মুহিব্বুল্লাহ কাফি
তমিজ খাটের কোণে আনমনে বসে আছে। চুপচাপ। দুতিন সপ্তাহ যাবত মনটা ভাল নেই তার। কালমেঘ জমে আছে তার মনের উঠোনে। কিন্তু গেল দুদিন ধরে যারপরনাই মন খারাপ তমিজের। দুদিন আগে যখন তমিজকে কেদারা থেকে নামিয়ে এক চড় বসিয়ে দিলেন শফিউদ্দিন সাহেব তখন থেকে।
তমিজ নাফিজাকে এসএসসি পরীক্ষার হল থেকে চেনে। তারা দুজন একসঙ্গে বসে পরীক্ষা দিল এইতো গেল বছর। তখন থেকেই হাই-হ্যালো হতে হতে বন্ধুত্বের হাত বাড়ায় তমিজ। নাফিজাও হেসেখেলে হাত বাড়ায় তমিজের দিকে। ব্যস, এভাবেই ধীরে ধীরে সামনাসামনি কথা বলার পাশাপাশি মেসেঞ্জার হয়ে ইমুতেও কথা-চ্যাট হয় তাদের প্রায় দিন। এরিমধ্যে তমিজ মন দিয়ে বসে নাফিজাকে। কিন্তু বলার সাহস যোগান দিতে পারছে না সে।
একটু-আধটু যখনই কথা হয় অন্যসব কথা বললেও ভালোবাসার কথা বলতে পারে না এক ফোঁটাও। কিংবা একবর্ণও লেখতে সাহস করে না মেসেঞ্জার-ইমুর চ্যাটে। বলবে তো দূরের কথা, নাফিজাকে বলার কথা মনে আনলেই ঘেমে একাকার হয়ে ওঠে তমিজ। যেন এসির নিচেও কাঠফাটা রোদে সে সিদ্ধ। তমিজ বলতে গিয়েও থেমে যায় এভেবে, নাফিজা কি তাকে ভালোবাসে? না-কি বন্ধু হিসেবেই দেখে!
কোনো জিনিস চেপে রাখতে নেই। বলে ফেলা ভাল। তাতে নিজেকে হালকা মনে হয়। না হয় বুকের উপর এক বিশাল পাথর বসে থাকার মত কষ্ট হয়। তমিজের তেমন কষ্টই হচ্ছে। তার বুকে এক বিশাল পাথর কে যেন বসিয়ে রেখেছে। তমিজ ভেবে পায় না কী করবে সে। নাফিজাকে তো বলতেও পারছে না। তাহলে কি বন্ধুমহলে শেয়ার করা যায়; এ কথা ভেবেও মাথা নেড়ে বলে না,না। বন্ধুদের বলা যাবে না। তারা আমার ব্যাপারটা নিয়ে হাসাহাসি করবে। তমিজ বন্ধুমহলে হাসির পাত্র হতে চায় না।
তমিজ কাউকেও বলতে পারছে না তার মনের কথা। কিন্তু চেপেও রাখতে পারছে না। খুব কষ্ট হচ্ছে তার। শেষমেশ তমিজের বড়বোন সুমাকে বলেই বসল। সুমা তাকে এ বলে সান্ত্বনা দিল, আগে তুই মাস্টার্স কমপ্লিট কর। পরে ওসব দেখা যাবে। মন কি আর মাস্টার্স মানে! তমিজ সুমার কথা অতটা আমলে নেয়নি। তবে এভেবে তার ভাল লাগছে যে,যাক! বলতে তো পারলাম মনের কথাগুলো কাউকে।
এভাবেই চার-পাঁচমাস তমিজ পার করে দিল মনের অলিন্দে বৃষ্টি নামার আশায়। কিন্তু তা আর হল কোথায়। মেঘ যেন বৃষ্টি হয়ে ঝরবেই না। তমিজ মনের কথা মনেই গেঁথে রাখল। কিন্তু হঠাৎ একদিন রাস্তায় চলার পথে থমকে দাঁড়ায় তমিজ। দেখে নাফিজার হাত ধরে একটা ছেলে তমিজের উল্টো দিকে হেঁটে আসছে। নাফিজা তমিজকে দেখে কাছে এসে দাঁড় করায় তার পাশের ছেলেটাকে।
নাফিজা ছেলেটাকে তমিজের দিকে আঙুল উঠিয়ে বলল, মাহবুব এ আমার বন্ধু তমিজউদ্দিন। শুধু বন্ধু বললে ভুল হবে। আমার খুব ভাল বন্ধু এবং গুডবয়।
