আলেয়া

0
260

ইশতিয়াক মাহমুদ তন্ময়

সারকথা:
শহরের ছেলে রূপাই,একাদশ শ্রেণীতে পড়ে;বয়স আঠারো ছুঁতে এখনো দিন কয়েক
বাকি।কিন্তু সাহসিকতার দিক দিয়ে চ্যালেঞ্জ জানাতে পারে বাঘা-বাঘা সব লোককে। একঘেয়ে
জীবনে ভিন্ন আমেজ আনতে সপরিবারে গিয়েছিলো মায়ের এক দুঃসম্পর্কের মামার
বাড়িতে।সাতক্ষীরা জেলা শহর থেকে মাইল সাতেক ভিতরে;গ্রামের নাম আহমদপুর।পঁচিশ হাজার
মানুষের এই গ্রামে স্কুলের গণ্ডি পেরিয়েছেন কেবল তেইশ জন;তাদের প্রায় সবাই এখন শহরে
পাড়ি জমিয়েছেন।শাপেবর হিসেবে গ্রামের মানুষের অজ্ঞতার সুযোগ নিচ্ছিলো একটি মহল।গ্রামের
দক্ষিণে বগার বিলের জলে সৃষ্ট আলেয়াকে কেন্দ্র করে একটা ভৌতিক পরিবেশ সৃষ্টি করে
নিজেদের আখের গুছিয়ে নিচ্ছিলো তারা।রাতের অন্ধকারে গ্রামে প্রবেশ করছিলো মাদক,অবৈধ
অস্ত্র আর বিলের কাছের কবরস্থান থেকে কৌশলে গায়েব করা হচ্ছিলো কঙ্কাল।আলেয়া
রহস্যের কিনারা করতে একদিন রাতের অন্ধকারে বেরিয়ে পড়ে রূপাই।দুর্ধর্ষ এই অপরাধীদের
সামনে রূপাই নিতান্তই বাচ্চা।রূপাই কি পারবে এসব অপকর্ম রুখতে?

সময়:৪জুলাই,২০২৪

[১]

বর্ষার পড়ন্ত বিকেলবেলা।শহরের বুকে বর্ষা এসেছে দিন দশেক আগেই;তবে সে যেন
এখনো নিজেকে হারিয়ে খুঁজছে।তারপর আবার লোডশেডিং।লোডশেডিং এর লোড নিতে না পেরে
বারান্দায় বসে বাতাস খুঁজছিলেন নাহিদ-রেখা দম্পতি।তবে কপাল থেকে গড়িয়ে পড়া ঘাম
বারবার ঘোষণা করছিলো,তা হবে না,তা হবে না।এমন সময় বাসায় ফিরলো রূপাই;নাহিদ-রেখা
দম্পতির একমাত্র ছেলে।একাদশ শ্রেণী পড়ুয়া রূপাই;মেধাবী ছাত্র হিসেবে ময়মনসিংহ শহরে তার
বেশ সুনাম আছে।রূপাই ভালোবাসে গোয়েন্দা আর রহস্য গল্প পড়তে।কখনো স্বপ্ন দেখে গল্পের
চরিত্রের আদলে নিজেকে সাজাবে;হয়তো শার্লক হোমস নয়তো মাসুদ রানা।বেশভূষায় সেই ভাব
ঠিকঠাক আনতে না পারলেও সাহসিকতায় গল্পকে ছাপিয়ে রূপাই এক অকুতোভয় বীর।বীরত্বের
গল্প এখন থাকুক।
বসার ঘরে বাবা-মাকে না পেয়ে রূপাই সোজা চলে গেল বারান্দায়।বাবা-মা তার দিকে
তাকিয়েছেন কিনা সেটা তার বিবেচ্য নয়;সে কিছু বলছে,তার অর্থ-তার কথা সবাই
শুনছে।স্বৈরতন্ত্র?না,এর নাম অন্যকিছু।তবে সেই নাম আমি জানি না।বাবা-মায়ের একমাত্র
সন্তানরা বোধহয় সেটা জানে;যাক গে থাক..
রূপাই বললো,অনেকদিন হলো কোথাও বেড়াতে যাই না মা।চলো না,কয়েকদিনের জন্য
কোথাও বেড়িয়ে আসি।
রেখা বললেন,বেড়াতে যাবি?তোর বাবাকে আগে অফিস থেকে ছুটি নিতে বল।
নাহিদ বললেন,তোর মায়ের এই এক সমস্যা।শুধু আমার উপর চাপিয়ে দেয়।শোন,আমি
চাইলে কালি ছুটি নিতে পারি।
রেখা ভ্রু কুঁচকে বললেন,ও তাই বুঝি?মাস ছয়েক আগে কার যেন সাত দিনের ছুটি
নিতে চারদিন বসের পিছনে ঘুরতে হয়েছিলো।
নাহিদ আত্মপক্ষ সমর্থন জানিয়ে বললেন,আরে তখন তো অফিসে জরুরী কাজ
ছিলো।এখন চাইলেই ছুটি নিতে পারবো।
রেখা বললো,বুঝেছি বুঝেছি;মুরদ জানা আছে।আগে ছুটি নিয়ে দেখাও।
হ্যাঁ,হ্যাঁ;প্রয়োজনে তাই করবো।জোর গলায় বললেন নাহিদ।
রূপাই বিরক্ত গলায় বললো,আরে তোমরা কী শুরু করলে?!
আমি শুরু করেছি?তোর মাকে বল।মা-ছেলেতে শুধু আমাকে বলতে শিখেছে।
যাক বাবা!আমি আবার কী শুরু করলাম?সত্যি কথাটাও বলা যাবে না।
আরে তোমরা কেউ কিছু শুরু করো নি।সবকিছু আমি শুরু করেছি।এখন বলো,বেড়াতে
যাব কোথায়?

চল,আহমদপুর থেকে ঘুরে আসি।ফজলুল মামা বারবার কল করে যেতে বলছেন।
ব্যস্,তাহলে তো হয়েই গেলো।আমি কাল ছুটি নিয়ে নিবো।পরশুই চলো আহমদপুর।গ্রামের
আলো-হাওয়ায় ক’টা দিন কাটিয়ে আসা যাবে।সাথে মৌসুমের শেষে গাছেপাকা আম-কাঁঠাল
উপরি পাওনা হলেও হতে পারে।বেশ হবে কিন্তু ব্যাপারটা।
তা যা বলেছো বাবা।আর আমারো অনেকদিন পর ফরহাদের সাথে আড্ডা দেয়া
হবে।আহফাজনগরের মাঠে ক্রিকেট খেলতে পারবো।যা মজা হবে না;আমার তো ভাবতেই আনন্দ
দ্বিগুণ হয়ে যাচ্ছে।দু’হাতে তুলে নাচতে ইচ্ছে করছে আমার।
থাক,এখন আর নেচে কাজ নেই।এখনো তো কলেজ ড্রেসটাও খুলিসনি!বাপ-ছেলে সব
এক অবস্থা;কোনো ঠিকঠিকানা নেই।আমার হয়েছে যত জ্বালা।রূপাইকে ধমক দিয়ে বললেন,কাপড়
পাল্টে ফ্রেশ হ;তারপর খেতে দিচ্ছি।
ফজলুল সাহেব রেখার দুঃসম্পর্কের মামা;তবে অনেক নিকটাত্মীয়ের চেয়ে শত-সহস্র গুণ
আপন।আট বছর বয়সে বাসচাপায় বাবা-মা মারা যাবার পর আত্মীয়-স্বজন সবাই যখন একে
একে সরে গেল,তারপর থেকে ফজলুল হকের তত্ত্বাবধানেই রেখা বড় হয়েছে।তার বাবা-মায়ের
শুন্যতাটা পরম আদরে পূরণ করেছেন ফজলুল সাহেব আর তার স্ত্রী আয়েশা।ধানের ব্যাপারী
ফজলুল নিতান্ত সহজ-সরল,মানবিক একজন।
পরদিন দুপুরে অফিস থেকে দশ দিনের ছুটি নিয়েছেন নাহিদ।ব্যাপারটা এতো সহজে হয়ে
যাবে-ভাবেনি নাহিদ।মধ্যাহ্নভোজের পর মনে সংশয় নিয়ে বসের ঘরে যান তিনি।ছেলেটা এতো
আশা নিয়ে বসে আছে-কাল সবাই মিলে নানার বাড়ি যাবে;সে ছুটি না পেলে তো সব
মাটি।যাইহোক,বসের ঘরে উঁকি দিয়ে দেখলেন,বস শফিকুল ইসলাম মন দিয়ে বিজন্যাস ম্যাগাজিন
পড়ছেন।অফিসিয়াল কাজের বাহিরে তাকে দেখা একটি দুর্লভ দৃশ্য বটে।
স্যার আসবো?
আরে নাহিদ সাহেব যে!আসেন আসেন,বসেন।
নাহিদ একটা চেয়ার টেনে বসলেন।এরপর ইতস্তত করে বললেন,স্যার,কয়েকটা দিন ছুটি
প্রয়োজন ছিলো;বেশিদিন না,দশদিনের মতো আরকি।ছেলে-বউ নিয়ে একটু শ্বশুরবাড়ি যেতে
চাচ্ছিলাম।
আচ্ছা,এই ব্যাপার।শ্বশুরবাড়ি যেতে চাইলে যাবেন,কে মানা করেছে।ছুটি নিয়ে ভাববেন
না।নিশ্চিন্তে ঘুরে আসেন;এদিকটা আমি সামলে নিবো।
থ্যাঙ্ক ইউ স্যার।আজকে তাহলে উঠি স্যার।ভেবেছি কাল ভোর ভোর বেরিয়ে
পড়বো;একটু গোছগাছের ব্যাপার আছে।বুঝেনই তো।
তা আর বুঝিনা।মাস দুয়েক আগে আমার শ্বশুরবাড়িতে কী কান্ড হয়েছে জানেন?বলছি
শুনেন।

শফিকুল সাহেবকে থামিয়ে নাহিদ বললেন,কিছু মনে করবেন না স্যার,গল্পটা আরেকদিন
শুনবো;আজকে উঠি।
শফিকুল সাহেব জয় দিয়ে বললেন,আরে বসেন তো;চা-কফি খান।দুই ভাই বলে একটু
গল্পস করি।সচরাচর তো সুযোগই পাই না।
ঘণ্টা দেড়েক গল্প করে বিকেল তিনটা নাগাদ অফিস থেকে বেরোলেন নাহিদ।বিশেষ
কারণে শফিকুল সাহেব আজ বেশ ফুরফুরে মেজাজে আছেন।কারণটা এমন-ময়মনসিংহ শহরের
নতুন বাজার এলাকায় দুটো ফ্ল্যাট কিনেছেন তিনি;মোটে পঁচিশ লক্ষ টাকা দাম পড়েছে।

