্থির হতে চায় না। তার চেতনাজুড়ে যেন নিরন্তর বাজছে সেই পাহাড়ঘেরা কুরের ঘরের স্নিগ্ধ স্মৃতি, আর তার মধ্যে মায়াবতীর ঝাপসা মুখ। চোখ বন্ধ করলেই যেন দেখতে পায় তাকে—এক পলকের সেই চাওয়া, সেই না-বলা কথাগুলো বারবার ফিরে আসে।

রাত গভীর হয়, নিঃস্তব্ধতা বাড়ে, কিন্তু চোখে ঘুম আসে না একফোঁটাও। চারপাশ নিস্তব্ধ, অথচ ভিতরে এক অস্থির সুর বেজে চলে

**
ঐ মায়াবতী, কেন এভাবে এসে গেলে চোখের সামনে?
যদি আসতেই হবে, তবে সাথী হলে না কেন?
আমি যে পারিনি তোমায় বলতে—
সেদিন ঠিকমতো দেখাও হয়নি তোমায়,
তবুও কী এক মোহে ডুবে গেছি!
তোমার প্রতিটি হাসি, প্রতিটি চাহনি—
মনকে ছুঁয়ে গেছে এমনভাবে,
যেন জন্ম-জন্মান্তরের চেনা।
এখন শুধু দেখতে ইচ্ছে করে,
ঘুমের ঘোরে হলেও—
একবার এসো, অন্তঃস্বপ্নে এসে দাঁড়াও আমার সামনে…
**

এই গানের কথাগুলো যেন তার হৃদয়েরই প্রতিধ্বনি। নিজেই নিজের কাছে প্রতিজ্ঞা করে—কাল ভোরেই আবার পা বাড়াবে জাফলংয়ের পথে। সেখানে পাহাড়, মেঘ আর মায়াবতীর অপেক্ষা।

ভাবনার ছায়ায় ঢাকা পড়ে যায় চোখ, ক্লান্ত হৃদয় একসময় ডুবে যায় নিঃশব্দ ঘুমে।ফজরের নামাজ শেষে নরম আলোয় মুখ ভেজা,
আয়ানের চোখে যেন এক অদ্ভুত উদ্দীপনা।
হঠাৎ বলে উঠল ফাইয়াজকে—
— চল, আজ বিকেলে আবার যাই জাফলং।
ফাইয়াজ ভ্রু কুঁচকে তাকায়, চোখে বিস্ময়—
— আবার? কালই তো ফিরলাম! কেন এ আকুলতা?
আয়ান হেসে, যেন ভেতরের এক রহস্যে ভাসে—
— সেই মায়াবতীর জন্য… যাকে এক ঝলক দেখেই মনটা কেমন অস্থির হয়ে উঠল।
ফাইয়াজ একটু কঠিন গলায় বলল—
— আয়ান, তুই জানিস না, এসব ঠিক না।
এভাবে চোখের পলকে ভালোবাসা হয় না…
তুই তো বরাবর বাস্তবের মানুষ,
আজ হঠাৎ কিসে এমন হারিয়ে গেলি?
আয়ান গভীরভাবে চেয়ে থাকে দূর আকাশের দিকে,
তার কণ্ঠে একরাশ শান্ত অথচ দৃঢ় প্রতিজ্ঞা—
— আমি প্রেম করতে বলিনি।
শুধু চাই তাকে আবার একবার দেখতে।
যদি মন বলে, ‘হ্যাঁ, এ সে-ই’,
তবে জীবনটা তাকে দিয়েই শুরু করব।
ফাইয়াজ নিঃশব্দ হয়ে যায় কিছুক্ষণ,
তারপর শুধায়—
— এই কথা… সত্যি?
— হ্যাঁ,— নিঃসংশয়ে জবাব আয়ানের,
— এই আমার সত্য, এই আমার বিশ্বাস।
সন্ধ্যার আলো যখন পাখিদের ডাকে মিলে মিশে যায়,
দুজন বন্ধু রওনা দেয় আবার জাফলংয়ের পথে।
কিন্তু গন্তব্যে গিয়ে—সবুজ পাতার ছায়া যেমন হঠাৎ হাওয়ায় কাঁপে,
তেমন করেই আয়ানের হৃদয় কেঁপে ওঠে।
সেই ঘর, সেই জানালা…
সব আছে, শুধু নেই সেই মায়াবতী।