আর এ মাহবুব। আমার কাজিন এবং ফিওনসি। আগামী মাসেই আমাদের বিয়ে। খুব শীগ্রই তুমি বিয়ের কার্ড পেয়ে যাবে। তমিজকে লক্ষ করে একগাল হেসে কথাগুলো বলল নাফিজা।
নাফিজার কথাগুলো শোনার পর যেন আকাশ ভেঙে পড়ল তমিজের মাথার ওপর। সে কিছুতেই প্রস্তুত ছিল না এ ধরনের কথা শোনার কিংবা এমন পরিস্থিতির কাঠগড়ায় দাঁড়াবার। তমিজের হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে আসল। তার ভেতর এক দমকা হাওয়া বইতে লাগল। যেন ভেঙে দিল তমিজের সাজানো প্রেমের বাগান।
আশা করি ভালই আছেন। আপনার সঙ্গে পরিচিত হয়ে ভালোই লাগল। তমিজের দিকে হাত বাড়িয়ে বলল মাহবুব ।
তমিজ ঘোর ভেঙে হ্যান্ডশেক করে ভাঙা গলায় বলে উঠল, হুম, ভাল আছি। আমারও ভালো লাগল আপনার সঙ্গে দেখা হয়ে।
আমাদের বিয়েতে আসবেন কিন্তু বলে চলে গেল মাহবুব নাফিজাকে নিয়ে।
কিন্তু ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইল তমিজ। যেন তার শোকে দাঁড়িয়ে রইল রাস্তার সব যানবাহন। থমকে দাঁড়াল বয়ে যাওয়া বাতাস। স্তম্ভিত হল পরিবেশ।
পানি গড়াগড়ি করছে তমিজের চোখে। পলক ফেলতেই ঝরে পড়ল তার অব্যক্ত ভালোবাসা অশ্রু হয়ে। সে কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না যে, নাফিজা তার হবে না। নাফিজাকে এতটাই ভালোবেসেছিল যে, তাকে ছাড়া অন্য কাউকে কল্পনাতে আনতে চায়নি তমিজ ঘুমের ঘরেও।
তমিজ বাসায় এসে অনেকক্ষণ বাথরুমে মুখ চেপে কান্না করল। তবু সে নিজকে প্রবোধ দিতে পারল না। তমিজ মানতেই চায়ছে না মাহবুব-নাফিজার বিয়ের ব্যাপারটা। তার মাথায় কিছুই খেলছে না। চোখমুখ লাল হয়ে গেল। সিন্ধান্তে উপনীত হতে পরছে না কী করবে সে! এক পর্যায়ে তমিজ স্থির করল, নাহ,সে আর থাকবে না। নাফিজাকে ছাড়া সে বাঁচবে না। সুইসাইড করবে তমিজ।
তমিজ রশি যোগাড় করে খাটে কেদারা বসিয়ে যেই ফ্যানে রশি বাঁধতে যাবে তখনই তার বাবা শফিউদ্দিন সাহেব কোনো এক কাজে তমিজের কামরায় ঢোকলেন।
তমিজ এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে, তার মাথায় মৃত্যু ছাড়া কিছুই কাজ করছিল না। তাই কামরার দরজা বন্ধ করতে তার মাথা বা চোখ কোনোটাই তাকে সাহায্য করেনি।
তমিজ একি করছিস! বলে দৌড়ে এসে তমিজকে কেদারা থেকে নামিয়ে এক চড় বসিয়ে দিলেন শফিউদ্দিন সাহেব। তমিজের বাবার হাঁক শুনতে পেয়ে অন্য কামরা থেকে ছুটে আসেন রহিমা বেগম তমিজের মা। সুমাও আসে দৌড়ে। সুমা তমিজের কাণ্ড দেখে নাফিজার কথা জানায় বাবাকে।
একটা মেয়ের জন্য তুই তোর বাবা-মার কথা ভুলে গেলি! একবারের জন্যও মনে আনলি না আমাদের কথা! আমরা এতটাই খারাপ তোর নজরে। এতটাই পর। এতো স্বার্থপর হলি কী করে! এত নিচ কী করে হলি তুই! এসব কথা বলে হাউমাউ করে কেঁদে দিলেন শফিউদ্দিন সাহেব। সঙ্গে রহিমা বেগম ও সুমা।
বাবামায়ের এ অবস্থা দেখে সংবিৎ ফিরে তমিজের। সেও দিল কেঁদে।
দুই
আসতে পারি?