[২]

মহাসড়কের পাশে ছোট চায়ের দোকানে বসে কড়া লিকারের চা খাওয়া নাহিদের
বরাবরই প্রিয়।বাসযাত্রায় সে সুযোগ নেই বললেই চলে।দূরে কোথাও ভ্রমণে তাই নাহিদের পছন্দ
চার সিটের প্রাইভেটকার।তবে সেটা নিজের প্রাইভেটকার হলে চলবে না।গাড়িটি হতে হবে ভাড়ায়
চালিত।এবিষয়ে নিজস্ব একটি দর্শন আছে নাহিদের।নিজস্ব গাড়ির যে দুটো দিক তার সবচেয়ে
অপছন্দের সেগুলো হলো ড্রাইভারকে বারবার ফুয়েল নেবার জন্য টাকা দাও,মাসে মাসে
ড্রাইভারকে বেতন দাও;নয়তো আবার তেলের খরচ থেকে টাকা সরানোর শঙ্কা।ভাড়া গাড়িতে
এসব সমস্যা নেই;গন্তব্যে পৌঁছে ড্রাইভারকে পূর্ব নির্ধারিত ভাড়া মিটিয়ে দিলেই কম্ম কাবার।তবে
সমস্যা যে একেবারেই নেই-তা নয়;এক্ষেত্রে আবার প্রতিবারই নতুন করে গাড়ি ঠিক করতে হয়-
সে আরেক যন্ত্রণা।মূল কথা হলো এই যে,মানবজীবনের কোনো ব্যবস্থাই একেবারে নির্ঝঞ্ঝাট নয়।
খুব ভোরে;আনুমানিক পাঁচটায় সাতক্ষীরার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেছে ওরা
তিনজন।দুঃখিত,তিনজন নয়;চারজন।ড্রাইভার সাহেবের কথা ভুলেই গিয়েছিলাম।পথে গুণে গুণে
ছ’কাপ চা খেলেন নাহিদ।সপ্তম কাপের অর্ডারটাও দিয়েছিলেন বটে কিন্তু রূপাইয়ের বদৌলতে তা
আর হলো না।
কী শুরু করলে বলো তো বাবা।এভাবে একটু পর পর কেউ চা খায় নাকি?এক্ষুণি
অর্ডার ক্যান্সেল করো।বাধ্য হয়েই চায়ের অর্ডার ক্যান্সেল করতে হলো নাহিদকে।সে যাত্রায় তার
আর চায়ে চুমুক দেয়ার সৌভাগ্য হয়নি।
বিকেল তিনটা কি চারটা বাজে তখন।নাহিদ,রেখা আর রূপাই-ঘণ্টাদুয়েক আগে তাদের
আহমদপুর ব্যাপারী বাড়ির(সাতক্ষীরা জেলা শহর থেকে মাইল সাতেক ভিতরে) সামনে নামিয়ে
দিয়ে গেছেন ড্রাইভার সাহেব।বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন ফজলুল ব্যাপারী;তার সাথে দাঁড়িয়ে
ছিলো ফরহাদ।ফরহাদ রূপাইয়ের মামাতো ভাই;ওর বাবা-মা থাকে শহরে।শ্যামলা,লম্বা আর রোগা
গড়নের ছেলে ফরহাদ;পড়ে অষ্টম শ্রেণীতে।পরিচয় পর্ব এখন নাহয় থাকুক।
বুড়ো ফজলুল সাহেব এগিয়ে এসে রূপাকে জড়িয়ে ধরলেন,কেমন আছিস
নানাভাই?নানাবাড়ির কথা মনে পড়ে না বুঝি!
ভালো আছি নানাভাই।তুমি কেমন আছো?আর নানুকে দেখছি না যে!নানু কোথায়?

তোর নানু তো মহাব্যস্ত।দুপুর থেকে তোদের জন্য রান্নাবান্না করছে।সকালে ছেলেপিলে
দিয়ে গাছ থেকে পাকা আম-কাঁঠাল পাড়িয়ে রেখেছে।আরবাজনগর থেকে পিঠে বানাবার জন্য
চাল গুঁড়ো করিয়ে এনেছে।এলাহী আয়োজন।
আমাদের নিয়ে এতো ব্যস্ত হবার কী ছিলো মামা?আমরা কী মেহমান নাকি যে
আপ্যায়নে ত্রুটি হলে কিছু মনে করবো।আমি যাই,মামীকে গিয়ে সাহায্য করি,এই বয়সে একা
মানুষ এতোকিছু করছে।
সাহায্য করবি কিনা সেটা তুই আর তোর মামীর ব্যাপার।তবূ আগে ঘরে গিয়ে
কাপড়চোপড় বদলে হাত-মুখ ধুয়ে নে।আরে এই ফরহাদ,দাঁড়িয়ে দেখছিস কী?তোর ফুপুর হাত
থেকে লাগেজটা নে দেখি দাদাভাই।
সবাই যখন বখড়ির ভিতরে যাচ্ছিলো,রূপাই আর ফরহাদ মেতে উঠলো খুনসুটিতে।ফরহাদ
বললো,ফ্রেশ হয়ে বিশ্রাম নিয়ে নেও রূপাই ভাই।সন্ধ্যার পর ঘুরতে বের হবো কিন্তু। কতদিন
একসাথে ঘুরাঘুরি করা হয় না।
তা আর বলতে।সন্ধ্যায় মতিন মিয়ার হাতের দুধ চা খুব মিস করি যে।আজকে কম
করে তিন কাপ খাবো,তুই মিলিয়ে নিস।
ঠিক আছে,ঠিক আছে।কে খেতে মানা করেছে তোমাকে?
মানা করলেই শুনবো নাকি!মতিন মিয়ার চায়ের ব্যাপারে নো কম্প্রোমাইজ।
সহমত।আচ্ছা,এখন আগে ঘরে চলো।নানু এই চিল্লাচিল্লি শুরু করলো বলে।বলতে না
বলতেই আয়েশার গলা শুনা গেল;ওরে ফরহাইদ্দা রে,নাতি আমার এতোহানি পথ পাড়ি দিয়া মাত্র
আইলো।তুই পোলাডারে আগে জিরাইবার দে দেহি।
রূপাই ঘরে ঢুকতেই আয়েশা শরবত নিয়ে হাজির।এই শরবত খান খাইয়া নেও
নানুভাই।কইলজা ঠান্ডা হইবো।
ধন্যবাদ নানু-বলে রূপাই শরবতের গ্লাসটা হাতে নিলো;এক চুমুকে বলতে গেলে পুরটাই
শেষ করে ফেললো সে।প্রচণ্ড গরমে এই শরবত অমৃতসমান-এ কথা আলাদা করে বলবার
প্রয়োজন নেই।
ফজলুল সাহেব নাহিদকে বললেন,জামাই,কী খাইবার চাও,খালি কইবা;দেখবা তোমার
সামনে হাজির।লাগলে জামাই-শ্বশুর একসাথে বাজার কইরা আনমু।তোমার পছন্দমতো বাজার
হইবো সব।
আমার পছন্দমতো বাজার হবে-সে তো বুঝলাম মামা।কিন্তু এই বয়সে এতো দৌড়ঝাঁপ
করবেন না।পরে দেখা যাবে,একসাথে বাজারে না গিয়ে একসাথে হাসপাতালে যেতে হবে।আপনি
রোগী,আমি রোগীর জামাই।

লিখুন প্রতিধ্বনিতেলিখুন প্রতিধ্বনিতে

নাহিদের কথা শুনে সবাই হাসলো।আয়েশা বললেন,তোমরা হাত-মুখ ধুইয়া নেও;আমি
খাইতে দিতেছি।রাস্তার মধ্যে তো মনে হয় ঠিকমতো কিছু খাও নাই।
জ্বি মামী।
সন্ধ্যা সাতটা বেজে আট মিনিট।খাওয়া-দাওয়া সেরে ব্যাপারী বাড়ির প্রায় সবাই ঘণ্টা
দুয়েক ঘুমিয়ে নিয়েছে।ঘুমায়নি কেবল রূপাই আর ফরহাদ।এতোদিন পর দুই ভাইয়ের দেখা;বসার
ঘরে বসে দুজনে জমিয়ে আড্ডা দিচ্ছিলো।রূপাই হঠাৎ বললো,ফরহাদ চল,মতিন মিয়ার চা খেয়ে
আসি।
চলো যাই।আচ্ছা দাঁড়াও,আমি দাদিকে বলে আসি।
ঠিক আছে;তুই দাদিকে বলে আয়।
ফরহাদ যখন পাশের ঘরে গিয়ে দাদির কাছে বেরোবার কথা বললো,দাদি তখন
বললেন,যেহানেই যাস না কেন,বগার বিলের আশেপাশে যাইস না কিন্তু।
আহমদপুর গ্রামের দক্ষিণ দিককার শেষ সীমা হলো বগার বিল।লোকে বিল বলে বটে
তবে এটা আদতে বিশাল এক পুকুর।পুরো পুকুরের চারদিকে এক পাক দিতে কোনো শক্তপোক্ত
মানুষেরও পাঁচ-ছয় মিনিট লাগবে।মার্বেল পাথরে বাঁধানো ঘাট,পুকুরের পাড় বরাবর বিশাল সব
গাছের সারি-একেকটার বয়স কম করে হলেও পঞ্চাশ-ষাট বছর।কবে এই পুকুর খনন করা
হয়েছে এবং কে খনন করিয়েছে-এই প্রশ্নের উত্তর জানা নেই আহমদপুরের আমসিপাড়া পড়া
বাচ্চা ছেলেমেয়ে থেকে শুরু করে শতবর্ষী মুরুব্বি সকলেরই অজানা।তাদের পিতা,পিতামহরাও
এই পুকুরের সৃষ্টিলগ্ন সম্পর্কে ছিলেন অজ্ঞ।বগার বিলের ইতিহাস সম্পর্কে কেবল জানা যায়,প্রায়
দেড়শো বছর আগে ভাস্কর রায় নামের এক প্রতাপশালী জমিদার এর পাড় বাধাই করে মার্বেল
পাথরে।পুকুরপাড়ে সারি সারি গাছ লাগানোর সূচনাও তারা হাতে।
সত্য-মিথ্যার বাঁধা অগ্রাহ্য করে বগার বিল নিয়ে প্রচলিত আছে নানান গল্প।আহমদপুর
গ্রামের মানুষের কাছে সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য গল্পটা এমন:প্রায় আট বছর আগে বগার বিলে মাছ
ধরবার সময় হঠাৎ ঢলে পড়েন জয়নাল জেলে।জয়নাল আসলে মারা যান হার্ট অ্যাটাকে।কিন্তু
তার সাগরেদ বলেছিলো,উস্তাদ যখন মাছ ধরতেছিলো,পাঞ্জাবি পিন্দা এক মুরুব্বি আইয়া মাছ
ধরবার না করছিল।উস্তাদ হেই মুরুব্বিরা কথা হুনলো না।হেই মুরুব্বি ইট্টু সামনে যাইতেই
উস্তাদ বওয়া থেইকা ঠাস কইরা মাডিত পইড়া গেল।চাইয়া দেহি,মুরুব্বি উদাও।আমার মনে
হয়,হেই মুরুব্বি আসলে জিন।জিনেই মারছে আমার উস্তাদরে।সেই দিন থেকে শুরু।দশ গ্রামে রটে
গেল,বগার বিলে জিন আছে,দুষ্টু জিন।জয়নাল মারা যাবার পর গ্রামের কোনো ছেলে বগার বিলে
জাল ফেলেনি।
তবে ছেলে-ছোকরাদের আনাগোনা চলছিলো।এইতো ক’দিন আগে পর্যন্তও,বগার বিলের
বাঁধানো ঘাটকা ছিলো ওদের আড্ডার প্রধান জায়গা।জায়গাটা ছিলো রূপাইয়ের ও খুবই প্রিয়।তাই
নানু বগার বিলে যেতে মানা করায় তার মনটা খারাপ হয়ে গেল।

