সুখের সন্ধানে

0
207

সুমাইয়া আক্তার 

পূর্ব দিকে কুয়াশার পর্দা সরিয়ে সূর্যটা মাথা তোলে ঠিক যখন গ্রামের মসজিদ থেকে ফজরের আজান ভেসে আসে। সেই আলোয় চোখ মেলে সাকিব। শীতের সকালের মাটির ঘরে কাঁথা মুড়ি দিয়ে গা ঢেকে রাখা ছেলেটার নাম কামরুল ইসলাম সাকিব, সবাই ডাকে সাকিব।

গ্রামটা ছিল কক্সবাজার জেলার এক কোণায়—সিঁদুর রঙের মাটির পথ, দুই পাশে ধানের মাঠ, মাঝে মাঝে কিছু খেজুর গাছ। তাদের বাড়ির পাশে ছিল এক পুকুর, যেখানে সাকিব আর তার ছোট বোন রুহি সকাল-সন্ধ্যা মাছ ধরার নাম করে সাঁতার কেটে বেড়াত।

সাকিবেরর বাবা ছিলেন একজন ব্যবসায়ী —গম্ভীর, কঠোর, কিন্তু ভেতরে স্নেহময়। মা ছিলেন ধৈর্যশীলা, শান্ত স্বভাবের। তার কাছে ছিলো এক অন্যরকম প্রশান্তি। মায়ের কোলটা ছিল যেন নিরাপদ বন্দর—যেখানে ঝড়ও শান্ত হয়ে যেত।

সাকিবের সবচেয়ে প্রিয় সময় ছিল ফজরের পর মসজিদে যাওয়া। ছোট বয়সে সে বাবার হাত ধরে যেত, নামাজ পড়া হতো না সব সময়, কিন্তু ইমামের কণ্ঠে যখন সূরা “আর-রাহমান” তিলাওয়াত হতো, সাকিবের গা শিউরে উঠত। সে বুঝত না সব শব্দ, তবুও মন ভরে যেত।

স্কুল শেষে বিকেলে তারা বন্ধুদের সঙ্গে কাবাডি খেলত, কখনো গাছের ডালে চড়ে পাখির বাসা খুঁজত। সন্ধ্যায় যখন মসজিদের মাইকে কুরআনের তিলাওয়াত চলত, গ্রামের চারদিক নীরব হয়ে যেত। তখন সাকিবের মনেও একটা নীরবতা নামত, অজানা শান্তি।

কিন্তু সেই শান্তির জীবন চিরস্থায়ী ছিল না।

একদিন বাবা বললেন,
— “তুই ভালো ফল করছিস রেজাল্টে। তোকে শহরে পাঠাতে হবে, বড় হবি। গ্রামের মাটিতে পড়ে থাকলে চলবে না।”

সাকিবের বুক কেঁপে উঠল। শহর? ঢাকা? সে কখনো গরুর হাটের বাইরে কোথাও যায়নি! কিন্তু মা বললেন,
— “তুই যাস। আল্লাহর নাম নিয়ে যা। এই মাটি একদিন তোকে আবার ফিরে আনবে।”

সেদিন রাতে, নিজের খাটে শুয়ে সাকিবের চোখ বন্ধ করে ভাবল—এই শান্তি, এই পুকুর, মায়ের হাতের গরম রুটি… এগুলোর থেকে দূরে গিয়ে কি সত্যিই সুখ পাওয়া যাবে?