তমিজ চোখ উঠিয়ে দেখতে পেল বাবার বয়সী একজন লোক দরজায় দাঁড়িয়ে অনুমতি চাচ্ছেন ভেতরে আসার। এর আগে লোকটিকে আদৌ দেখেছে কি-না তাও মনে আনতে পারছে না তমিজ। কিন্তু লোকটি তাদের ঘরে কী করে আসলেন! হয়তো বাবার পরিচিত। এসব ভেবে তমিজ বলে উঠল, জি, আসুন।
লোকটি ধীরে পায়ে তমিজের সামনে এসে কেদারা টেনে বসলেন। বললেন, আমি তোমার বাবার বন্ধু। তোমার বাবাই আমাকে তোমার সাথে কথা বলতে এনেছেন। আমি তোমার সাথে কিছুক্ষণ কথোপকথন করতে এসেছি।
তমিজ হ্যাঁ বা না কিছুই বলল না। মাথা নিচু করেই খাটে বসে রইল। তার এখন কথা বলতে ইচ্ছে করছে না তাও বলল না তমিজ।
আচ্ছা ঠিক আছে। তুমি না বললেও আমি বলি। তুমি শুনলেও চলবে। বললেন লোকটি।
তমিজ পূর্বানুগ। কথাও বলে না মাথাও উঠায় না।
আচ্ছা তোমার নাম কী?
তমিজ নিশ্চুপ।
তোমার নাম না বললে আমার নামও বলল না। আচ্ছা,মূল কথায় ফিরি। আমি আজ তোমাকে একটা গল্প শোনাতে এসেছি। তোমাকে শুনতে হবে।
ড.শওকত চৌধুরী একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। তার সহধর্মিণী ডা.জাহানারা চৌধুরী সরকারি হাসপাতালের একজন উচ্চপর্যায়ের ডাক্তার। তাদের দুই মেয়ে এক ছেলে। বড়ছেলে মাহফুজ আর্মিতে আছে। আর মেঝো মেয়ে আফিয়া কলেজে পড়ে,ছোট মেয়ে জান্নাত ক্লাস সিক্সে। গল্পটা ড.শওকত চৌধুরীর পরিবারকে ঘিরেই।
তমিজের মাঝে কোনো পরিবর্তন লক্ষ করলেন না লোকটি। তবু তিনি বলতে লাগলেন।
ড.শওকত চৌধুরী ও ডা.জাহানারা চৌধুরী তাদের তিন সন্তান নিয়ে বেশ সুখেই দিন কাটাচ্ছিলেন। অসুখ বা দুঃখ কী তা যেন ভুলেই গিয়ে ছিলেন চৌধুরী সাহেব। কিন্তু কার যেন বিষদৃষ্টি পড়ে যায় চৌধুরী সাহেবের অসম্ভব সুখী এ পরিবারের ওপর। ঝাঁক বেঁধে পেঁপে ধরা গাছে বিষদৃষ্টি পড়লে যেমন সব পেঁপে ঝরে পড়ে তেমনি ড.শওকত চৌধুরীর পরিবারে দুঃখও ধেয়ে আসে।
এক শনিবারের বিহানবেলা নাশতা খাওয়ার জন্য চৌধুরী সাহেব (যেহেতু তিন ছেলেমেয়ে ভিন্ন তিন কামরায় থাকে সেহেতু) ছেলেমেয়েদের কামরায় নক করতে লাগলেন। বড় ছেলে মাহফুজ ছোট মেয়ে জান্নাত কামরার দরজা খুললেও খুলেনি মেঝো মেয়ে আফিয়া। চৌধুরী সাহেব বেশ কয়েকবার দরজায় আওয়াজ করার পরও যখন ভেতর থেকে কোনো সাড়া পেলেন না তখন তিনি আতঙ্কিত হয়ে উঠেন। দুঃশ্চিতার এক রেখা এঁটে যায় তার কপালে। কারণ, অন্যদিন আফিয়া সবার আগে দরজা খোলে। কিন্তু আজ এত আওয়াজ দেবার পরও ভেতর থেকে কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছে না।
ড.শওকত চৌধুরী আর বড়ছেলে মাহফুজ দরজা ভাঙতে শুরু করলেন। আর ডা.জাহানারা চৌধুরী কান্না জুড়ে দিলেন। মার কান্না দেখে কাঁদে জন্নাতও।