[৩]

মতিন মামা,দুই কাপ দুধ চা দিয়ো।
দীর্ঘদিন পর রূপাইয়ের গলা শুনে চমকে উঠে মতিন।আরে রূপাই মামা!কবে আইলেন?
আজই এলাম।ময়মনসিংহে বসে বসে তোমার হাতের চা খুব মিস করেছি।
তাইলে ইট্টু বন মামা।আপনেগরে দুই কাপ ইস্পেশাল চা খাওয়াই।
ঠিক আছে মামা।আকাশ-পাতাল দাম চেয়ো না আবার।
মতিন কান ধরলো।কী যে কন মামা?আপনে এতোদিন পরে আইছেন;হেই শীতের
সময়।আইজ আপনেগরে ফিরি চা খাওয়ামু।
বাহ,দারুণ তো।
মিনিট দশেক পর মতিন মিয়া দুই কাপ চা দিয়ে গেলেন।চা হয়েছিলো দারুণ।দুজনে বেশ
তৃপ্তি সহকারে চা খাওয়া শেষ করলো।প্রতিবারের মতো এবারও প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে সেখান
থেকে বেরিয়ে গেল।যাবার আগে চায়ের দাম দেবার জোর চেষ্টা চালালো রূপাই;কাজ হলো
না।মতিন মিয়া নাছোড়বান্দা;কইছি না মামা,আইজ ফিরি।
চা খেয়ে বাসায় ফিরবার পথে রূপাই জিজ্ঞাসা করলো,কিরে গ্রামে কিছু গড়বড় হয়েছে
নাকি?নানু বগার বিলে যেতে মানা করলো!ব্যাপার কী বল তো।
ব্যাপার তেমন কিছু না;অশিক্ষার অভিশাপ।
ফরহাদের মুখে এমন গুরুগম্ভীর কথা শুনে অভ্যস্ত নয় রূপাই;তাই প্রথমে কিছুটা থতমতই
খেয়ে গেলো সে।যাহোক,নিজেকে সামলে নিয়ে জিজ্ঞাসা করলো,ভনিতা না করে সোজা কথায় বলে
ফেল।
বলছি।বগার বিলে জ্বিন থাকে।
তাই নাকি!তুই দেখেছিস বুঝি?রূপাই শব্দ করে হাসলো।
হেসো না তো।কেউই শুনেনি।শুনবার মতো কিছুই হয় নি।সব ভীতুর দল।চিলে কান
নিয়েছে শুনে চিলের পিছনে ছুটছে।
এ আর নতুন কী!!এটা তো পুরনো অসুখ।নতুন অসুখের কথা বল বেটা।
মাস দুয়েক যাবৎ বগার বিলে রাতের বেলা আলো জ্বলতে দেখা যায়।কারা আবার কথা
রটিয়েছে,যে জ্বিন জয়নাল জেলেকে মেরেছে,সেই জ্বিন আবার বগার বিলে ঘাঁটি গেড়েছে।রাতের
বেলায় ওদিকে কেমন ভৌতিক আওয়াজ শোনা যায়।গ্রামের লোকজন সন্ধ্যার পর ওদিকে যায়
না বললেই চলে।
তাহলে তো বেশ ভৌতিক ব্যাপার হলো!তুই কী বলিস?

ভৌতিক না হাতি!!সব ভন্ডামি।আমি স্কুলের বিজ্ঞান স্যারকে জিজ্ঞাসা করেছি;স্যার
বলেছে,এর নাম আলেয়া।
আচ্ছা;এবার বুঝলাম।রূপাইয়ের মনে পড়েছে,ক’দিন আগেই এবিষয়ে পড়েছে সে।সবই
মিথেনের খেলা।বসন্তে বনাঞ্চলীয় এলাকায় পাতাঝরা গাছের পাতা ঝরে পড়ে;একসময় পাতা
শুকিয়ে পচতে শুরু করে;এরপর বর্ষায় গিয়ে জমা হয় পুকুর,হাওড়,বিলের তলদেশে।বহুবছর পর
পাতা পচে তৈরি হওয়া পলিমাটি থেকে মিথেন(মার্শ গ্যাস) উৎপন্ন হয়;আর বাতাসের সংস্পর্শে
এলেই ব্যস্,পানির তলদেশে স্ফুলিঙ্গের সৃষ্টি হয়,আর উপরিভাগে আলোর ঝলক দেখা
যায়।চট্টগ্রাম,সাতক্ষীরা-এই জেলাসমূহ পাহাড় আর বনে সমৃদ্ধ হওয়ায় এখানে আলেয়া সৃষ্টি হওয়া
অস্বাভাবিক কিছু না।আহমদপুরের লোকজন এটা বুঝতে পারেনি,কারণ-ইদানিংকালে ঐ গ্রামে
এমন ঘটনার অবতারণা হয়নি।এরই সুযোগ কেউ নিচ্ছে-রূপাই এখন পরিষ্কার বুঝতে
পেরেছে।আরেকটা কারণ অবশ্য আছে-পঁচিশ হাজার মানুষের এই গ্রামে স্কুলের গণ্ডি পেরিয়েছেন
কেবল তেইশ জন;তাদের প্রায় সবাই এখন শহরে পাড়ি জমিয়েছেন।
ফরহাদ বললো,আমি নিশ্চিত,কোনো রেকর্ডিং ডিভাইস প্লে করে মানুষকে ভয় দেখাচ্ছে।
হতে পারে।কিন্তু কেউ খামোখা এসব করবে কেন!!
খামোখা না।অনেক বড় চক্রান্ত হচ্ছে;রাতের অন্ধকারে গ্রামে অনেক কিছু হচ্ছে।
তুই নিশ্চিত হচ্ছিস কী করে?!
রাজু নিজ চোখে দেখেছে।বগার বিলের পাশেই ওর বাড়ি।কেউ ওদিকে গেলে ওর ঘরের
জানালা দিয়ে দেখা যায়।
তাই নাকি?কী বলেছে রাজু?
বগার বিলের ওপাশে গ্রামের শেষ মাথায় একটা কবরস্থান আছে,জানোই তো।ওখান থেকে
রাতের অন্ধকারে কঙ্কাল সরিয়ে দিচ্ছে।গত সপ্তাহে লোককে ভয় দেখানোর জন্য বগার বিলের
ধারে একটা গাছে কঙ্কাল ঝুলিয়ে রেখেছে।রাজু লুকিয়ে লুকিয়ে দেখেছে।
কী সাংঘাতিক ব্যাপার!রাস্তায় এসব বলার দরকার নেই।বাড়িতে গিয়ে বলবি।জোরে পা
চালিয়ে চল।
হুম।
রাতের খাবারের পর সবাই যখন ঘুমে আচ্ছন্ন;রূপাই আর ফরহাদ কথা বলছে
ফিসফিসিয়ে।
শুনো রূপাই ভাই,শুনেছি,গ্রামে মাদক,চোরাই অস্ত্র অন্য গ্রাম থেকে নিয়ে আসছে হাজি
মেম্বারের ছেলে আর তার সাঙ্গপাঙ্গরা।
আচ্ছা,তাহলে এই ব্যাপার।পুলিশও নিশ্চয়ই ওদের হয়ে কাজ করছে।

তা আর বলতে।দেখো গিয়ে মোটা টাকা নিয়ে পকেট,মুখ,চোখ সব বুঁজে বসে আছে।
নানা-নানুকে এসব নিয়ে কিছু বলেছিস?
একবার বলেছি।নানু বললো,এসব নিয়ে যেন কারো সাথে কথা না বলি।
এখন কথা না বলাই ভালো।আমাদের গোপনে কিছু করতে হবে।কিছু জোরালো প্রমাণ
লাগবে বুঝলি।নয়তো কিছু করা যাবে না।
কিন্তু প্রমাণ কোথায় পাবে?
ভাবতে হবে।আচ্ছা শোন,রাজু ঠিকঠাক দেখেছে তো?মানে এই কাজগুলো কখন হয় এসব
আরকি।
ও তো বলেছিলো,রাত বারোটা-একটার পর থেকে শুরু হয়।
ঠিক আছে।কাল কিংবা পরশু আমাদের একবার কবরস্থানে যেতে হবে;তৈরি থাকিস।আর
হ্যাঁ,রাজুর বাসার ফোন নাম্বার আছে তোর কাছে?
নাম্বার তো আছেই।কেন বলো তো।
বলছি;তার আগে বল,এই ঘরে কথা বললে পাশের ঘরে কিছু শোনা যায়?
জোরে চিৎকার না করলে কিছুই শোনা যায় না।
এখন রাজুর বাসায় কল করলে সন্দেহ করবে?
আরে না;সন্দেহ করবে না।
তাহলে একবার কল দে।রাজুকে বলল,কাল তোরা দুজনে স্কুলে যাবি না।স্কুলের জন্য বের
হবি,কিন্তু স্কুলে যাবি না।
তাহলে কোথায় যাবো?
মতিন মিয়ার দোকানের পিছনে একটা ঘর আছে না?ওখানে আসতে বল রাজুকে।
রূপাইয়ের কথামতো ফরহাদ রাজুকে কল করে সব বুঝিয়ে বললো।শেষে পাকা মাথার
কাজ হিসেবে রাজুকে বিষয়টা গোপন রাখতে বললো।
[৪]

