আকাশ পরী

0
99

নাফিসা আনজুম


সেদিন রাতের বেলা বগুড়া শহর কুয়াশায় ঢেকে ছিল। আশেপাশে শুধু ঠান্ডা শিশির পড়তে দেখা যাচ্ছিল। আকাশ ছিল কুয়াশায় আচ্ছন্ন। মনি তার আম্মুর সাথে নানি বাড়ি বেড়াতে গিয়েছিল ফিরতে ফিরতে রাত ৮টা বেজে গেছে। মনি দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়ে। মনির আম্মু মনি কে বলছিল তুমি আমার হাত ধরে চল। আগে আগে দৌড়ে যেয়োনা। মনি ভীষণ রেগে গেল। মনি বলল আমি সব চিনি তোমার হাত ধরা লাগবে না। তখন হঠাৎই কয়েকটা কুকুর ঘেউ ঘেউ করে উঠল। আর মনি দৌড়ে গিয়ে ওর আম্মুর হাত চেপে ধরল। মনিকে ওর আম্মু বলল অত্যন্ত করুণ গলায় আম্মু অনেকদিন হয়ে গেল ওদের সাথে আমি দেখাই করিনি আজকে একটু কথা বলব আচ্ছা আম্মু। মনির আম্মু আর কিছু বলল না। দূর থেকে দেখতে পেল অরিন ও তুষা ফুটপাতে বসে গুটি দিয়ে খেলছে। অরিন ও তুষার মা, বাবা কেউ নেই। ওরা পথ শিশু। ওদের মত আরও অনেকে আছে। তারা ফুটপাতকেই তাদের বাড়ি করে নিয়েছে। মনি অরিন ও তুষাকে দেখা পেয়ে বলতে লাগল আকাশ পরী আজকেও তোমাদের জন্য চকলেট এনেছি। অরিন ও তুষা আরও অনেকে চকলেট গুলো কাড়াকাড়ি করে গবগব করে খেতে লাগল। একদিন মনি একা একা রাস্তা পার হতে নিয়ে ট্রাকের নিচে পড়তে নিয়েছিল। তখন অরিন ও তুষা মনিকে ট্রাকের নিচে পড়া থেকে বাঁচিয়েছিল। তার পর থেকে মনি অরিন ও তুষাকে বলত আকাশ পরী। মনি আরও বাড়িয়ে বলত তোমরা দুজন তো একদমই আকাশের পরীর মত দেখতে। তোমরা পরী সেজন্যই তো আমাকে বাঁচিয়েছিলে।মনি বলতে লাগল ইনু মিনু মাইনি মো নাক ডাকলে বুড়ি হো , অরিন ও তুষা বলল সেটা আবার কী? মনি বলল ওটা এক মজার শব্দ। তাই বলে ওরা হাঁসাহাসি করতে লাগল।