চৌধুরী সাহেব দরজা খুলে যা দেখলেন তা কল্পনাতীত! এত সুখী সংসার তার। কোনোকিছুর অভাব রাখেননি কোনোদিন। তাই তিনি কল্পনাতেও আনতে পারেননি এমন দৃশ্যের মুখোমুখি হতে হবে তার কখনো।
এতটু বলে চুপ মেরে গেলেন তমিজের সামনে বসে থাকা লোকটি।
তমিজ এবার ঋজু হয়ে বসে। মাথা উঠিয়ে কৌতুহল চোখে উৎকর্ণ হয়ে লোকটির দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে, আফিয়া কি ফাঁসি নিয়েছে?
হুম, তুমি ঠিকই ধরেছ। তমিজের মাথায় বোলিয়ে লোকটি আবার বলতে শুরু করলেন। চৌধুরী সাহেব দরজা খুলে দেখলেন আফিয়া ঝুলে আছে। ফ্যানের সাথে। এ দৃশ্য দেখে এক চিৎকারে জাহানারা চৌধুরী বেহুঁশ হয়ে লুটিয়ে পড়েন ফ্লোরে।
এ দুর্ঘটনার মাসদেড়েক হবার পরও মানুষের ভোগান্তির রেশ কাটিয়ে উঠতে পারেনি ড.শওকত চৌধুরী সাহেবের পরিবার। পরিবারের একজনের এমন অপকর্মের কারণে এমনিতেই তারা শোকাহত তার ওপর মানুষের ভোগান্তির একশেষ। আফিয়ার সুইসাইডের কারণে চৌধুরী সাহেবের পরিবার পেরেশানিতে ভোগেন দীর্ঘদিন।
ড.শওকত চৌধুরী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হবার সুবাদে তাকে চেনার পাশাপাশি তার পরিবারের সব্বাইকে আশেপাশের সবাই চেনে।
ছোট মেয়ে জান্নাত প্রতিদিন স্কুল থেকে এসে মা-বাবাকে বলত, আমি আর স্কুলে যাব না। কারণ জিজ্ঞেস করলে বলত, ওর সহপাঠীরা ওর সাথে ঘেঁষে না। কথাও বলে না। কেউ বলে বসে, তোর বোন ফাঁসি নিছে তাই তুই আমাদের সাথে মিশবি না। আবার কেউ বলে, তুই আমার সাথে খেলবি না। তোরে দেখলে আমার ভয় লাগে। এর কারণে জান্নাত দীর্ঘ তিনমাস স্কুলে যায়নি।
বড়ছেলে সবসময় হাঁড়িমুখ করে থাকত। মনমরা করে রাখত। কিছুই বলত না। একদিন জাহানারা চৌধুরীর কোলে মাথা রেখে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল মাহফুজ। কান্না স্বরে বলল, মা আফিয়ার ব্যাপারটা আমাদের আর্মি ডিপার্টমেন্টে ছড়িয়ে গেছে। সবাই অন্য চোখে তাকায় আমার দিকে। কিছু বলতে চায়, হয়তো আমি কষ্ট পাব তাই বলে না। কিন্তু গতকাল একজন রসিকতা করে বলেই ফেলল,
মাহফুজ ঠিক করেছ কবে রশিতে ঝুলবে! তোমাদের তো আবার রশিতে ঝুলার অভ্যেস আছে।
মাহফুজের কথা শুনে জাহানারা চৌধুরীর চোখের কোণে মেঘ জমে গেল। কিন্তু ছেলের সামনে ঝরতে দেননি। লুকিয়ে রাখলেন চোখের পাতা দিয়ে। আর ছেলেকে প্রবোধ দিলেন।
