গ্রামের সহজ সরল মেয়েটি

0
399

আরিফুজ্জামান সোহাগ

কনকনে শীত।বাইরে বইছে হীমেল হাওয়া।চারিদিক স্তব্ধ! এমন সময় প্রসবের ব্যাথা উঠে রফিক সাহেবের স্ত্রী সাদিয়া বেগমের।রফিক সাহেব গ্রামের এক হতদরিদ্র পরিবারের সন্তান। তাদের আশেপাশে তিন গ্রামেও নেই কোন ডাক্তার কিংবা কবিরাজ।এদিকে তার স্ত্রীর ব্যাথাও ক্রমশ বাড়তে লাগলো।

রফিক সাহেবের এক চাচী বলে উঠলো, "ছৈলটার এত কষ্ট আর সহ্য করা যাচ্ছে না, বাপু!তুই একনা গন্জে যায়া ডাক্তার কে নিয়ে আয়।নাহলে কোন কবিরাজকে নিয়ে আয়।চাচীর কথা শুনে আর বিন্দুমাত্র দেরি না করে রফিক সাহেব বাড়ি থেকে বেড়িয়ে গেলেন ডাক্তার আনতে।এদিকে ডাক্তারকে নিয়ে বাসায় পৌছা মাত্র তিনি শুনতে পেলেন বাচ্চার কান্নার শব্দ।

এরপর খুশির বন্যা যেন ছড়িয়ে পড়লো চারিদিকে। রফিক সাহেবের ঘরে এলো এক ফুটফুটে কন্যা সন্তান। তিনি তার মেয়েকে কোলে তুলে নিয়ে তার স্ত্রী কে বলতে লাগলেন আমাগো মাইয়া দেখতে তো মা শা আল্লাহ অনেক সুন্দর হইছে। একদিন দেইখো এই মাইয়া আমাগো অনেক সুনাম ছড়াইবো।মেয়ে দেখতে সুন্দর ছিলো বলে তিনি মেয়ের নাম রাখলেন “সুমাইয়া”।

এদিক হাটি হাটি পা পা করতে করতে সুমাইয়া ধীরে ধীরে বড় হতে লাগলো।এক পর্যায়ে তাকে গ্রামের এক প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করে দেয়া হলো।এদিকে সুমাইয়াও ভালো রেজাল্টের মাধ্যমে স্যারদের আশার আলো জাগিয়ে তুললো।আর সুমাইয়া ছিল তার স্কুলের সবার থেকে আলাদা ও ভদ্র একটি মেয়ে।

দিনটি ছিলো “বুধবার”।২০১২ সাল!সুমাইয়া তখন পঞ্চম শ্রেণির একজন ছাত্রী। দেখতে দেখতে তাদের পঞ্চম শ্রেণির বৃত্তি পরীক্ষা নিকটে চলে এলো।স্কুলের স্যারদেরও একটা আশা ছিলো সুমাইয়া তাদের স্কুলের মান রাখবে।যেই কথা সেই কাজ।যথারীতি সময়ে রেজাল্ট প্রকাশিত হলে সুমাইয়া বোর্ড স্ট্যান্ড করে এবং বৃত্তি পায়।কিন্তু তার বাবা ছিলো গরীব।মেয়ের লেখাপড়ায় এতো আগ্রহ দেখে তিনি শত অভাবের পরেও মেয়েকে ভর্তি করালেন গন্জের একটি নাম করা প্রতিষ্ঠানে।