সে জানত না, তার জীবনের সবচেয়ে বড় যুদ্ধটা কেবল শুরু হতে যাচ্ছে।
ঢাকা শহরের প্রথম সকালটা ছিল সাকিবের কাছে যেন অন্য গ্রহে পা রাখা। মানুষের স্রোত, বাসের হর্ন, পথচলতি লোকের মুখে অজানা তাড়া—সব মিলিয়ে এক অস্থিরতা। স্টেশন থেকে বের হতেই সিএনজিওয়ালারা ঘিরে ধরল, কে কই যাবে, কত টাকা দিবে—এই চিৎকারে সাকিব কিছুক্ষণ বোবা হয়ে রইল।

তাকে নিয়ে এল তার বড় ভাই। ভর্তি হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগে। হোস্টেলও পেয়েছে—তবে জায়গাটা নামকাওয়াস্তে। ছোট একটা ঘর, চারজন ছাত্র, জানালা নেই, আলো ঢুকার রাস্তা নেই—শুধু গায়ের গন্ধ আর মোবাইল স্ক্রিনের আলো।

প্রথম রাতেই সে বুঝল, এই শহরের ঘুম খুব হালকা, আর স্বপ্ন অনেক ভারী।

তার রুমমেটরা একেকজন একেক চরিত্র। মেহেদী নামের ছেলেটা সারাদিন PUBG খেলে, আর রাতে হেডফোনে গান শুনে ঘুমায়। অন্যজন, রনি, রাত তিনটায়ও Netflix দেখে। কারো মাথায় ফজরের নামাজ, কুরআন পড়া এসবের ধারেকাছেও নেই। বরং যারা এসব করে, তাদের নিয়ে রসিকতা চলে।

সাকিব প্রথম কিছুদিন চেষ্টা করেছিল রাতের বেলা আলাদা ঘরে গিয়ে নামাজ পড়তে। কিন্তু একদিন রনি বলে বসলো—
— “এই ভাই, আপনি রাতে নামাজ পড়তে গিয়ে জ্বিন ডাকেন নাকি? ঘুম ভাঙে তো!”

সাকিব কিছু বলেনি, শুধু চুপচাপ নিজের বিছানায় ফিরে গিয়েছিল।

দিনের পর দিন কেটে যেতে লাগল। ক্লাসের ফাঁকে সে শুধু জানালা দিয়ে গাছ খোঁজার চেষ্টা করত—কোন গাছে পাখি বসেছে কি না। কিন্তু এই শহরে জানালার বাইরেও দেয়াল।

রাত হলে সাকিবের খুব মায়ের কথা মনে পড়ত। সেই পুকুর পাড়, সেই মসজিদের আজান, সেই শান্ত বিকেল… সবকিছু যেন স্বপ্ন হয়ে গেছে। এখানে মানুষ হাসে, কিন্তু সেই হাসির ভিতর দুঃখ থাকে। এখানে বন্ধুরা থাকে, কিন্তু কেউ মন বোঝে না।

ধীরে ধীরে সাকিব বুঝতে লাগল—এই শহরে মানুষ সফল হতে পারে, নাম কামাতে পারে, কিন্তু ভেতরের শান্তিটা হয়ত তারা কোথাও হারিয়ে ফেলেছে।

কিন্তু প্রশ্ন থেকে গেল—
“আসল শান্তিটা কোথায়? কোথায় গেলে আবার পুকুরপাড়ের সন্ধ্যাটা ফিরে আসবে?”
চার বছর পর—
সাকিব এখন একজন “সফল তরুণ”। ঢাকা শহরের এক নামকরা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরি পেয়েছে। মাসে মোটা বেতন, এসি অফিস, লাঞ্চ সুবিধা, কর্পোরেট পোশাক—সবই আছে। ফেসবুক প্রোফাইলে পেশাদার হাসি দিয়ে আপলোড করা ছবি, LinkedIn-এ প্রশংসায় ভরা পোস্ট—সব মিলে সাকিবের চারপাশে একটা “স্মার্ট জীবন”।

কিন্তু ওইসব ছবির পেছনে ছিল এক ক্লান্ত চোখ, শুকিয়ে যাওয়া মুখ আর নিঃশব্দ দীর্ঘশ্বাস।