জাহানারা চৌধুরী একজন ডাক্তার হওয়ায় তিনি সকালে হাসপাতালে তার নিজ চেম্বারে বসেন। কিন্তু তিনি লক্ষ করলেন আগের মতো তার কাছে তেমন রোগী আসে না। দু একজন আসলেও তার নাম বা চেহারা দেখেই চলে যায়। এমনকি তার কলিক ও হাসপাতালের স্টাফরাও একে অন্যকে বলাবলি করতে থাকে আফিয়ার ব্যাপারে। জাহানারা চৌধুরী যখন হাসপাতালে আসেন ও বের হন তখনও কেউ কেউ তার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকায়। আবার কেউ দূরে সরে যায়। আর কেউ তো এসে বলেই ফেলে, আপনার মেয়ে কেন আত্মহত্যা করেছে? এমন প্রশ্নে হকচকিয়ে যান জাহানারা চৌধুরী। নিজেকে আড়াল করার ব্যর্থ চেষ্টা করেন তিনি।
ছেলেমেয়েদের সামনে হাসিখুশি থাকলেও রাতে কাঁথা মুড়ি দিয়ে কাঁদেন ডা.জাহানারা চৌধুরী।
আর ড.শওকত চৌধুরী জাহানারা চৌধুরীর মাথায় হাত বোলিয়ে এ বলে সান্ত্বনা দেন, আমাদের ভেঙে পড়লে চলবে না। ঘরে দুজন ছেলেমেয়ে আছে। তাদের মন থেকে এ দুর্ঘটনাকে মুছে দিতে হবে। হাসিখুশি রাখতে হবে তাদেরকে। তুমি ওদের মা। তোমার শক্ত থাকা দরকার। দেখনা আমি কতো কথা শুনেও শক্ত আছি।
জাহানারা চৌধুরী কেঁদেই চলেছেন।
ড.শওকত চৌধুরী স্ত্রীর মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে ভাঙা গলায় আবার বলতে লাগলেন, আমি যখন ক্লাস নিই ছাত্ররা ক্লাসের মাঝেই কানাঘুষা করতে থাকে। আরে আমাকে তো এক ছাত্র ক্লাস চলাকালীন দাঁড়িয়ে বলেই বসল, স্যার আপনার মেয়ে আত্মহত্যা করেছে শুনলাম! প্রেমে ছ্যাকাট্যাকা খেয়েছিল না-কি!
এসব কথা বলে ড.শওকত চৌধুরী আর স্ত্রী জাহানারা চৌধুরী ওতপ্রোতভাবে জড়িত হাউমাউ করে কেঁদে উঠেন। তাদের কান্না দেখে যেন পুরো বাড়িটা কেঁদে ওঠে।
তাই বলি বাবা আত্মহত্যা করো না। তমিজের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন তমিজের সামনে বসা লোকটি। তমিজ লক্ষ করল লোকটির চোখ পানিতে টলমল করছে।
চোখ মুছে লোকটি আবার বলে উঠলেন,
তুমি তো জানই আত্মহত্যা মহাপাপ। তাছাড়া আত্মহত্যায় সমাধান নেই। হয়তো তুমি আত্মহত্যা করে চলে যাবে কিন্তু তোমার পরিবার এ গ্লানি বয়ে যাবে। তোমার মৃত্যুর শোকের ঘা এর ওপর আশেপাশের মানুষের বিরক্তিকর আচরণে তোমার পরিবার হ্যস্তন্যাস্তল হবে। কতো মানুষের কতো ধরনের কথা শুনতে হবে! যা ভাবনাতেও আনতে দুষ্কর।
আচ্ছা আঙ্কেল আফিয়ার আত্মহত্যার কারণ কী ছিল? লোকটিকে থামিয়ে দিয়ে উৎকর্ণ হয়ে বলে উঠল তমিজ।
আত্মহত্যার কারণ জানা যায়নি। কারণ যাই হোক এই জন্য কি আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে হবে! এটা কোথাও লেখা আছে নাকি! আত্মহত্যার কারণে কি তার সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে! মানুষের জীবনে তো সুখদুঃখ থেকেই থাকে। তাই বলে কি একটু কষ্ট পেলেই আত্মহত্যা করতে হবে! একবারের জন্যও কি বাবা-মার কথা মনে পড়ে না! যারা এতো কষ্ট করে তিলে তিলে সেই ছোটকাল থেকে বড় করে তোলেছেন। এই তাদের প্রতিদান!