পরদিন সাড়ে নয়টা।সকালের নাশতা করেই মতিন মিয়ার চায়ের দোকানে এসে হাজির
রূপাই আর ফরহাদ।ফরহাদ বেরিয়েছে স্কুলের নাম করে;আর রূপাই বেরিয়েছে আশপাশটা ঘুরে

দেখবার অজুহাতে।রেখা অবশ্য একটু বাঁধা দিয়েছিলো।ফজলুল সাহেব তাকে বললেন,যাক না।এই
বয়সে একটু এদিক-ওদিক ঘুরবে না তো কখন ঘুরবে?
যাইহোক;মতিন মিয়াকে সবকিছু বুঝিয়ে বললো রূপাই।তাকে অনুরোধ করলো,দোকানের
পিছনের ঘরটা কয়েক ঘণ্টার জন্য খুলে দিতে;আর তারা সেখানে আছে-এটা যেন কেউ না
জানে,সে বিষয়ে সাবধান করলো।
আপনে কোনো চিন্তা কইরেন না মামা।ম্যালা প্যাচগোছ বুঝি না;তয় এইডা
বুঝছি,আপনেরা খারাপ কাম করতেন না।আমি আপনেগর লগে আছি।
ধন্যবাদ মামা।আমরা তাহলে ঐ ঘরে গিয়ে বসি;রাজু এলেই পাঠিয়ে দিয়েন।
আইচ্ছা মামা।
পৌনে দশটার দিকে রাজু এসে হাজির।রূপাইকে জিজ্ঞাসা করলো,কেমন আছো রূপাই
ভাইয়া?
আমি ভালো আছি রাজু।এখন এসব জিজ্ঞাসা করবার সময় না রাজু।অনেক বড় একটা
কাজ করতে হবে আমাদের।
জ্বি ভাইয়া,বুঝতে পারছি।
হুম।রাজু তুমি ঠিক দেখেছো তো,এই অপকর্মের সাথে মেম্বারের ছেলে আর তার দলই
জড়িত?মানে রাতের অন্ধকারে ভুল দেখোনি তো?
ভুল হবার সুযোগ নেই ভাইয়া।ওদের কয়েকজনের হাতে টর্চলাইট থাকে।টর্চের আলোয়
মুখগুলো আবছা আবছা দেখা যায়।তিনদিন আগে শুনেছি ওরা কথা বলছিলো।
কী বলছিলো ওরা?
একজন বলছিলো,বুঝলা হামিদ,পত্যেক পিস এইবার একশোর নিচ ছাড়ুন যাইবো না।
হামিদ বললো,কী যে কও মুর্শেদ!!এতো দাম দিয়া কেউ কিনবো না।
আরে কিনবো কিনবো।গেরামে বইয়া নেশার ট্যাবলেট পাইতেছে;দাম একশো কেন আরো
বেশি চাইলেই বেইচা শেষ কইরালমু।পোলাপাইনে এ জিনিস ছাড়া থাকবার পারতো না।
তাইলে কাইল থেইকা দাম বাড়াইয়া দেই।দেহি কী হয়।
হেইডাই ভালা হইবো।
রূপাই বললো,বুঝলাম।তোমাকে কেউ দেখেনি তো?

না আমাকে কেউ দেখেনি।জানালার কাছেই দেয়াল আছে না?বিছানায় উঠে দাঁড়ালে
দেয়ালের উপর দিয়ে বাহিরে দেখা যায়;কিন্তু বাহির থেকে কেউ টের পাবে না।
তাহলে ঠিক আছে।শুনো রাজু,আজকে রাতে আমি আর ফরহাদ তোমাদের বাসায়
থাকবো;ওখান থেকেই প্রমাণ সংগ্রহ করা সহজ হবে।আন্টিকে একটু কষ্ট করে রাজি করাতে
পারবে?
আরে কষ্ট কিছুই করতে হবে না।তুমি থাকবে শুনলে মা খুশিই হবে।তোমাকে বাবা-মা
কত আদর করে ভুলে গেছো?
তা ঠিক।তুমি আন্টিকে বলে রেখো;আমরা সন্ধ্যার পরপরই চলে আসবো।তাহলে কিছু
সন্দেহ করবে না।
হুম।আচ্ছা রূপাই ভাইয়া,আমরা ওদের সাথে পারবো তো?
একটু তো ঝুঁকি নিতেই হবে রাজু।
আরে সমস্যা নেই ভাই;আমার বন্ধুর অনেক সাহস।
শুনো রাজু,স্কুল টাইম শেষ হওয়া পর্যন্ত আমরা এখানেই থাকবো।তারপর প্রতিদিনের মতো
সময়ে বাসায় ফিরবে।বলবে,আগামীকাল স্কুল বন্ধ থাকবে।আর একদিন মিথ্যা বলতে হবে।এরপর
আল্লাহ চাইলে সব ঠিক হয়ে যাবে।
হুম।আমাদের পুলিশের সাথে কথা বলা উচিত না?
এখানকার পুলিশ ওদের কিছু করবে না রাজু।পুলিশ কিছু করতে চাইলে এতোদিনে ওদের
মুখোশ খুলে দিতে পারতো।আমাদের উর্ধ্বতন কারো সাথে কথা বলতে হবে।
রাজু বললো,আমার কাছে সাতক্ষীরার এসপির নাম্বার আছে।সপ্তাহ খানেক আগে স্কুলে
এসেছিলো।আমাদের তার কার্ড দিয়েছিলো;কোনো সমস্যা হলে তাকে কল দিতে বলেছিলো।শুনেছি
উনি খুব ভালো মানুষ।ফরহাদ তখন বললো,ওহ হ্যাঁ,আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম।
তাহলে কাল সকালে উনাকে কল করবো;সব প্রমাণ সহ।
হুম।সেটাই ভালো হবে।
রূপাই হঠাৎ জিজ্ঞাসা করলো,তোমাদের কী মনে হয়?গ্রামের আর কেউ এসব ব্যাপারে
কিছু জানে না?
ফরহাদ বললো,এদিককার কিছু চালাকচতুর মানুষ আসতে আসতে ঘটনা আঁচ করতে
শুরু করেছে।কিন্তু কেউ প্রকাশ্যে কিছু করবার সাহস পাচ্ছে না।রাজুও ফরহাদের সাথে পুরোপুরি
একমত।

আ..চ্ছা;তারমানে হলো কয়েকজন যদি দায়িত্ব নিয়ে কোনো ব্যবস্থা করে, তাহলে
বাকিরাও কম-বেশি এগিয়ে আসবে।তাই তো?
একদমই তাই।
রূপাই বললো,তাহলে দায়িত্বটা আমাদেরই নিতে হবে।তার আগে আমাদের লোকসংখ্যা
একটু বাড়াতে হবে।এই ধরো আট-দশ জন।
হয়ে যাবে ভাই।এলাকার ছেলেরা আমরা সবাই আছি।
সাব্বাশ।

[৫]

সন্ধ্যার পর রূপাই আর ফরহাদ বেরিয়ে পড়লো রাজুদের বাসার উদ্দেশ্যে।রাতে একসাথে
থাকা-ওদের এই প্রথম না;আগেও থেকেছে।ছোটবেলা থেকেই তিনজনের খুব ভাব।রাজু দের
বাসায় আকার প্রস্তাবে তাই প্রথমে আপত্তি করলেও পরে আর বাঁধা দেয় নি রূপাইয়ের বাবা-
মা।আর দুই নাতির পক্ষ নেবার জন্য ফজলুল সাহেব তো আছেনই।
রূপাই আসবার সময় একটা ক্যামেরা নিয়ে এসেছিলো;গ্রামের ছবি তুলবার জন্য।কিন্তু
গ্রামে এসে যে খবর শুনেছে,তাতে ছবি তুলবার কথা মনেই আসেনি।তবে ক্যামেরাটা এতো বড়
একটা কাজে লাগবে তা ভুল করেও ভাবেনি সে।
পথে ফরহাদ জিজ্ঞাসা করলো,ক্যামেরা দিয়ে কী করবে ভাই?
বোকা ছেলের কথা শুনো!ক্যামেরা দিয়ে ভিডিও করে রাখবো।এরচেয়ে ভালো প্রমাণ আর
কী হতে পারে বল।
আরেব্…বাস।ফরহাদ আনন্দে প্রায় লাফিয়ে উঠলো।
আরে বেটা আস্তে।কেউ কিছু আঁচ করতে পারলে কিন্তু খুব মুশকিল।
উপস্ সরি।কিন্তু অন্ধকারে ঠিকমতো বুঝা যাবে?
যাবে যে পাগলা,যাবে।রাজু কী বলছিলো শুনিস নি?ওরা টর্চ নিয়ে আসে।ওদের অস্ত্রের
ওদের মাত করতে হবে।
রূপাই ভাই,তুমি জিনিয়াস।
রাত এগারোটা।রাতের খাওয়া-দাওয়া শেষ।রাজুর বাবা-মা শুয়ে পড়েছেন।রূপাই আর
ফরহাদের জন্য আলাদা একটা রুম পরিস্কার করে রেখেছিলেন রাজুর মা।রাজু আপত্তি করে
বললো,তোমরা না খুব বোকা।রাত জেগে তিনজন আড্ডা দিবো বলেই না ওদেরকে বাসায়
ডাকলাম।আলাদা রুমে ঘুমালে লাভটা কী হবে?