একাধারে সুমাইয়া ৮ম শ্রেণী পাশ করলো বোর্ড স্ট্যান্ড ও বৃত্তির মাধ্যমে। এরপর সে মাধ্যমিকের জন্য নবম শ্রেণিতে ভর্তি হলো এবং দশম শ্রেণি শেষ করে এবার সে একজন এস.এস.সি পরীক্ষার্থী।আবারো সেই কাঙ্ক্ষিত ফলাফল করে সে কলেজে ভর্তি হলো।কিন্তু কলেজে পড়ানোর মতো সামর্থ্য তার বাবার ছিল না।পরবর্তীতে তার এত সুন্দর রেজাল্ট ও আগ্রহ দেখে তার এলাকার চেয়ারম্যান তার দিকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন এবং সে অত্যন্ত মনোযোগের সাথে পড়াশোনা করতে লাগলো।কেননা তার লক্ষ্য একটাই তাকে মানুষ হতে হবে।বাবা মায়ের কষ্ট দূর করতে হবে।দেখতে দেখতে প্রায় তার কলেজ পর্যায় ও শেষ হয়ে আসতে লাগলো।ঠিক সে সময় তার দ্বায়িত্ব নেয়া সেই এলাকার চেয়ারম্যান হঠাৎ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান।এবার সুমাইয়া বুঝতে পারলো হয়তো তার পড়াশোনা এখানেই থেমে যাবে।ভেঙে যাবে তার এতদিনের স্বপ্ন। কিন্তু তার এইচএসসির ফলাফল ছিল অসাধারণ। যার কারণে ক্যারিয়ার বাজ কোচিং এসে দ্বারায় তার পাশে।তারা বাড়িয়ে দেয় তাদের সহযোগিতার হাত।

সুমাইয়া এখন স্বপ্ন দেখছে “ঢাকা ভার্সিটির” মতে বড় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার।তাই সে কঠোর পরিশ্রম শুরু করে দেয়।সে যে এক হতদরিদ্র পরিবারের সন্তান সে কথাটি তাকে আরও সামনের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।তাকে সফল হতেই হবে।

অবশেষে সেই দিনটি এলো।তার ভর্তি পরীক্ষার রেজাল্ট আসলো।সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে পড়ার সুযোগ পেয়েছে।কিন্তু তার চোখেমুখে তবু যেন হতাশার চাহনি।কেননা সে বাবা মায়ের হতদরিদ্র পরিবারের সন্তান। তাদের পক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো বড় প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করানোর মতো সামর্থ্য নেই।

ঠিক এমন সময় একজন লোক এসে রফিক সাহেবের বাড়ির সামনে তাকে ডাকতে লাগলো।তিনি বললেন, যে তার বাবা মারা যাওয়ার সময় তার নামে দশ লক্ষ টাকার একটি চেক রেখে যান। মুহূর্তের মধ্যে যেন আনন্দের সীমা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়লো।তিনি আর বিন্দুমাত্র দেরি না করে পরের দিনেই রওয়ানা হলেন মেয়েকে নিয়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে।

এর পর মেয়েকে ভর্তি করালেন তার স্বপ্নের বিশ্ববিদ্যালয়ে।ভর্তির সময় তার বাবা একটি কথা বলেছিলেন যে ‘মারে সবসময় মনে রাখিস আমরা হতদরিদ্র পরিবারের মানুষ। বড়লোকদের মতো করে চললে আমাগো হইবো না। তুই মনোযোগ দিয়া লেখাপড়া করোস আর টাকা পয়সা নিয়া চিন্তা করোস না। তুই শুধু মন দিয়া পড়! তোরে তোর স্বপ্ন পূরণ করতে হইবো।

বাবার এ কথা শুনে মেয়ে বলে আইচ্ছা বাজান।তুমি চিন্তা কইরো না ।গরীব বলে কী আমরা স্বপ্ন দেখতে পাবো না তা কি হয়।মেয়ের এ কথা শুনে তার বাবা আরও বেশি খুশি হন। এরপর তার বাবা সেখান থেকে গ্রামে চলে আসেন।

বেশ কিছুদিন ভার্সিটির ক্লাস হওয়ার পর হঠাৎ করেই সুমাইয়া অবাক হন।সে দেখতে পায় তার ছোট বেলার বন্ধু সোহান ও সেই একই ভার্সিটিতে পড়ছে।যদিও তাদের ডিপার্টমেন্ট আলাদা।