তমিজ এবার নির্নিমেষ নেত্রে তাকাল লোকটির দিকে। তিনি এবার কেঁদেই দিলেন। দু ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ল তার কপোল বেয়ে।
তামিজ এবার অনুতপ্ত হয়ে বলল, আঙ্কেল ক্ষমা করবেন আমায়। প্রথমে আপনার সঙ্গে বেয়াদবি করার কারণে। আর আমার নাম তমিজউদ্দিন। আপনার উত্তর না দেয়ায় আমি দুঃখিত।
চোখ মুছে লোকটি ভাঙা গলায় বললেন, আমি জানি তোমার নাম। তোমার বাবা বলে ছিলেন। তুমি কি জানো কে আমি?
না,আমি আপনাকে চিনি না। তমিজ এ কথা বলার আগেই লোকটি বলে উঠলেন, আমিই ড.শওকত চৌধুরী। আফিয়ার বাবা। কতো আদর-যত্নে বড় করে তোলেছিলাম ওকে। আর সে আমাদের এ প্রতিদান দিল! সে তো আমাদের বলতে পারত তার মনের কষ্টের কথা। যে কষ্টের কারণে সে আত্মহত্যা করেছে।
তুমি জানো না বাবা, তার মৃত্যুর এক বছর প্রায় হতে গেল, কিন্তু আজও রাস্তায় যখন বের হই মানুষ আমাদের আড় চোখে দেখে।
এবার ড.শওকত চৌধুরী হাউমাউ করে কান্না জুড়ে দিলেন। তার কান্না থামছেই না যেন। ক্রমাগত বেড়েই চলছে। তমিজ কী করবে, কী বলে সান্ত্বনা দেবে কিছুই খুঁজে পাচ্ছে না। সেও তো এমন জঘন্যতম অপরাধ করতে গিয়েছিল। কান্নার আওয়াজ শুনতে পেয়ে শফিউদ্দিন সাহেব এসে তার কামরায় ড.শওকত চৌধুরীকে নিয়ে গেলেন।
তমিজ এবার ভাবনার অতলে পড়ে গেল। হায়! আমি কী করতে গিয়েছিলাম! আমি আত্মহত্যা করলে কি এর সমাধান হত! আর আমার আত্মহত্যায় নাফিজার কি কিছু হত! হয়তো আমার মৃত্যুর সংবাদ শোনে দুফোঁটা চোখের পানি ফেলত। হয়তো কিছুসময় মনখারাপ করত। কিন্তু পরে তো ঠিকই সে অন্যজনের সঙ্গে সুখের ঘর বাঁধত। কিন্তু আমার কী হত! আর আমার বাবা-মা-রই কী হত ! তারা তো ক্রমাগত কেঁদেই যেতেন। একদিন দুদিন নয়,মাসের পর মাস বছরের পর বছর কেঁদেই বুক ভাসাতেন। আর চৌধুরী সাহেবের পরিবারের মত আমাদের পরিবারকেও আমার অপমৃত্যুর কারণে মানুষের ধিক আর কুমন্ত্রণা শুনতে হত।
তমিজ রাতে খাবার টেবিলে বাবা-মার পা ধরে কান্না করতে করতে বলল, আমাকে ক্ষমা করে দেন আপনারা। আমি আর কোনোদিন এমন জঘন্য কাজ করতে যাব না।