লিখুন প্রতিধ্বনিতেলিখুন প্রতিধ্বনিতে

মনি ওদের মজার মজার খেলা শিখিয়েছিল। অ মিলো ছিলো ছালো, আমার নাম মিতা, ১-১০ গুনে খেলা। কিছুক্ষণ পর মনি তার আম্মুর সাথে বাসায় চলে গেল। পরের দিন মনি তার বাগান থেকে অনেক গুলো ফুল সংগ্রহ করল আকাশ পরীদের দিবে বলে। সঙ্গে মনি তার কিছু জামাও নিল ওদের দিবে বলে। অরিন ও তুষা ছেঁড়া জামা পড়ে তা মনির ভাল লাগে না। মনি বাসার কিছু দূরের ফুটপাতেই অরিন ও তুষা থাকে তাই প্রায়ই মনি ওদের সাথে দেখা করতে যেত। মনি এবার যেসব ফুল ও জামা নিয়েছিল তা অরিন ও তুষাকে দিল। অরিন ও তুষা ফুল গুলোর পাঁপড়ি ছিঁড়ে মনির মাথায় ছিটিয়ে দিতে লাগল। ওরা প্রতিযোগিতা করতে নিল কে বেশি মনির মাথায় ফুল ছিঁটাবে। মনি একটু পরেই বিরক্ত হয়ে গেল। সে অরিন ও তুষাকে কাতুকুতু দিতে লাগল। মনি ওর বাবার কাছ থেকে টাকা নিয়েছিল সেটা দিয়ে ওরা চিনি দেওয়া পরোটা কিনে খেল। মনি বলতে লাগল অরিন ও তুষাকে, চিনি আলা পরাটা খেতে অনেক ভাল, একদম তোমাদের মত। বলে ওরা তিনজনই হা হা করে হাঁসতে লাগল। মনি যাবার সময় বলল আচ্ছ্যা আকাশ পরীরা আমি গেলাম। অরিন ও তুষা মনির হাত ধরে বলত কালকে আবার আসবে তো। মনি অভিমান করে বলত আসব না মানে। না আসলে হয় নাকি। এভাবে প্রায় দুই বছর কাটিয়ে গেল মনির অনেক ভাল বান্ধবী হয়ে গিয়েছিল অরিন ও তুষা। মনি হঠাৎ শুনতে পারল ওর বাবার চাকরি চট্টগ্রামে বদলি হয়েছে ওদের সবাই কেই চলে যেতে হবে। মনে হয়ে মনির খুব খারাপ লাগতে লাগল অরিন ও তুষাকে ছেড়ে সে কীভাবে যেতে পারে। কিন্তু যেতে তো মনিকে হবেই। মনি যাবার দিনে খুব কাঁদতে লাগল। মনির বাবা মা ওকে অনেক বুঝালো। তবুও সে জানত পৃথিবীর কোথাও অরিন ও তুষার মত বান্ধবী সে পাবে না। মনি যখন বাসে চড়বে তখন অরিন ও তুষা ফুটপাতেই দাঁড়িয়ে ছিল। আজ অরিন ও তুষা মনির জন্য কিছু উপহার এনেছিল। একটি ছোট্ট বাক্স তাতে তিন রকমের ছোট ছোট পাথর। অরিন ও তুষা বলল মনি তুমি আবার আমাদের কাছে আসবে তো। তুমি না হলে আমরা আর কখনও গুটি দিয়ে খেলব না মজা করব না। মনির কিছু বলতেই পারছিল না ওদের রেখে বাসে চড়তে মনির হাত পা অবশ হয়ে যাচ্ছিল। তবুও মনি বলল আকাশ পরীরা আমি অবশ্যই আবার আসবো। এর পর বারো বছর পরের কথা মনি একজন সমাজ সেবি হয়েছে। সে পথশিশু ও অসহায় মানুষদের সাহায্য করে। মনি কত খুঁজেছে অরিন ও তুষাকে কিন্তু কেন জানি পায় নি। বিভিন্ন ভাবে মনি আকাশ পরীদের খুঁজতেই থাকে। এক সময় অনেক খোঁজার পর নিতু নামের একজন সমাজ সেবিকা কে খুঁজে পায় এবং উনার কাছে থেকে জানতে পারে অরিন ও তুষার কলেরা হয়েছিল চিকিৎসা না পেয়ে ওরা মারা গেছে। এটাও জানায় যে অরিন ও তুষা তোমার জন্য একটি চিঠি রেখে গিয়েছিল কারণ তারা জানত তুমি এক দিন অবশ্যই আসবে। অরিন ও তুষার সে চিঠিতে লেখা ছিল মনি তুমি আমাদের আকাশ পরী বলতে না। আকাশ পরী হয়ে আমরা দুই জন সবসময়ই তোমার সাথে আছি। তোমার সাথে আমাদের বন্ধুত্ব কখনও শেষ হবে না। মনি সেদিন মোটেও কান্না করল না কারণ সে জানত সত্যিই তো আকাশ পরীরা আবার মরতে পারে কীভবে? মনি তার প্রচেষ্টায় অরিন ও তুষার নামে পথ শিশু কেয়ার সেন্টার গড়ে তুলেছিল। সে মনে করে ওই সেন্টারের সকল পথ শিশুই অরিন ও তুষার প্রতিচ্ছবি। অরিন ও তুষা আজও বেঁচে আছে প্রত্যেকটি পথ শিশুর মধ্য যাদের কেউ নেই। মনিকে ওর মা ছোট বেলায় বলত পরী বলতে কিছুই নেই। কে পরীকে দেখেছে। মনি তো জানত সে তো আকাশ পরীকে দেখেছে। অরিন ও তুষাই তো সেই আকাশ পরী।

Previous articleবিশেষজ্ঞ
Next articleজন্মভিটা
প্রতিধ্বনি
প্রতিধ্বনি একটি অনলাইন ম্যাগাজিন। শিল্প,সাহিত্য,রাজনীতি,অর্থনীতি,ইতিহাস ঐতিহ্য সহ নানা বিষয়ে বিভিন্ন প্রজন্ম কী ভাবছে তা এখানে প্রকাশ করা হয়। নবীন প্রবীণ লেখকদের কাছে প্রতিধ্বনি একটি দারুণ প্ল্যাটফর্ম রুপে আবির্ভূত হয়েছে। সব বয়সী লেখক ও পাঠকদের জন্য নানা ভাবে প্রতিধ্বনি প্রতিনিয়ত কাজ করে চলেছে। অনেক প্রতিভাবান লেখক আড়ালেই থেকে যায় তাদের লেখা প্রকাশের প্ল্যাটফর্মের অভাবে। আমরা সেই সব প্রতিভাবান লেখকদের লেখা সবার সামনে তুলে ধরতে চাই। আমরা চাই ন্যায়সঙ্গত প্রতিটি বিষয় দ্বিধাহীনচিত্ত্বে তুলে ধরতে। আপনিও যদি একজন সাহসী কলম সৈনিক হয়ে থাকেন তবে আপনাকে স্বাগতম। প্রতিধ্বনিতে যুক্ত হয়ে আওয়াজ তুলুন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here