প্রতিদিন সকাল ৯টায় অফিস ঢুকে রাত ৮টা পর্যন্ত কম্পিউটারের সামনে বসে থাকা—এর নাম ‘লাইফ’। বসের মন ভালো না থাকলে গলার স্বর চড়ে যায়। কলিগদের মধ্যে প্রতিযোগিতা, পরনিন্দা, একে অন্যকে পিছনে ফেলে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা। কেউ কাউকে বিশ্বাস করে না, সবাই কেমন যেন মুখোশ পরে থাকে।

সাকিবের কাজের দক্ষতা ভালো ছিল। তাই সবার কাছে সে ‘পারফর্মার’। কিন্তু অফিস থেকে বেরিয়ে সে যখন বাসে বসে জানালার দিকে তাকিয়ে থাকে, তার মনে হয়—
“এই সাফল্য কি সত্যিই আমার চাওয়া ছিল?”

বাসায় ফিরে একটা ছোট ফ্ল্যাটে ঢোকে সে—নীরবতা আর মোবাইল স্ক্রলের মাঝে সময় কেটে যায়। রান্নার সময় নেই, ফুড ডেলিভারি অ্যাপই বন্ধু। রাত ২টায় ঘুমাতে যায়, কিন্তু ঘুম আসে না। চোখ বন্ধ করলেই মনের মধ্যে প্রশ্ন ভেসে ওঠে—
“আমি কোথায় যাচ্ছি? কেন এত অস্থির লাগছে?”

কখনো সে গুগলে খোঁজে:
“ডিপ্রেশন কি?”

“কীভাবে ঘুম আসবে?”

“কীভাবে জীবনে শান্তি আনা যায়?”

কিন্তু উত্তরগুলো ছিল কৃত্রিম—“মিউজিক শোনো”, “মেডিটেশন করো”, “জিমে যাও”।

তবে এক রাতে হঠাৎ একটা ফলাফল তার চোখে পড়ে যায়—
“Quranic verses for inner peace.”

সে ক্লিক করে না, শুধু স্ক্রিনের দিকে চেয়ে থাকে কিছুক্ষণ।

পরদিন অফিস থেকে বেরিয়ে হেঁটে বাসায় ফিরছিল সাকিব। হঠাৎ রাস্তার পাশে ছোট একটা বুকশপ চোখে পড়ে—উপর লেখা “ইসলামি বইয়ের লাইব্রেরি”। সে দাঁড়ায়। ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে পরিচিত মুখ—
সাদিক।

পুরনো বন্ধু, বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসমেট। আগে ফেসবুকে একসাথে ছবি তুলত, এখন দাঁড়িয়ে আছে পাঞ্জাবি আর টুপি পরে। শান্ত চোখ, হাসিমুখ।

— “তুই সাকিব না?”
— “আরে সাদিক! তুই এখানে?”
— “হ্যাঁ ভাই, এখন এখানেই কাজ করি। বই পড়ি, বিক্রি করি। সময় পেলে দোয়া করি।”

সাকিব একটু হেসে বলল,
— “বাহ! লাইফ সেট করে ফেলছিস মনে হয়!”

সাদিক হেসে বলল,
— “লাইফ তো আগে খুব সেট ছিল বাইরে, কিন্তু ভেতরটা ফাঁপা ছিল। এখন হয়তো উল্টো। বাইরেটা ছোট, কিন্তু ভেতরটা শান্ত।”

এই কথাটা সাকিবের মনে গেঁথে গেল। সে কিছু বলল না। শুধু মাথা নেড়ে চলে গেল।

তবে সেদিন রাতে ঘুমানোর আগে সে প্রথমবার “Quran for peace” বলে ইউটিউবে সার্চ করল।
রাত ২টা। বালিশের পাশে মোবাইল স্ক্রিন জ্বলছে। ইউটিউবের ভিডিও চলছিল—“Qur’an Recitation for Peace”।
একজন তরুণ ক্বারির কণ্ঠে সূরা “আল-দুহা” তিলাওয়াত হচ্ছে।

وَالضُّحَىٰ – “সকালবেলার শপথ”

وَاللَّيْلِ إِذَا سَجَىٰ – “এবং রাত্রির শপথ যখন তা স্তব্ধ হয়ে যায়”