আচ্ছা এই ব্যাপার।ঠিক আছে,একসখথেই ঘুমিয়ো।বেশি রাত জেগো না আবার।স্কুল বন্ধ
দেখে বেলা করে ঘুমোলে ধরে মার দিবো সব কয়টাকে।
রূপাই বুদ্ধি করে বললো,আন্টি আপনি টেনশন করবেন না।আমরা বেশি রাত জাগবো
না।আপনারা নিশ্চিন্তে ঘুমান।
তোমার কথায় ভরসা পেলাম বাবা।আমরা তাহলে ঘুমোতে যাই।বয়সটা তো হচ্ছে;বেশি
রাত জাগতে পারি না।
সমস্যা নেই আন্টি;আপনারা ঘুমান আরাম করে।
আহমদপুর গ্রামের দক্ষিণ প্রান্তের শেষ বাড়িটা রাজুদের।ওদের বাড়ির ঠিক বিপরীতে
কবরস্থান।তবে মাঝে বগার বিল।রাজুর ঘরে বিছানার উপর দাঁড়ালে দেয়ালের উপর দিয়ে
কবরস্থানটা দেখা যায়।
ঘড়িতে তখন রাত সাড়ে বারোটার খানিক বেশি।রাজু আর ফরহাদ বিছানার উপর
দাঁড়িয়ে বাহিরে নজর রাখছিলো।আর রূপাই ওদের পিছনে দাঁড়িয়ে ক্যামেরাটা ঠিকঠাক আছে
কিনা যাচাই করে নিলো।একবার ভুল হলেই প্রমাণ হাতছাড়া;তখন আবার নতুন সুযোগের
অপেক্ষায় বসে থাকতে হবে।তাই সতর্কতার বিকল্প নেই।
বইয়ের পাতায় যখন আলেয়া সম্পর্কে পড়তো,রূপাই তখন ভাবতো,যদি কখনো আলেয়া
দেখতে পারতাম।স্বপ্নটাও যে এমন স্বপ্নের মতো করে সত্যি হবে-কে ভাবতে পেরেছিলো?আহ,কী
অপরূপ এক দৃশ্য;চোখ ফেরাতে ইচ্ছে করছিলো না ওদের।জগৎ সত্যিই বড় রহস্যময়;পরতে
পরতে লুকিয়ে আছে রহস্য,রোমাঞ্চ,উন্মাদনা আর?আরো অনেক কিছু;তার কতটুকুই বা আমরা
জানি।যাক সেসব কথা।গল্পপ্রেমী পাঠক কারো ব্যক্তিগত দর্শন শুনতে আগ্রহী নয়।
রাজু,ঘরের দরজাটা লক করে দে।আর বাতিটা অফ করে ড্রিম লাইটটা অন করে দে।
আঙ্কেল-আন্টি ভাববে আমরা ঘুমিয়ে গেছি।ফরহাদ ফিসফিস করে বললো।
রাজু ফরহাদের কথামতো দরজা লক করে ড্রিম লাইটটা অন করে দিলো।বিছানায় উঠে
জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়াবে,এমন সময় ফরহাদ উত্তেজনা মাখা কণ্ঠে বললো,একটা খসখসে শব্দ
পাওয়া যাচ্ছে।
রাজু বললো,ওরা এদিকেই আসছে।পাতার খসখসানি শব্দ।রূপাই ভাই,ক্যামেরা সেট করে
এখানে এসে দাঁড়াও;ওরা এলো বলে।
রূপাই জানালার গ্রিলের ফাঁক দিয়ে ক্যামেরা বাহিরের দিকে ফোকাস করে ভিডিও চালু
করলো।মুখে বললো,এবার ওদের খেলা শেষ হবেই।তোরা চুপচাপ থাকিস কিন্তু,বেশি শব্দ হলে
ওরা সতর্ক হয়ে যেতে পারে।
ঠিক আছে ভাই।তুমি ভালো করে ভিডিওটা করো।
হুম।

ত্রিশ-চল্লিশ সেকেন্ডের মাথায় ফ্রেমে ঢুকে পড়লো মেম্বারের ছেলে হামিদ,চেয়ারম্যানের
ছেলে মুর্শেদ সহ আরো পাঁচ জন।রূপাই হাতের ইশারায় ফরহাদ আর রাজুকে একদম চুপ থাকতে
বললো।
সাত মক্কেল বগার বিলের চারদিকে এক চক্কর দিয়ে কবরস্থানের সামনে চলে
গেলো;কবরস্থানের গেটের সামনে দাঁড়িয়ে সশব্দে শিশ্ বাজালো ওদের মধ্য থেকে কেউ
একজন।ওটা আসলে একটা সংকেত।রাজু দুপুরেই রূপাকে বলেছে সেসব কথা।
রূপাই ক্যামেরা জুম করলো কবরস্থানের গেইটের দিকে।শিশ্ শোনার কয়েক সেকেন্ডের
মাঝে বদরুল চৌকিদার এসে কবরস্থানের গেটটা খুলে দিলো।সবাই ভিতরে ঢুকে গেলে বদরুল
সাবধানে গেট বন্ধ করলো।তার আগে তড়িৎ গতিতে আশপাশটা একটু দেখে নিলো।রাজুর কথাই
সঠিক প্রমাণিত হলো;বদরুল ওদের উপস্থিতি টেরই পেলো না।
কবরস্থানের ভেতরের ঘটনা রাজুর ঘর থেকে দেখা যায় না।রূপাই তাই ভিডিও অফ
করে ক্যামেরা আগের জায়গায়ই ধরে রাখলো।
রূপাই বললো,তোমার সাথে বদরুল চৌকিদারের খুব ভালো সম্পর্ক ছিলো না
রাজু;তোমাকে ‘বড়ভাই’ বলে ডাকতো না?
হ্যাঁ,এখনো তা-ই ডাকে।হঠাৎ এই প্রশ্ন করছো কেন ভাই?!
শোনো রাজু,আগামীকাল সকালে আমরা কবরস্থানে যাবো।ভিডিও করতে করতে একটা
পরিকল্পনা মাথায় এসেছে;বদরুলকে টোপ দিয়ে কথা বের করতে হবে।পরে তোমাদের সব বুঝিয়ে
বলছি।তুমি একটা কাজ করো।আমাদের সাথে আরো কয়েকজনকে লাগবে।তোমাদের কয়েকজন
সাহসী বন্ধুক কল করে সব বুঝিয়ে বলো।আর কালকে সকাল দশটার মধ্যে বগার বিলের ধারে
চলে আসতে বলো।সম্ভব হলে সাথে করে গুলতি নিয়ে আসতে বলো।
রাজু কয়েক মিনিটের মধ্যেই সব ব্যবস্থা করে ফেললো।এর সবচেয়ে বড় কারণটা হলো
এই ভন্ডামি থেকে সবাই মুক্তি পেতে চায়;কিন্তু ঠিক সাহস করে উঠতে পারছিলো না।
বাংলাদেশের মানুষ লড়াই করতে ভয় পায়-এ কথা বলার সাধ্য কারো আছে বলে আমি
মনে করি না।তবে এ কথা মানতে আমরা সকলেই বাধ্য,লড়াইয়ে নামতে আমাদের দীর্ঘ শোষণ-
বঞ্চণার ইতিহাস চাই;দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া চাই।তার আগে আমরা লড়াইয়ে নামবার প্রশ্নই
আসে না।
ভাই,ওরা আসছে।দ্রুতগলায় বললো রাজু।
রূপাই জানালার পাশে এসে আবার ভিডিও চালু করলো।সারিবদ্ধ হয়ে সাত মক্কেল
কবরস্থান থেকে বেরিয়ে আসছে।তাদের মাথায় কাফনের কাপড়ে পেঁচানো কিছু বোঝাই। ওরা
তিনজন বুঝে গেল,ওগুলো সব কঙ্কাল।বদরুল চৌকিদার টর্চ হাতে ওদের এগিয়ে দিচ্ছিলো।
দু-চার মিনিটের ভেতর ওরা দৃষ্টিসীমার বাহিরে চলে গেলো।রূপাই ভিডিও বন্ধ করে
ভিডিওটা সেভ করে রাখলো।জানালা থেকে সরে এসে বিছানায় বসে পড়লো তিনজন-রাজু,রূপাই

আর ফরহাদ।নামগুলো বারবার বলতে খারাপ লাগছে না।বীরদের নাম উচ্চারণ করতে ভালোই
লাগে;আলাদা একটা শান্তি লাগে মনের মধ্যে।
নিজেদের মধ্যে সব পরিকল্পনা সাজিয়ে নিয়ে ওরা ঘুমোতে গেলো।রূপাই
বললো,রাজু,দরজার লকটা খুলে রেখে এসো তো ভাইয়া।
ভলো কথা মনে করিয়েছো ভাই;ভুলেই গিয়েছিলাম।
[৬]

সকাল দশটা।মোট তেরোজন একত্রিত হয়েছে বগার বিলের ধারে।সবাই পনেরো-ষোলো
বছরের ছেলে;রক্ত আগুন হয়ে উঠেছে দ্রোহের উত্তাপে।রূপাইয়ের নির্দেশনা মতো সবাই গুলতি
সাথে করে এনেছে এবং সেগুলো লুকিয়ে রেখেছে।
রূপাই ওদের উদ্দেশ্যে বলছে,শুনো ভাইয়ারা,আমরা তিনজন সব পরিকল্পনা করে
নিয়েছি।আমরা না বললে,আপাতত তোমরা কিছু করো না।এখনকার মতো যা বলার আমরাই
বলছি।
ঠিক আছে ভাই।আপনারা যা করার করেন;আমরা আপনাদের সাথে আছি।
রূপাই সবাইকে ধন্যবাদ জানালো।এরপর কবরস্থানের দিকে হাঁটতে শুরু করলো;তার
পিছনে রাজু,ফরহাদ আর বাকি সবাই।দেখে মনে হচ্ছে কোনো যুদ্ধযাত্রা।তবে যোদ্ধাদের হাতে
ভারী যুদ্ধাস্ত্র তেমন কিছু নেই।যেটা আছে সেটা হলো মগজাস্ত্র।
কবরস্থানের সামনে এসে দরজায় কড়া নাড়লো রূপাই।রাজু ডাকলো,ও বদরুল
ভাই;ভিতরে আছো নাকি?
কেডা?কেডা ডাহে?
বদরুল ভাই,আমি রাজু।দরজাটা একটু গুলো।তোমার সাথে খুব জরুরী কথা আছে।
খাড়াও আইতেছি।
বদরুল চোখ কচলাতে কচলাতে এসে দরজা খুললো।দরজা খুলেই এতোজনকে একসাথে
দেখে বদরুল হকচকিয়ে গেল।তাকে সরিয়ে দিয়ে সবাই ভিতরে প্রবেশ করলো।
বদরুল রাজুর দিকে তাকিয়ে বললো,বড়ভাই তোমরা এতোজন মিল্লা হঠাৎ আমার
এইহানে কেন?কেউ মইরা গেছে নাকি?
রূপাই বললো,গ্রামের কেউ মরে গেলে যে আপনারা খুশি হোন সেটা তো বুঝতেই
পারছি।নতুন লাশ,নতুন কঙ্কাল,কচকচে টাকা-পুরো লালে লাল।তাই না বদরুল সাহেব।