হঠাৎ যেন শূন্যে ভেসে উঠে তার কণ্ঠ—
এ কী করলে মায়াবতী…
তুমি কোথায় হারিয়ে গেলে, আমাকে রেখে?
আমি তো এসেছিলাম শুধুই তোমায় দেখতে…
তুমি তবে এমনই—প্রেমের সাগরে ভাসিয়ে, আমাকে একা ফেলে চলে গেলে…

ফাইয়াজ এগিয়ে এসে কাঁধে হাত রাখে, তার চোখেও যেন হালকা কুয়াশা—
— ভাই, এখন কী করবি?
আয়ান চোখ বন্ধ করে বলল—
— জানি না… বুকের ভেতরটা যেন হু হু করে কাঁদছে।
আমি কেবল জানি, এই অনুভবটা মিথ্যে নয়।
ফাইয়াজ একটুখানি থেমে বলে—
— একটা ফায়সালা তো আছেই…
যদি উপরওয়ালার রহম হয়,
যার খোঁজে এসেছিস, সে-ই তোকে খুঁজে নেবে।
সূর্য অস্ত যায়, জাফলংয়ের আকাশে এক টুকরো নীরবতা।
তবুও দুই বন্ধুর মধ্যে কিছু একটা থেকে যায়—
প্রেম, প্রার্থনা, আর এক আকাশ অপেক্ষা…কী করা উচিত—এই নিয়ে যখন তারা চিন্তায় ব্যস্ত, হঠাৎ ফাইয়াজ বলে উঠল,
“চলো, ঘরের কর্মচারীকে জিজ্ঞেস করি। কিছু তথ্য পাওয়া যেতে পারে।”

তারা কর্মচারীর কাছে গিয়ে জানতে চাইলে সে বলল,
“আমি জানি। একদিন আমার কাজ দেখে ওই ভদ্রলোক আমাকে বলেছিলেন, ‘এই কার্ডটা রাখো। যদি কখনো ঢাকায় যাও, তাহলে আমার বাসায় এসো।’ এটা তার ঠিকানা।”

আইয়ান কার্ডটা দেখে খুশি হলেও নিজের পরিচয় দিতে অস্বীকৃতি জানায়। তখন তারা দুজন আবার ভাবনায় পড়ে যায়—এখন কী করবে?

এই সময় কর্মচারী বলে,
“দিব, তবে এর বিনিময়ে টাকা লাগবে।”

তারা শেষ পর্যন্ত টাকা দিয়ে সেই পরিচয় সংগ্রহ করে এবং ঢাকার উদ্দেশে রওনা দেয় ঢাকার ব্যস্ত শহরে এসে, এক অলিখিত প্রত্যাশা নিয়ে আইয়ান তাঁর মা-বাবাসহ পা রাখে মায়াবতীর প্রাঙ্গণে। চারপাশে সবকিছু যেন এক স্বপ্নময় আবহে ঢেকে যায়—হৃদয়ের গহীনে জন্ম নেয় এক অভূতপূর্ব অনুভব।
বিয়ের প্রসঙ্গ ওঠে, আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়।
হঠাৎই দরজার ওপারে দেখা মেলে সেই কন্যার—যার চোখে ছিল হরিণের মত নরম বিস্ময়, আর মুখজুড়ে ছড়িয়ে থাকা অপার মায়া।
আইয়ান এক দৃষ্টিতে তাকে দেখে থমকে যায়।
সে যেন বাস্তব নয়, কোনো কবিতার পঙ্‌ক্তি হয়ে সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।
কন্যার নাম—আফরোজ। নামের মধ্যেই যেন লুকিয়ে আছে এক নিভৃত জ্যোৎস্না, এক অনির্বচনীয় আকর্ষণ।

পরিবেশে ছড়িয়ে পড়ে এক নরম সুর, যেন নিঃশব্দে দুই হৃদয়ের মাঝে সেতুবন্ধন গড়ে ওঠে।
দুই পরিবার মিলেমিশে ঠিক করে বিয়ের দিন।
আর ঠিক সেই দিনটিতেই, ভালোবাসা আর আশীর্বাদের আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে, সম্পন্ন হয় তাদের শুভ বিবাহ।
নতুন এক জীবনের সূচনা হয়—স্বপ্ন আর বাস্তবতার সংযোগস্থলে।বিয়ের পর প্রথম সফরে, আফরোজা ও আইয়ান ছুটে যায় জাফলংয়ের অতল সবুজের বুক চিরে, পাহাড়ের কোলঘেঁষে এক নির্জন কুড়েঘরে। সে ঘর যেন সময় থেকে ছিটকে পড়া কোনো স্বপ্নের টুকরো—চারপাশে পাহাড়, দূরে বয়ে যাওয়া নদী, আর মাথার উপর মেঘেদের যাত্রা।