مَا وَدَّعَكَ رَبُّكَ وَمَا قَلَىٰ – “আপনার প্রতিপালক আপনাকে পরিত্যাগ করেননি এবং ঘৃণা করেননি।”

সাকিবের চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরছিল, কিন্তু সে জানত না কেন। শুধু মনে হচ্ছিল—এই আয়াতগুলো ঠিক তাকে নিয়েই যেন বলা। এই অস্থির রাত্রি, এই নিঃসঙ্গতা, এই অভিমান—সব যেন আল্লাহ জানেন। যেন আল্লাহ বলছেন,
“আমি আছি। আমি জানি। আমি তোকে ছাড়িনি।”

পরদিন ছুটির দিন ছিল। সাকিব আবার গেল সেই ইসলামি লাইব্রেরিতে। সাদিক তাকিয়ে হেসে বললো;
“তোকে তো মনে হয় রাতটা একটু অন্যরকম কেটেছে, তাই না?”
সাকিব কিছু না বলে মাথা নিচু করল।

“বসে আয়,” সাদিক বলল।
— “তুই কি কখনো ভেবেছিস, আমরা সকাল-বিকেল ছুটে চলি, অথচ আমাদের সৃষ্টি কেন, কে আমাদের বানিয়েছে—সেটা নিয়ে একবারও থেমে ভাবি না?”

সাকিব আস্তে করে বলল,
— “আমি ভেবেছি, কিন্তু ভয় পেয়েছি… যদি কিছু বদলাতে হয়?”

— “ভয়টা স্বাভাবিক,” সাদিক বলল, “কারণ সত্যি মানুষকে বদলায়। তবে সেই বদল শান্তির দিকে নিয়ে যায়।”

সেদিন থেকে সাকিবের দিনচক্র একটু একটু করে বদলাতে শুরু করল। সে দিনে ১০ মিনিট কুরআনের অনুবাদ পড়ত। সূরা ফাতিহার প্রতিটি শব্দ যেন তার মনকে ধুয়ে দিত।

সে নামাজ শুরু করল। প্রথম প্রথম খুব কঠিন লাগত। মাঝে মাঝে হাল ছেড়ে দিত। কিন্তু এক রাতে সিজদায় গিয়ে সে ফুপিয়ে কাঁদল। চোখ বন্ধ করে শুধু বলল—
“হে আল্লাহ, আমি তোমাকে হারিয়ে ফেলেছি। আবার খুঁজে পাই যেন।”

অফিসের কেউ কেউ টের পেল। একদিন লাঞ্চ টাইমে কলিগ রাহাত ঠাট্টা করে বলল,
— “ভাই সাকিব, তুই তো দেখি হুজুর হয়ে যাচ্ছিস!”

সাকিব একটু হেসে বলল,
“হয়তো Becoming human again!”

সবাই হেসে উঠল, কিন্তু সাকিবের মুখে এক অদ্ভুত শান্তি ছিল।
একদিন সন্ধ্যায় অফিস শেষে সাকিব হেঁটে বাসায় ফিরছিল। হঠাৎ মনে হলো, চারপাশে খুব নিঃশব্দ। গাড়ির শব্দও যেন কমে গেছে। তার ভেতরটা ভারমুক্ত লাগছিল।
মনে হচ্ছিল, দীর্ঘদিন পর…
“আমি ঠিক রাস্তার ওপর আছি।”
নামাজ পড়া শুরু করার পর সাকিবের জীবন বদলাতে শুরু করল। কিন্তু বদল সবসময় সহজ হয় না। কখনো ঘুম ভেঙে না, কখনো অফিসের কাজের চাপ, কখনো নিজের ইচ্ছার টানাপোড়েন—সব মিলিয়ে প্রতিদিন যেন নিজেকে নতুন করে তৈরি করা।