রূপাইয়ের এমন সোজাসাপ্টা কথা বলার কারণেই অনেকে তাকে ভয় পায়।বদরুল
চৌকিদার বা ব্যতিক্রম হবেন কেন!
এইডা কী কথা কইলেন রূপাই ভাই?মাইনষের মউতে আবার কোনো মাইনষে খুশি
হইবার পারে নাকি?
তা ঠিকই বলেছেন,মানুষের মৃত্যুতে মানুষ খুশি হতে পারে না।কিন্তু আপনারা তো
মানুষের কাতারে পড়েন না।
এইবার কিন্তু আপনে বদরুল চৌকিদাররে অপমান করতেছেন।চিৎকার করে বললো
বদরুল।
আহাহা বদরুল ভাই,রাগ করেন কেন?শুনেননি,রেগে গেলেন তো হেরে গেলেন।
না রাগমু না,আপনেরে ফুল দিয়া বরণ করমু।শহর থেইকা সাইব আইছেন একহান।
রাজু বললো,বদরুল ভাই,আপনি আমাদের কথা শুনেন।আমরা কী আপনার পর
নাকি?আমরা জানি তো,লোভে পড়ে একটা ভুল করে ফেলেছেন;কিন্তু আপনি মানুষ খারাপ না।
এইজন্যই তো আপনাকে একটা বিষয়ে সাবধান করতে আসলাম।
আমারে সাবধান করতে আইছো মানে?ইট্টু ভাইঙ্গা কোন তো বড়ভাই।
রূপাই বললো,মন দিয়ে আমাদের কথা শুনেন।কিছুক্ষণ আগে আমরা মেম্বারের বাড়ির
পাশের রাস্তা দিয়ে আসছিলাম।হঠাৎ শুনি,মেম্বারের উঠানে হামিদ আর মুর্শেদ আলোচনা
করছে।একটু রহস্যের গন্ধ পেলাম;তাই আড়াল থেকে ওদের কথা শুনলাম।হামিদ বলছিলো
শুনলাম,”বদরুইল্লার লাইগ্যা আমাগোর লাভের ভাগ কইমা যাইতেছে।ওই হারামজাদারে সরাতে
হইবো।”
মুর্শেদ কী কইলো হুনি।বদরুলের চোখ মুখের দিকে তাকিয়ে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিলো,সে
ওদের কথা বিশ্বাস করতে শুরু করেছে।নয়তো মুর্শেদের কথা জিজ্ঞাসা করতো না।
মুর্শেদ তো বললো,হারামজাদারে আইজ রাইতে সরাইয়া দিতে হইবো।
বদরুল রেগে আগুন।কারবারডা দেখছো বড়ভাই?আপনে দেখলেন রূপাই ভাই?আমারে
ছাড়া গোরোস্থানের ভিতরেই ঢুকবার পারতো না;এহন ধুমাইয়া ব্যবসা করতেছে।লাভের মুখ
দেখছে;অহন আমারে সরাইয়া দিবার চায়।দুনিয়াডার মধ্যে ভালা মাইনষের দাম নাই-বুঝলেন
বড়ভাই?
এটা একটা দামি কথা বলছেন বদরুল ভাই।আমরা তো আরো শুনলাম,আপনাকে মেরে
আপনার কঙ্কালও বিক্রি করার পরিকল্পনা করছে দুজনে মিলে।
আমি এহন কী করমু বড়ভাই?ও রূপাই ভাই,আপনের হুনছি ম্যালা বুদ্ধি।আমারে একখান
উপায় দেন ভাই।

ফরহাদ বললো,আমাদের কথা শুনলে উপখয় একটা হলেও হতে পারে।
কী যে কও ফরহাদ!তোমাগোর কথা হুনমো না তো কাগোর কথা হুনমু।কী করন
লাগবো-হেইডা খালি কও।
রূপাই বললো,শুনেন বদরুল ভাই,আপনি একটা স্বীকারোক্তি দিবেন;সব স্বীকার করে
নিবেন।বলবেন,লোভে পড়ে ভুল করে ফেলেছেন;মানুষই তো ভুল করে,এবারের মতো ক্ষমা করে
দেন।শুদ্ধ করেই বলতে হবে-এমন কিছু না;আপনি আমার মতো করে বলবেন।
এই আপনের বুদ্ধির দৌড়?আপনের মাথায় দেহি আমার চাইতে বেশি গোবর।
পুরো কথা শেষ করতে দেন বদরুল ভাই।এসপি হলো আমাদের রাজুর মামা;রাজু কি
আপনাকে ফেলে দিতে পারবে নাকি?!এসপি সাহেব আপনার ব্যাপারটা দেখবেন।দু-তিন বছরের
মধ্যে আপনি খালাস।একে কঙ্কাল চুরি,তার উপর মাদক চোরাকারবারি,অস্ত্র চোরাচালান-বিশ
বছরের জেল তো হবেই?কী বলিস রাজু?
হ্যাঁ,তা আর বলতে!যাবজ্জীবন ও হাতে পারে।
বিশ-ত্রিশ বছর জেল খাটার চেয়ে দুই-তিন বছর জেল খাটা ভালো না বদরুল
ভাই?দেখেন,ভেবে দেখেন।ঠান্ডা মাথায় ভাবেন।আমারা নাহয় বিকালে আবার আসবো।
আমার ভাবা হইয়া গেছে রূপাই ভাই।আপনে কন,কী জবানবন্দি দেন লাগবো?
রূপাই বললো,আমি ক্যামেরা দিয়ে ভিডিও করছি;আপনাকে যেভাবে বললাম,সেভাবেই সব
স্বীকার করে নেন।আগে এই কাজটা করেন;তারপর ছোট্ট আরেকটা কাজ আছে।এটা আপনার
জন্য বা হাতের খেল।
বদরুল চৌকিদার ক্যামেরার সামনে সব অপরাধ স্বীকার করে নিলো।কারা কারা জড়িত
সবার নাম বললো;মাদক আর অবৈধ অস্ত্র কারা সরবরাহ করতো,কারা কিনতো-সব জানিয়ে
দিলো।শেষে হাতজোড় করে ক্ষমাও চাইলো।হায়রে মৃত্যুভয়!রাতের অন্ধকারে যে কবর খুঁড়ে
কঙ্কাল বের করে আনে,অল্পবয়সী ছেলেমেয়েদের বিষণ্ণতার সুযোগ নিয়ে তাদের নেশায় ডুবিয়ে
দেয়-সে ও এমন গলে পানি হয়ে যায়।
দারুণ হয়েছে বদরুল ভাই।এবার দ্বিতীয় কাজটা বলি।
আপনে কন ভাই;আমি হুনতেছি।
আপনি যদি দ্রুত সময়ের মধ্যে জেল থেকে বেরোতে চান তাহলে যত দ্রুত সম্ভব
বাকিদের পুলিশের হাতে তুলে দিতে হবে।
আমি হেগোরে কেমনে ধরাইয়া দিমু ভাই?

আরে পারলে আপনিই পারবেন।আমি আপনাকে বলছি কী করতে হবে।ওরা আসবার
সময় হলে আপনি সামনে এগিয়ে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবেন।কোনোভাবে ওদেরকে আপনার ঘরে নিয়ে
কিছু খাওয়াবেন;খাবারে মাঝারি মাত্রায় ঘুমের ওষুধ মিশানো থাকবে।খাবার খাওয়ার পর ওরা
যখন কাজ করতে আসবে,ওরা ঝিমুতে থাকবে।এরপর আপনার আর কাজ নেই।আপনি শিষ্
বাজিয়ে সংকেত দিবেন;যা করার আমরা করবো।
আইচ্ছা ভাই;আপনের কথামতো কাম হইয়া যাইবো।
কবরস্থান থেকে বেরোনোর পর সবাই এক হলো বগার বিলের ধারে।রাতের জন্য সব
পরিকল্পনা গুছিয়ে নিলো।আলেয়া রহস্যের আজই পরিসমাপ্তি হবে।সিদ্ধান্ত হলো,পনেরো-বিশজন
একসাথে হয়ে কাজ করবে।একদল সাত মক্কেলকে উত্তম-মধ্যম দিয়ে গাছের সাথে বেঁধে
ফেলবে;সেই গাছ,যে গাছে ক’দিন আগে কঙ্কাল ঝুলিয়ে গ্রামবাসীকে ভয় দেখায় হামিদ-
মুর্শেদরা।অন্যদের গিয়ে খবর দিয়ে নিয়ে আসবে।সকলের সামনেই এদের মুখোশ উন্মোচন করতে
হবে।

[৭]

বগার বিলের বাঁধানো ঘাটে বসে এসপি সাহেবকে কল করলো রূপাই।
হ্যালো,আসসালামু আলাইকুম।
ওয়ালাইকুম আসসালাম।এসপি স্যার কথা বলছেন?
জ্বি বলছি;আপনি কে বলছেন?
স্যার,আমি রূপাই।আহমদপু্র থেকে বলছি।এখানে আমার নানার বাড়ি;বেড়াতে
এসেছি।এখানে খুব বড় একটা সমস্যা হয়েছে স্যার?আপনি এ ব্যাপারে কিছু জানেন?
কই না তো!আমি তো কিছু জানি না।কী হয়েছে বলো তো।
স্যার আহমদপুরে বগারবিলের নাম শুনেছেন তো নিশ্চয়ই।
হ্যাঁ,শুনেছি তো।ওখানে কি কোনো সমস্যা হয়েছে?
সমস্যা বলে সমস্যা!বগার বিলে দুই মাস যাবৎ জ্বিন-ভূতের আনাগোনা বেড়েছে
স্যার।রাত-বিরাতে বগার বিলের পানিতে আলো জ্বলে স্যার।ভৌতিক সব শব্দও নাকি অনেকে
শুনেছে।আপনারা ভূতেদের জন্য রিমান্ডের ব্যবস্থা রাখেননি স্যার?
এসপি সাহেব উচ্চশব্দে হাসলেন।পুলিশ কর্মকর্তাদের সচরাচর এমন উচ্চশব্দে হাসতে শোনা
যায় না।ভূতের জন্য রিমান্ড!হাহাহা।
নখ মানে,দুটো-একটাকে ধরে নিয়ে যদি রিমান্ডে নিতেন,তাহলে বোধহয় আসল ঘটনাটা
জানতে পারতেন স্যার।