রাত্রি নামে নিঃশব্দে। নিশীথ রাতে তারা কুড়েঘরের ছাদে বসে, নরম চাঁদের আলোয় দু’জনে ভিজে যায় প্রেমের মৃদু স্পন্দনে। বাতাসে মিশে থাকে কাঠগোলাপের গন্ধ, আকাশের তারা যেন গুনে গুনে শোনে তাদের কাহিনি। তারা কথা বলে—কীভাবে প্রথম দেখা, কীভাবে গড়ে ওঠে সম্পর্ক, কীভাবে সেই সম্পর্ক রূপ নেয় গভীর ভালোবাসায়। সে এক স্বর্গীয় আলাপ, যেন দুই হৃদয়ের নীরব গদ্যপাঠ।

হঠাৎ করেই আইয়ানের মুখে নামে ছায়া। তার চোখে এক বেদনার রেখা।
আফরোজা উদ্বিগ্ন স্বরে জানতে চায়,
— “কি হলো? এমন চুপচাপ হয়ে গেলেন হঠাৎ?”

আইয়ান ধীরে বলে, কণ্ঠে ভারী হয়ে ওঠা স্মৃতির সুর,
— “জানো, আগে যখন ভ্রমণে বের হতাম, প্রতিটি পথে সঙ্গী ছিল আমার প্রাণপ্রিয় বন্ধু ফাইয়াজ। এমনকি এই জাফলংয়েও এসেছিলাম ওকে নিয়ে। কিন্তু আজ… আজ ও নেই। নিয়ে আসতে পারলাম না তাকে। বুকের একপাশ শূন্য মনে হয়।”

আফরোজা নিঃশব্দে তার হাত ধরে। চোখে থাকে সহানুভূতির কোমল ভাষা।
সে বলে,
— “ভালোবাসার মতো বন্ধুত্বও তো হৃদয়ে থেকে যায়, দূরত্ব তাকে নিঃশেষ করতে পারে না।”

কিন্তু আইয়ানের নিরুত্তর চোখে যে বিষণ্নতা, তা কোনো ভাষার সান্ত্বনায় ভরপূর হয় না। কারণ, সেই বন্ধুত্ব ছিল আত্মার গভীর সমঝোতায় বাঁধা, যেখানে শব্দ নয়, নীরবতাই ছিল যোগাযোগের পাথেয়।

এভাবেই কেটে যায় সেই রাত—বিষণ্নতা আর ভালোবাসার এক অদ্ভুত সহাবস্থানে।
তারা বসে থাকে পাশাপাশি, চুপচাপ। আকাশের তারা জ্বলজ্বল করে, পাহাড় নিঃশব্দ সাক্ষী হয়ে থাকে।
রাতটি তাদের ভালোবাসা ও বন্ধুত্বের দুটি বিপরীত সুরে লেখা এক কবিতা হয়ে থেকে যায়—মৃদু, মরমি, অনিঃশেষ।

Previous articleশূন্যতার গান
Next articleকিংকর্তব্যবিমূঢ়
প্রতিধ্বনি
প্রতিধ্বনি একটি অনলাইন ম্যাগাজিন। শিল্প,সাহিত্য,রাজনীতি,অর্থনীতি,ইতিহাস ঐতিহ্য সহ নানা বিষয়ে বিভিন্ন প্রজন্ম কী ভাবছে তা এখানে প্রকাশ করা হয়। নবীন প্রবীণ লেখকদের কাছে প্রতিধ্বনি একটি দারুণ প্ল্যাটফর্ম রুপে আবির্ভূত হয়েছে। সব বয়সী লেখক ও পাঠকদের জন্য নানা ভাবে প্রতিধ্বনি প্রতিনিয়ত কাজ করে চলেছে। অনেক প্রতিভাবান লেখক আড়ালেই থেকে যায় তাদের লেখা প্রকাশের প্ল্যাটফর্মের অভাবে। আমরা সেই সব প্রতিভাবান লেখকদের লেখা সবার সামনে তুলে ধরতে চাই। আমরা চাই ন্যায়সঙ্গত প্রতিটি বিষয় দ্বিধাহীনচিত্ত্বে তুলে ধরতে। আপনিও যদি একজন সাহসী কলম সৈনিক হয়ে থাকেন তবে আপনাকে স্বাগতম। প্রতিধ্বনিতে যুক্ত হয়ে আওয়াজ তুলুন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here