লিখুন প্রতিধ্বনিতেলিখুন প্রতিধ্বনিতে

এভাবে চলতে লাগলো তাদের বাকি সেমিষ্টারগুলো।এবার তারা চলে এসেছে একেবারে শেষ পর্যায়ে। এখন তাদের শুধু ফাইনাল রেজাল্ট হওয়া বাকি। রেজাল্ট হয়ে গেল।সুমাইয়া আাবারো ডিপার্টমেন্ট ফাস্ট হয়ে তার ভার্সিটি জীবন শেষ করলো।সোহানও ৩..৯০ পেয়ে তার ডিপার্টমেন্ট শেষ করলো।আর সোহান ছোটবেলা থেকে সুমাইয়া কে অনেক বেশি ভালোবাস তো।কখনও সে তাকে বলে নি।কিন্তু এখন বললে সমস্যা কী?এখন তো তারা গ্রাজুয়েট সম্পন্ন। যেমন কথা তেমন কাজ।তারা দুজনে পারিবারিক সম্মতিতে বিয়ে করে। ভালোই চলছিল তাদের দাম্পত্য জীবন।তাদের একটি সন্তানও ছিলো।তার বয়ষ হবে বছর পাচেক।

কিন্তু একদিন হঠাৎই নেমে আসে সুমাইয়া সোহানের জীবনে এক দুধর্ষ মুহুর্ত। একদিন তারা ঘুরতে বের হয়েছিল।পথিমধ্যে তারা সড়ক দূর্ঘটার শিকার হোন।সুমাইয়া ও তার ছেলেকে বাচানো গেলেও বাচানো যায়নি সোহান কে।ঘটনাস্থলেই সে মৃত্যুবরণ করেন এবং সুমাইয়াকে অজ্ঞান ওবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়।কিন্তু সুমাইয়া যখন একটু সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে আসলেন তখন ঘটে গেল আরেক কাহিনি। সুমাইয়া তার মাথায় অনেক আঘাত পেয়ে স্মৃতি শক্তি পুরো হারিয়ে ফেলে।তার পরিবার যেন মুহুর্তেই দিশেহারা হয়ে যায়।একদিকে তাদের জামাই হারানোর শোক অন্যদিকে তাদের মেয়ে স্মৃতিশক্তি হারিয়ে ফেলে।মুহুর্তের মধ্যে যেন ধ্বংস হয়ে যায় একটি পরিবারের সকল স্বপ্ন।আর গ্রামবাসী হারিয়ে ফেলে তাদের গ্রামের সেই সহজ সরল মেয়েটির সকল স্বপ্ন কে।

Previous articleসূচনা
Next articleবৃহস্পতির রক্ততরঙ্গ
প্রতিধ্বনি
প্রতিধ্বনি একটি অনলাইন ম্যাগাজিন। শিল্প,সাহিত্য,রাজনীতি,অর্থনীতি,ইতিহাস ঐতিহ্য সহ নানা বিষয়ে বিভিন্ন প্রজন্ম কী ভাবছে তা এখানে প্রকাশ করা হয়। নবীন প্রবীণ লেখকদের কাছে প্রতিধ্বনি একটি দারুণ প্ল্যাটফর্ম রুপে আবির্ভূত হয়েছে। সব বয়সী লেখক ও পাঠকদের জন্য নানা ভাবে প্রতিধ্বনি প্রতিনিয়ত কাজ করে চলেছে। অনেক প্রতিভাবান লেখক আড়ালেই থেকে যায় তাদের লেখা প্রকাশের প্ল্যাটফর্মের অভাবে। আমরা সেই সব প্রতিভাবান লেখকদের লেখা সবার সামনে তুলে ধরতে চাই। আমরা চাই ন্যায়সঙ্গত প্রতিটি বিষয় দ্বিধাহীনচিত্ত্বে তুলে ধরতে। আপনিও যদি একজন সাহসী কলম সৈনিক হয়ে থাকেন তবে আপনাকে স্বাগতম। প্রতিধ্বনিতে যুক্ত হয়ে আওয়াজ তুলুন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here