মিল্লাত মোরসালিন
১)
খুব সাবধানে জানালা একটুখানি খুলে মা-বাবাকে শেষবারের মতো দেখল নীলা।পাহাড়সম বিষাদ বুকে চাপা রেখে দূর থেকেই বাবা-মাকে বিদায় জানালো।তাকে যে তার স্বপ্ন পূরণ করতেই হবে।
নীলার বাবা রমিজ উদ্দিন মন্ডল তার পূর্বপুরুষের সমস্ত সম্পত্তির পাশাপাশি তাদের মান্ধাতা আমলের চিন্তাধারাকেও আকড়ে ধরে আছে।
“মেয়ে মানুষের আবার কিসের পড়াশোনা?মেট্টিক পাশ করাইছি এটাই অনেক।সংসারের কাজ শিখুক, অনেক ঢেঙা তো হইছে,বিয়ের বয়স পার হতে বসলো।”
নীলার উচ্চশিক্ষার স্বপ্নের অপমৃত্যুর ভিত একথা বলেই গড়লেন রমিজ মন্ডল।কোনো উপায় না পেয়ে আজ পালিয়ে স্বপ্নের শহর ঢাকাতে আসার উদ্দেশ্যে রওনা দিলো নীলা।ঢাকায় নীলার ছোটবেলার বান্ধবী মমিতা থাকে তার স্বামীর সাথে।সে নীলাকে একটি ম্যাসে উঠিয়ে দিলে তার সাথে একটি টিউশনেরও ব্যবস্থা করে দিলো।নিজের যাবতীয় খরচ একাই বহন করে ঢাকায় এই ক্লান্ত জীবন চলতে থাকলো তার।
দেখতে দেখতে দুইটি বছর কেটে গেলো।নীলার বাবা তাকে তায্যকন্যা ঘোষণা করলেও স্বামী বাসায় না থাকলে লুকিয়ে নীলার সাথে ফোনে কথা বলে তার মা।নীলার মা’র স্বপ্ন ছিলো তার মেয়ে উচ্চশিক্ষিত হবে। এখন নীলা তার ও তার মা’র স্বপ্ন পূরণের পথ পাড়ি দিচ্ছে।
২)
৫ই মার্চ ২০২৫, আজ সাবিহার জন্মদিন।তার পছন্দের টিউটর নীলাকে ছাড়া কোনোভাবেই জন্মদিনের কেক কাটবে না সাবিহা।সাবিহার জেদে একপ্রকার পরাস্ত হয়েই গভীর রাত পর্যন্ত থাকতে হলো নীলাকে।এদিকে ম্যাসের গেইট বন্ধ হয়ে যাবে ১০ টায়, অলরেডি ৯ টা ৩০ বাজে।সাবিহার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নীলা তাড়াতাড়ি ম্যাসের উদ্দেশ্যে রওনা দিলো।পাশের গলি দিয়ে যেতে ১০ মিনিট লাগবে কিন্তু এই নিস্তব্ধ রাতে এই গলি দিয়ে যাওয়ার বিন্দুমাত্র সাহস নেই তার।অবশ্য বুদ্ধিবানের কাজ হলো মেইন রাস্তা দিয়েই যাওয়া ,নীলা তাই করলো।এ এলাকাটা এমনিতেই একটু বেশিই নির্জন।রমজানে আরো কবরস্থানে পরিণত হয়েছে। দুচোখ যেদিকেই যায় কোনো জনমানবের দেখা নেই।নীলার ভয় করছে,কয়েকবার আয়াতুল কুরসি পড়ে বুকে ফু দিয়ে আরো দ্রুত হাটা শুরু করলো।কিন্তু নিশিরাত যে মানুষরুপী হায়নাদের ভক্ষণের সময়।নীলার শেষ রক্ষা হলো না।যেন শুন্য থেকে একটি কালো গাড়ি এসে তাকে টেনে নিলো এর মধ্যে।কিছু বোঝার আগেই ঘুটঘুটে অন্ধকার ঘ্রাস করে নিলো।এই অন্ধকারে কিছু হায়না খুবলে খুবলে তাদের ক্ষুধা মেটালো। নীলার চোখের পানি গড়িয়ে গড়িয়ে ক্ষত স্থানে গিয়ে নীলাকে জানান দিচ্ছে তারা তোমার সবকিছু কেড়ে নিয়েছে।পরদিন সকালে নীলার ক্ষত-বিক্ষত দেহ রাস্তার পাশে পড়ে আছে।দেহে হয়তো এখনো রুহ আছে কিন্তু নীলা মৃত,মৃত তার আত্মা।
তিন আইসিইউ এ থাকার পর নিথর এ খোলসটাকে ডাক্তাররা কোনোভাবে বাঁচাতে পারলেও খোলসের ভেতরের সত্তাটা এখনও ঐ অন্ধকারে বন্দি,এখনও হায়নাদের দখলে।পরেরদিন নীলাকে তার বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। নীলা বাড়িতে পৌছার পূর্বেই সমস্ত গ্রামের লোকের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। বাড়ি পৌছানোর পর মন্ডলবাড়িতে মানুষের ঢল নামলো।নীলা আজ রহস্যময় এক জন্তু যাকে সবাই দেখছে।
“মন্ডল সাহেবের মান-সম্মান আজ শেষ”
“ছি,ছি”
“যে মেয়ে বাড়ি থেকে পালায় তার আর কি হবে এ ছাড়া”
“এমন মেয়েকে বিয়ে করবে কে?”