”ইউ আর টু ডিফিকাল্ট টু রীড,ইয়াং ম্যান।’ঘুরিয়ে-প্যাচিয়ে আমাকে কিছু একটা বুঝাতে
চাচ্ছো তো?নির্ভয়ে বলে ফেলো;আমি তোমার পাশে আছি।
ধন্যবাদ স্যার।এখানে মাস দুই যাবৎ আলেয়া দেখা যাচ্ছে স্যার;গ্রামের সহজ-সরল মানুষ
সেটা বুঝতে পারছে না।এর সুযোগ নিয়ে মেম্বার আর চেয়ারম্যানের ছেলে বগার বিলের
আশেপাশে একটা ভৌতিক পরিবেশ সৃষ্টি করেছে।রাতের অন্ধকারে কবরস্থান থেকে কঙ্কাল চুরি
করে,গ্রামে মাদক আর অস্ত্রের চোরাচালান অনেক বেড়ে গেছে স্যার।গ্রামের স্কুল-কলেজের ছেলেরা
নেশায় বুঁদ হয়ে বাড়িতে অশান্তি সৃষ্টি করছে;নেশার টাকা জোগাতে অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে।এসব
অপকর্ম এখনই রুখে দিতে হবে স্যার।এরজন্য আমাদের আপনার সাহায্য লাগবে স্যার।
তুমি এক কাজ করো।আহমদপুর যেহেতু তালা থানার অধীনে;তালা থানার ওসির সাথে
গিয়ে একটু কথা বলে দেখো।
স্যার,ওসি সাহেব নিজেই এই অপকর্মের সাথে জড়িত।
আর ইউ সিউর রূপাই?
জ্বি স্যার;আমি শিউর।আমার কাছে প্রমাণ আছে।
তবুও আজকে এবার যাও।তুমি শহর থেকে এসেছো শুনলে ভিন্ন কথা বলতে
পারে।তারপর আমাকে জানাও,কখন কী করতে চাও।আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করবো তোমাদের
সাহায্য করতে।
ধন্যবাদ স্যার।আমি ঘণ্টাখানেক পরে আপনাকে কল করছি।
বেলা সাড়ে এগারোটা মিনিট কয়েক এখনো বাকি।তালা থানায় এসেছে ওরা
তেরোজন।রূপাই এক কনস্টেবলকে ডেকে জিজ্ঞাসা করলো,ওসি সাহেব থানায় আছেন?
জ্বি,স্যার ভিতরে আছেন।কিন্তু আপনারা কারা?
আমি রূপাই;আহমদপুরের ফজলুল ব্যাপারীর নাতি।আপনি ওসি সাহেবকে গিয়ে একটু
বলুন,শহর থেকে ফজলুল ব্যাপারীর নাতি এসেছে।উনার সাথে কয়েকটা বিষয়ে কথা বলতে চায়।
আপনারা এইখানে দাঁড়ান;আমি দেখছি।
মিনিট পাঁচেক পর কনস্টেবল এসে বললো,স্যার ভিতরে যেতে বলছে।
ধন্যবাদ।
রূপাই,ফরহাদ আর রাজু-তিনজন ওসির সাথে দেখা করতে গেলো।বাকিরা থানার বাহিরে
অপেক্ষা করলো।ওরা ভিতরে যেতেই ওসি সাহেব উষ্ণ অভিবাদন জানালেন;আরে ব্যাপারী সাবের
দুই নাতি দেখি একসাথে।বসেন,বসেন;এই এইনে চার কাপ চা দে,সাথে চানখচুর-মুড়ি আন।রাজুর
দিকে ইশারা করে জিজ্ঞাসা করলেন,সাথে ওইটা আবার কে?

ফরহাদ বললো,ও আমার বন্ধু রাজু।
ওসি সাহেব রূপাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন,বাপজান,শোনায় দলবল নিয়া আসছে!ঘটনা
কী বলো তো?সব ঠিকঠাক আছে?ব্যাপারী সাবের শইলডা কেমন?আর ভাবীর ডায়াবেটিস
নিয়ন্ত্রণে আছে তো?
সবাই ভালো আছেন।বেশি ভনিতা না করে রূপাই মূল কথায় চলে আসে।বগার বিলে
জ্বিন আস্তানা গেড়েছে-আপনি শুনেছেন নিশ্চয়ই?
শুনমু না মানে!সাংঘাতিক ব্যাপার;কয়দিন আগে শুনলাম,কর কঙ্কাল আঁকি গাছে ঝুলাইয়া
রাখছিলো।
আপনার এ ব্যাপারে মতামত কী?কোনো তদন্ত করছেন কী?
জ্বিন-ভূতের উপরে কী তদন্ত করমু বাপজান?
না মানে জ্বিনের বংশপরিচয়-কোন বাড়ির ছেলে,বাপ-দাদার আমি কী এসব আরকি।কিছু
জানতে পারলেন?
বিস্মিত হবার ভঙ্গি করে ওসি বললেন,এইটা কী বললা বাবা?জ্বিন-ভূতের আবার
বংশপরিচয়!সেইটা তো খালি আল্লাহই বলবার পারে।
বাহ,খুব আল্লাহভীরু মানুষ দেখছি আপনি!
আল্লাহই তো ভরসা।অপরাধীদের সাথে লড়াইয়ে পুলিশের বড় শক্তি হইলো উপরওয়ালার
উপরে বিশ্বাস।
রূপাই এবার আসল বোমাটা ফাটালো।কিন্তু আমি তো শুনেছি,আপনি আর অপরাধীরা
একই দলের প্লেয়ার।
মানে?কী বলবার চাও?
বলতে কিছুই চাই না ওসি সাহেব।আপনি সবই জানেন।আর জানেন বলেই আপনার
নাকের ডগায় এতোসব ভয়ানক অপরাধ হচ্ছে;আর আপনি থানায় বসে বসে গোঁফে তা দিচ্ছেন।
শুনছিলাম,তুমি শিক্ষার নগরী ময়মনসিংহে পড়ালেখা করো।ভাবছিলাম,বিরাট জ্ঞানী
হইবা।এখন তো দেখতেছি,ঐ পর্যন্ত পৌঁছানোর সুযোগ তুমি নাও পাইতে পারো।
ভয় দেখাচ্ছেন নাকি?
ছি ছি।ব্যাপারী সাবের নাতিরে আমি ভয় দেখাবো!দিনকাল তো ভালো না।তার উপরে
আবার সাপ নিয়া খেলতেছো;তাই একটু সাবধান করে দিলাম।হাজার হোক তোমারে বাপজান
ডাকছি।ভালো-মন্দ একটা কিছু হয়ে গেলে খারাপ লাগবো হয়তো।

আমাকে নিয়ে ভাবার জন্য ধন্যবাদ স্যার।একটা কথা আছে জানেন তো স্যার?চোরের
দশদিন,গৃহস্থের একদিন।
আমারে চোর বললা বাপজান?
না না;চোরদের অপমান করা হবে যে!
পিয়ন এসে চার কাপ চা আর চানাচুর মেখে দিয়ে গেলো।ওসি সাহেব ওদের দিকে চোখ
এগিয়ে দিয়ে বললেন,বাপজানেরা কিছু মুখে দেও।মাথা ঠান্ডা কইরা বসো।তোমাদের কয়েকটা
কথা বলি।
রূপাই চায়ের কাপ আর চানাচুরের ট্রে ওসির দিকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো।
ওসি সাহেব ঠান্ডা গলায় বললেন,তুমি বাপছান নানাবাড়ি বেড়াইতে আসছো;ঘুরো-
ফিরো,বন্ধু-বান্ধব,ছোট-বড় সবাইরে নিয়া আড্ডা দেও,ফূর্তি-ফার্তি করো।খামোখা সাপের লেজে
পা দিয়া কী লাভ বল দেখি।
আসি স্যার;ভালো থাকবেন।দিনকাল তো ভালো না।রূপাই চেয়ার ছেড়ে উঠে
দাঁড়ালো।রাজু আর ফরহাদ ও উঠে পড়লো।টেবিলের উপর থেকে নিজের ক্যামেরাটা নিয়ে রূপাই
থানা থেকে বেরিয়ে এলো।সবাইকে নিয়ে চলে এলো মতিন মিয়ার চায়ের দোকানে।
মতিন মামা তোমার দোকানের পিছনের ঘরের চাবিটা দাও।
মতিন মিয়া চাবি দিলো।দশ-পনেরো মিনিট পরে তুমিও ঐ ঘরে আসো।তোমার সাথে
জরুরী কথা আছে।আইচ্ছা মামা;আপনেরা যান,আমি আইতেছি।
রূপাই ওদের বললো,সব প্রমাণ আমাদের হাতে চলে এসেছে।বদরুলের স্বীকারোক্তি,ওসির
জড়িত থাকার প্রমাণ-সবকিছু।
ওসি জড়িত থাকার প্রমাণ কোথায় পেলে ভাই?রাজু জিজ্ঞাসা করলো।
আমি যখন ওসির সামনের টেবিলে বসেছিলাম,তখন আমার শরীরের সাথে মিশিয়ে ওসির
দিকে ক্যামেরা রেখে দিয়েছিলাম দেখেছিলি?তখন সব ভিডিও করে নিয়েছি।ক্যামেরা শরীরের
সাথে মিশানো থাকায় কেউ কিছু বুঝতেই পারেনি।
আরেব্..বাস।তুমি ভাই সত্যিই জিনিয়াস।
শুনো সবাই;আজ রাতেই ওদের সব ভন্ডামি শেষ।কাল থেকে সবাই আবার বগার বিলের
আশেপাশে অবলীলায় যাবে;তখন সকাল,সন্ধ্যা কিং‌বা মধ্যরাত-যাই হোক না কেন।
আমরা সবাই আপনের সাথে আছি ভাই।রাসেল নামের এক ছেলে বললো।
সময়মতো রাজু আর ফরহাদ তোমাদের সব জানিয়ে দিবে।

ঠিক আছে ভাই।
তোমরা এখন চলে যাও তাহলে;বাসায় গিয়ে সব ঘটনা খুলে বলো।রাতে যখন ওরা ধরা
পড়বে;সবাইকে আসতে বলবে,আমরা খবর পাঠালেই যেন সবাই চলে আসে।
রূপাই,রাজু আর ফরহাদ বাদে সবাই চলে গেলো।রূপাই বললো,এবার এসপি সাহেবকে
কিছু প্রমাণ পাঠাতে হবে;সব পাঠানো যাবে না।কাউকে বেশি বিশ্বাস করা যাবে না।
হুম।এসপি সাহেবকে কখন আসতে বলবে?
রাত একটার পর।
মতিন মিয়া টিনের দরজায় কড়া নাড়লো;মামা আমি ভিতরে আসমু?
আরে আসেন মামা।আপনাকে অনেক বড় একটা দায়িত্ব নিতে হবে।পঁচিশ-ত্রিশটা বাঁশের
লাঠি আর আট-দশজনকে বেঁধে ফেলার মতো মোটা দঁড়ি লাগবে।এই ঘরেই এনে রাখবেন
সব।আর ঘরের এই চাবিটা এখন আমার কাছে থাকুক;সমস্যা নেই তো?
না,সমস্যা নাই।আপনেগোর কাম হইয়া যাইবো মামা।চিন্তা কইরেন না।
আপনাকে অনেক ধন্যবাদ মতিন মামা।

[৮]