সাকিব নিজের একটা ডায়েরি চালু করল। নাম দিল—”ফেরার পথ”। প্রতিদিন রাতে সে কয়েকটা লাইন লিখত—নিজের অনুভব, দুর্বলতা, আশা।

একদিন লিখল—

“আজ মাগরিবের নামাজে কেঁদে ফেললাম। কোনো কারণ ছিল না। মনে হলো আল্লাহর সামনে দাঁড়াতে পেরেছি বহুদিন পর।”

আরেকদিন লিখল—

“আজ ফজরের নামাজ মিস হয়ে গেল। নিজেকে ঘৃণা করছি। তবে হার মানব না।”

সে বুঝতে শিখল—দীন শুধু কিছু নিয়ম মানার নাম না, এটা নিজের ভেতরের জগতে ফিরে আসার নাম। নিজের অহংকার, অলসতা, ঈর্ষা, কুপ্রবৃত্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ।

এই রূপান্তরের পথে কিছু পুরনো বন্ধু খোঁচা দিতে শুরু করল।
“তুই আগে যেমন ছিলি, মজা করতিস… এখন কেমন হইছিস রে ভাই! একটু বেশি বেশি হয়ে যাচ্ছিস না?”

সাকিব শুনত, কিন্তু মুখে হাসি রাখত। একদিন অফিসে এক কলিগ মদ খেতে দাওয়াত দিল।সাকিব ধন্যবাদ দিয়ে না বলে দিল। তখন সে বুঝলএই ফেরাটা শুধু নিজের সঙ্গে নয়, সমাজের প্রবাহের বিরুদ্ধেও যুদ্ধ।

এক রাতে সাকিব খুবই ভেঙে পড়েছিল। সব ভালো করেও তার মনটা অস্থির ছিল। সে ওজু করে সিজদায় গেল। মেঝেতে কপাল রাখতেই চোখ দিয়ে অঝোরে পানি পড়তে লাগল।

সে শুধু বলছিল—
“হে আল্লাহ, আমাকে ক্ষমা করে দাও। আমি তোমার কাছে ফিরে এসেছি। আমাকে ছেড়ে দিও না।”

লিখুন প্রতিধ্বনিতেলিখুন প্রতিধ্বনিতে

সে রাতটা ছিল তার জীবনের প্রথম পূর্ণ সিজদা—যেখানে তার কপাল নয়, তার মনটা ছিল মাটিতে।

এরপর দিনগুলো বদলাতে শুরু করল—মনটা শান্ত, রাতের ঘুম গভীর, প্রতিদিনের কাজ অর্থপূর্ণ মনে হতো। সে অফিসেও তার দক্ষতায় আরও ভালো করছিল, কিন্তু এখন আর “সাফল্য” তার মানদণ্ড ছিল না।

সাকিব ধীরে ধীরে এমন এক জায়গায় পৌঁছাল, যেখানে সে বুঝল—

“শান্তি বাহিরে খুঁজেছি এতদিন, অথচ সেটা তো আমার রূহের ভেতরেই ছিল—যখন সে আল্লাহর কাছে মাথা নত করে।”
এখন রাফির দিন শুরু হয় ফজরের নামাজ দিয়ে। তার ছোট রুমে জানালা দিয়ে সূর্যের আলো ঢোকে, আর তাতে কুরআনের আয়াতের প্রতিধ্বনি মিশে যায়। ঘুমভাঙা শহরের ভেতরে সে যেন এক নতুন জগত গড়ে তুলেছে—যেখানে বাহ্যিক কোলাহল আছে, কিন্তু তার ভেতরে শান্ত সমুদ্র।

সে আর আগের মত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দৌড়ায় না, বরং প্রতিটি দিনকে গ্রহণ করে যেন একটা আমানত।

চাকরিতে পদোন্নতি পাওয়ার সুযোগ এল, কিন্তু সাকিব বুঝল—সেটা পেতে গেলে কিছু অনৈতিক কাজে সম্মতি দিতে হবে। আগে হলে হয়তো দ্বিধা করত, কিন্তু এবার সে নির্দ্বিধায় ‘না’ বলল।