“আমার এমন মেয়ে হলে ঘরেই তুলতাম না”
একেকটা বাক্য নীলার কান দিয়ে প্রবেশ করে হৃদয়ে আঘাত করতে গিয়ে একটু হতাশই হলো বটে।নীলার আজ কোনো অনুভূতি নেই,নেই কোনো স্বপ্ন,ভয়,লজ্জা।থাকবে কি করে?তার যে মানুষরুপী ফাপা খোলসটা আছে তা এ জগতের বাহিরে।
এত এত শকুন চোখের মাঝে একটি চোখে চোখ পড়তেই নীলার খোলসে অনুভুতি জাগ্রত হলো।এ চোখে কোনো ঘৃণা নেই,কোনো হা-হুতাশ নেই, নেই কোনো অবজ্ঞা।শুধুই মমতা ও ছোট্ট নীলার জন্য অফুরন্ত ভালোবাসা রয়েছে এদুটি চোখে।এ চোখ নীলার মা’র। মাকে দেখে নীলার চোখের জল অনবরত আর্তনাত করে বলছে,
“মাগো! তোমার মেয়ের কোনো দোষ নেই
মা বিশ্বাস করো,তোমার মেয়ের কোনো দোষ নেই।”
আয়েশা বেগম নিজের বুকের মাঝে নীলাকে টেনে নিলো।কপালে চুমো খেয়ে নীলার কাঁধে নিজের মাথা রেখে বললো,
“ধুর বোকা মেয়ে, কান্না করিছ কেনো? আমি তো আছি রে, তোর মা তো বেঁচে আছে নাকি?”
৩)
রাত ৯ টা, নীলা তার রুমে শুয়ে আছে।মাকে দেখার পর নিজের জন্য না হলেও মা’র জন্য বেঁচে থাকার প্রয়াস জন্ম নেয় তার মাঝে।এরই মাঝে পাশের রুম থেকে চিৎকারের আওয়াস আসে।রমিজ মন্ডল অনেক ক্ষ্যাপা ও বিরক্ত আয়েশার উপর।
“কোন কুলগ্নে জন্ম নিছিলো এ বংশে।মেয়েকে লাই দিয়ে দিয়ে চরিত্রহীন বানাইছো।শহরে ছেলেদের সামনে দিয়ে হই হই করে ঘুরবে তো এরকম হবে না তো কি হবে, ওর সাথে সাথে আমার বংশের নামও ডুবালো।ওর মতো মেয়ের কোনো জায়গা নাই এই মন্ডল বাড়িতে।”
নীলা দুকানে আঙুল দিয়ে যথাসম্ভব এ কথা না শোনার চেষ্টা করলো।বেঁচে থাকার যে অগ্নিশিখা নিভু নিভু করছিলো বাবার কথা শুনে তা একেবারে নিভে গেলো নীলার। শেষ পর্যন্ত তার জন্মদাতা বাবাও তাকেই দোষারোপ করছে এ কথা সে বিশ্বাস করতে পারছে না নিজ কানে শোনার পরও।
পরিস্থিতি উপলন্ধি করতে বিন্দুমাত্র সময় লাগলো না আয়েশা বেগমের।পাশের রুম থেকে এসে নীলার সামনে বসে পড়লেন তিনি।কিছুক্ষণ নীলার দিকে তাকিয়ে নীলার কোলে নিজের মাথা রাখলেন।এরপর নীলার হাতটি ধরে নিজেই নিজের মাথায় চুল বোলাতে বোলাতে বললেন,
“মারে দেখ, আজ আমি তোর মেয়ে হয়ে গেছি।তুই যখন ছোট ছিলি প্রতিদিন দুপুরে আমার কোলে শুয়ে থাকতি, আমি তোর চুল বুলিয়ে দিতাম, তুই অনেক শান্তিতে ঘুমিয়ে পড়তি।আজ দেখ আমি তোর কোলে, তুই আমার মা।মা কি কখনো তার মেয়েকে ছেড়ে চলে যায় বল।”
নীলা এবার নিজ হাতেই তার মা’র চুল বুলিয়ে দিতে লাগলো।
অমাবস্যার রাত, চারিদিক অন্ধকার গ্রাস করে নিয়েছে। আয়েশা বেগম বুঝতে পেরেছেন এ সমাজ তার মেয়ে বাঁচতে দিবে না।তাই আজ নতুন জীবনের সন্ধানে তিনি ও নীলা হারিয়ে গেলেন এই অন্ধকারে।