রাত সাড়ে বারোটা।বগার বিল থেকে খানিকটা সামনে এগিয়ে দাঁড়িয়ে আছে
বদরুল।রাজুর ঘরের জানালা দিয়ে নজর রাখছে ওরা তিনজন।আরো বিশ-পঁচিশ জন বসে আছে
ওদের বসার ঘরে।একজন গিয়ে মতিন মিয়ার দোকানের পিছনে থেকে লাঠি আর দড়ি নিয়ে
এসেছে।আর মতিন মিয়াকে আধঘন্টা পর কয়লা নিয়ে বগার বিলের ধারে চলে আসতে বলেছে।
রাজুর পরিবার,রূপাই আর ফরহাদের পরিবার,আশেপাশের পাঁচ-দশ বাড়ির সবাই এখন
জানে,কিছুক্ষণ পরেই কী‌ ধামাকা হতে চলেছে।তবে সেই ধামাকার কথা মানুষ জ্বিনেরা কল্পনাও
করতে পারছে না।
দুপুরের দিকে ওসি ফজলুল সাহেবকে কল করে সতর্ক করেছেন;ব্যাপারী সাহবে,নাতি
দুইটাকে সামলান।পরে কিছু হয়ে গেলে কিন্তু কেঁদেও লাভ হবে না।ফজলুল সাহেব রূপাইকে কল
করে বলেছেন,নানাভাই যুদ্ধে নেমেছিল।যুদ্ধে জিততেই হবে।
তোমার নাতি হারতে শিখেনি নানাভাই।তুমি শুধু দোয়া করো।
ছেলেদের এই দুঃসাহসিক পদক্ষেপের কথা জানতে পেরে বেশ ভয় পেয়েছিলো ওদের বাবা-
মায়েরা।পরক্ষণে সেই ভয় রূপ নেয় গর্বে।সবাই-ই ছেলেদের দিলেন যুদ্ধ জয়ের উদ্দীপনা।

বারোটা তেত্রিশ মিনিটে হামিদ আর মুর্শেদ এলো দলবল নিয়ে।বদরলকে কবরস্থানের
বাইরে দেখে ওরা চমকে উঠলো।তুই এইহানে কেন বদরুইল্লা?মুর্শেদ প্রশ্ন করলো।
হামিদ বললো,হারামজাদা ধরা না খাওয়াইয়া ছাড়বো না।
বদরুল কড়া গলায় বললো,আরে রাহেন;বেহুদা গাইল পাড়বেন না।পোলাপাইনে যা শুরু
করছে,আমাগোর এহন সাবধানে কাম করা লাগবো।
হেইডা বুঝলাম।কিন্তু তোর একহাত পিছনে কেন?কী পলাইয়া রাখছস?
মুর্শেদ ভাই যে কী কন!আম্মায় কল দিয়া জানাইছে,আমার বিয়া ঠিক হইছে;মাইয়া পরীর
লাহান সুন্দর।হেই খুশিতে আপনেগর লাইগ্যা মিষ্টি আনছি।আগে খাইয়া লন;পরে কাম করন
যাইবো।পুরা রাইত পইড়া আছে।
সবাই মিষ্টি খেলো।কয়েক মিনিটের ভেতরেই ওদের চোখ ঘুমে আচ্ছন্ন হতে শুরু
করলো।হামিদ বললো,হঠাৎ ঘুম পাচ্ছে কেন?
মুর্শেদ ধর্মকে বললো,দিনের বেলা কী ক্রস আহাম্মক।ঘুমাইতে পারলি না?তাড়াতাড়ি কাম
শেষ কইরা বাড়িত যাইয়া ঘুমাবি।এহন পা চালাইয়া চল।
সবাই যখন কবরস্থানের দিকে যাবে,ততক্ষণে সবার চোখেই রাজত্ব করছে ঘুম ঘুম
ভাব।সুযোগ বুঝে বদরুল শিষ্ দিলো।
রূপাইরা সবাই প্রস্তুত হয়েই ছিলো।রূপাই বললো,আমরা দুটি দলের ভাগ হয়ে যাই।একদল
ওদের উপর আক্রমণ করবো।আরেক দল একটু পিছনে ঝোপের আড়ালে থাকবে;অপশন
বি।আমরা ইশারা দিলেই ওরা এসে ভন্ডগুলোকে ধরে গাছের সাথে বেঁধে ফেলবে।দু-চারজন গিয়ে
লোকজন সবাইকে ডেকে আনবে।এরমধ্যেই এসপি সাহেবের এসে পড়বার কথা।
বদরুল যখন হামিদ-মুর্শেদদের নিয়ে রাজু দের বাড়ি পেরোলো,ছেলে-ছোকরাদের দল
রূপাইয়ের কথামতো দু’ভাগে ভাগ হয়ে গেলো।
রূপাইয়ের নেতৃত্বে দশ-বারোজন গিয়ে ভন্ডগুলোকে বেশ কয়েক মিনিট উত্তম-মধ্যম
দিলো।এরপর রূপাই ইশারা করতেই দ্বিতীয় দলটা এসে ওদের বাঁধতে শুরু করলো।হামিদ,মুর্শেদ
কিংবা ওদের দলের কেউই প্রতিরোধের চেষ্টাও করতে পারেনি।কেননা রছগর মাথায় বদরুল
চৌকিদার বেশ যত্ন করে মিষ্টির প্যাকেটে ঘুমের ওষুধ মিশিয়েছে।সব ব্যাটারা নেশাগ্রস্তের মতো
হয়ে আছে।
ফরহাদ আরো দু-চারজনকে নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে জোয়ান-বৃদ্ধ সবাইকে খবর দেবার
জন্য।অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই বগার বিলের ধারে বেশ একটা উৎসবমুখর পরিবেশ তৈরি হয়ে
গেলো।
মতিন মিয়া ঠোঙায় করে কয়লা নিয়ে এসেছে।প্রথমে একখন্ড কয়লা দিয়ে হামিদের মুখে
এলোপাথাড়ি দাগ টানতে শুরু করলো।তার কাছ থেকে কয়লা নিয়ে বাকিদের মুখেও দাগ টানতে

শুরু করেছে রাজু,রাসেল,বাদল সহ আরো অনেকে।ফরহাদের কাছে খবর পেয়ে ইতোমধ্যে পঞ্চাশ-
ষাট জন এসে ভিড় জমিয়েছে।
এক বুড়ো লোক বললেন,মেম্বারের পোলায় এইটা কোনো কাম করলো!
বিম্রতিতে ধরলে মাইনষে কতকিছুই তো করে মুরুব্বি।আরেকজন উত্তর দিলো।ভাগ্যিস
ব্যাপারী সাবের নাতি আইছিলো;নাইলে আরো কতদিন এই কাম চলতো খোদায় ভাল জানে।
খবর পেয়ে চেয়ারম্যান,মেম্বার সহ গ্রামের মাতব্বর শ্রেণির অনেকেই এসব হাজির
হয়েছিলেন।তবে রূপাইয়ের চটজলদি প্রমাণ উত্থাপনের কারণে সুবিধা করতে পারেননি।রাগের
মাথায় ক’জন তো চটি খুলে মেম্বার আর চেয়ারম্যানকে মারতেই এসেছিলো।রূপাই তাদের শান্ত
করেছে।সবার উদ্দেশ্যে রূপাই বললো,আমাদের কাজ ছিলো ওদের হাতেনাতে ধরা;আমরা সেটা
করেছি।এসপি সাহেবকে খবর দেয়া হয়েছে;উনি এক্ষুনি চলে আসবেন,উনি যা করার করবেন।
রূপাই প্রমাণ পাঠাবার পর এসপি সাহেব উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে
ওসিকে বরখাস্ত করবার ব্যবস্থা করেছেন।যাহোক,সোয়া একটার দিকে এসপি সাহেব এসে
পৌঁছালেন।সাতজনকে গাড়িতে তুলতে নির্দেশ দিলেন।রূপাইয়ের পূর্ব-পরিকল্পনা অনুসারে,এসপি
সাহেব বদরুলকে গ্রেফতারের কথাটা প্রথমে বললেন না।
বদরুল হামিদকে বললো,ভাইজান,আমার উছিলায় ব্যবসা কইরা আমারেই সরানির তার
করলেন?অহন গিয়া জেলের ডাইল-রুডি খান।
রূপাই তার কানে কানে বললো,আপনাদের মনে হয় অনেক হিসেব বাকি আছে।জেলে
গিয়ে হিসেবটা মিটিয়ে ফেলেন না।হিসাব বাকি রাখা ভালো কাজ না।
একজন কনস্টেবল রূপাইয়ের ইশারা পেয়ে বদরুল কে ঘাড় ধরে গাড়িতে তুললো।চল
বেটা,অনেক খেলা দেখিয়েছিল।এবার জেলে বসে যত পারিস খেলবি।
এসপি সাহেব ছেলেগুলোর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,এই ছেলেগুলো আপনাদের
অমূল্য সম্পদ।ওদের খুব যত্ন করে রাখবেন।
গ্রামের শত-শত লোক বিজয়-উল্লাসে মেতে উঠেছেন।আর তারই মাঝে রূপাইদের
জয়ধ্বনি দিচ্ছেন।ওরাই তো আজ বিজয়ের কান্ডারী।
যুগের ধারা জারি রেখে সমাজ,জাতি,দেশের সংকট নিরসনে তরুণদেরই এগিয়ে আসতে
হবে দুর্বার গতিতে।তবেই রচিত হবে একটি আদর্শ সমাজ আর একটি সুন্দর দেশ।

সমাপ্ত

Previous articleশাসনেই হয় সাধন
Next articleহঠাৎ একদিন
প্রতিধ্বনি
প্রতিধ্বনি একটি অনলাইন ম্যাগাজিন। শিল্প,সাহিত্য,রাজনীতি,অর্থনীতি,ইতিহাস ঐতিহ্য সহ নানা বিষয়ে বিভিন্ন প্রজন্ম কী ভাবছে তা এখানে প্রকাশ করা হয়। নবীন প্রবীণ লেখকদের কাছে প্রতিধ্বনি একটি দারুণ প্ল্যাটফর্ম রুপে আবির্ভূত হয়েছে। সব বয়সী লেখক ও পাঠকদের জন্য নানা ভাবে প্রতিধ্বনি প্রতিনিয়ত কাজ করে চলেছে। অনেক প্রতিভাবান লেখক আড়ালেই থেকে যায় তাদের লেখা প্রকাশের প্ল্যাটফর্মের অভাবে। আমরা সেই সব প্রতিভাবান লেখকদের লেখা সবার সামনে তুলে ধরতে চাই। আমরা চাই ন্যায়সঙ্গত প্রতিটি বিষয় দ্বিধাহীনচিত্ত্বে তুলে ধরতে। আপনিও যদি একজন সাহসী কলম সৈনিক হয়ে থাকেন তবে আপনাকে স্বাগতম। প্রতিধ্বনিতে যুক্ত হয়ে আওয়াজ তুলুন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here