কলিগ জিজ্ঞেস করল,
“তুই এত বড় অফার ছাড়লি? রিস্ক নিয়ে ফেললি না?”
সাকিব মাথা নিচু করে বলল,
“আমি কাউকে সন্তুষ্ট করার জন্য কাজ করি না, শুধু আমার রবের সন্তুষ্টি চাই।”

তখন সে বুঝল—তাওয়াক্কুল মানে রিস্ক না নেওয়া নয়, বরং আল্লাহর উপর নির্ভর করে সাহসী হওয়া।

একদিন সাকিব তার পুরনো ফেসবুক প্রোফাইল খুলল। পুরনো ছবি, পার্টির পোস্ট, অনর্থক হাসি—সবকিছু দেখে তার মনে হলো,
“এই লোকটা আমি ছিলাম? যার চোখে এত শূন্যতা ছিল?”

সে ছবিগুলো ডিলিট করল না। রেখে দিল। কারণ সে চায়, ভবিষ্যতে যেন ভুলে না যায়—আল্লাহ কীভাবে তাকে ফেরাল।

একদিন গ্রামের বাড়ি গেল। মায়ের সঙ্গে বসে পুকুরপাড়ে চা খেল। মা বলল
“তোর মুখটা এখন অনেক শান্ত লাগে, বাবা।”

সাকিব শুধু হাসল। চুপচাপ পুকুরের জলে তাকিয়ে থাকল। সেই পুরনো সন্ধ্যার পাখির ডাক, আজানের সুর—সবকিছু যেন এখন আরও গভীর, আরও জীবন্ত লাগছে।

এক রাতে, সিজদায় পড়ে সাকিব শুধু বলছিল—
“হে আল্লাহ, তুমি আমাকে ফিরিয়ে এনেছো, এখন কখনো হারাতে দিও না।”

তার কপাল ঠেকানো ছিল মাটিতে, কিন্তু মন ছিল আকাশে।
সেই রাতে সে জানত—

চাকরি থাকতে পারে, না-ও থাকতে পারে।
বন্ধু থাকতে পারে, না-ও থাকতে পারে।
ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হতে পারে।
কিন্তু তার রব আছেন। তার শান্তি আছে।

শান্তি পাওয়া যায় না খুঁজে—শান্তি পাওয়া যায় যখন আপনি নিজেকে আল্লাহর হাতে তুলে দেন।”

Previous articleজুলাইয়ের স্মৃতিমাখা দিনগুলো
Next articleসুইসাইডের পরের গল্প 
প্রতিধ্বনি
প্রতিধ্বনি একটি অনলাইন ম্যাগাজিন। শিল্প,সাহিত্য,রাজনীতি,অর্থনীতি,ইতিহাস ঐতিহ্য সহ নানা বিষয়ে বিভিন্ন প্রজন্ম কী ভাবছে তা এখানে প্রকাশ করা হয়। নবীন প্রবীণ লেখকদের কাছে প্রতিধ্বনি একটি দারুণ প্ল্যাটফর্ম রুপে আবির্ভূত হয়েছে। সব বয়সী লেখক ও পাঠকদের জন্য নানা ভাবে প্রতিধ্বনি প্রতিনিয়ত কাজ করে চলেছে। অনেক প্রতিভাবান লেখক আড়ালেই থেকে যায় তাদের লেখা প্রকাশের প্ল্যাটফর্মের অভাবে। আমরা সেই সব প্রতিভাবান লেখকদের লেখা সবার সামনে তুলে ধরতে চাই। আমরা চাই ন্যায়সঙ্গত প্রতিটি বিষয় দ্বিধাহীনচিত্ত্বে তুলে ধরতে। আপনিও যদি একজন সাহসী কলম সৈনিক হয়ে থাকেন তবে আপনাকে স্বাগতম। প্রতিধ্বনিতে যুক্ত হয়ে আওয়াজ তুলুন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here