মো: আবরারুল হক সা’দ
নিস্তব্ধ রাত্রি
হঠাৎ করে বিকট আওয়াজে কোথাও বজ্রপাত হলো। বজ্রপাতটি ঠিক কোথায় পরলো, তা বোঝা গেলো না। কিন্তু
সেটি যে সামির পড়ার টেবিলের জানালার খুব কাছে কোথাও পড়েছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। সামির কাছে মনে হলো
যেনো তার আশেপাশে কোথাও আকাশ ভেঙ্গে পড়েছে। বসন্তের শেষে গ্রীষ্মের সোভাগমন। তারই যেনো জানান
দিচ্ছিলো ক্রোধে ফুঁসে ওঠা কালবৈশাখি।
কোনো এক অজানা কারণে সামির চোখ আটকে গেলো তার রুমের এক কোণে ঝুলে থাকা দেয়াল ঘড়িটির দিকে। ঘড়ির
ভেতরে দুলতে থাকা পেন্ডুলামের টিক টিক শব্দ যেনো কোনো এক মায়াবি রহস্য নিয়ে সামির হৃদয়ে ধাক্কা দিলো। সামি
খানিকটা অবাকই হলো। এতক্ষণ তো এই শব্দ তার কানে আসেনি! এরপর ঘড়ির কাঁটার দিকে তাকালো সামি। ঘড়ির
কাঁটায় ঠিক তখন রাত ১১টা বেজে ৫৮ মিনিট। বিস্ময়ে সামির মুখ হা হয়ে গেলো। সামি মাথা চুলকাতে লাগলো। এই
কিছুক্ষণ আগেই তো সবেমাত্র একটি অঙ্ক নিয়ে বসেছে সে। এতো তাড়াতাড়ি তিন ঘন্টা চলে গেলো কীভাবে? সামি
আঁচ করতে পারলো বাতাসের সাথে বৃষ্টির বেগ বাড়ছে। বৃষ্টির ফোঁটাগুলো জানালার কাচে ঠক ঠক শব্দ করছিলো। সে
দেরি না করে দ্রুত জানালা বন্ধ করে দিলো। বাইরের প্রকৃতি যেনো অনেক বেশি অস্থির হয়ে উঠেছে। বৃষ্টির শব্দ
আর বাতাসের হুইশ মিলে যেনো এক অদ্ভুত সুর তৈরি করছে। সামি জানালার পাশে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ বাইরের দিকে
তাকিয়ে রইল। তার মনে হলো, প্রকৃতির এই রুদ্র রূপ যেনো সময়ের মতোই অনিয়ন্ত্রিত। সামি আবার তার পড়ার
টেবিলের কাছে ফিরে এলো। কিন্তু পড়ার টেবিলে বসেও তার মন যেনো আর বই এর মধ্যে নেই। আর পড়তে ইচ্ছে করছে
না তার। সে চারপাশে তাকিয়ে লক্ষ্য করলো, বাসার সবাই গভীর ঘুমে অচেতন। ঘরের নিস্তব্ধতা যেনো আরও গাঢ় হয়ে
উঠেছে বাইরের বৃষ্টি ও বাতাসের শব্দের মধ্যেও। সামি বই বন্ধ করে ধীরে ধীরে তার বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লো। নরম
বিছানায় শরীর এলিয়ে দিতেই রাজ্যের ঘুম নেমে এলো তার চোখে। কিন্তু হঠাৎই সামির মনে পড়লো— এশার নামাজ
পড়া হয়নি তার। কিন্তু এখন আর তার বিছানা থেকে উঠতে ইচ্ছে করছে না। সামি মনে মনে ঠিক করলো, এখন আর সে
নামাজ পড়তে উঠবে না। আগামীকাল সময় পেলে পড়ে নিবে। সে প্রায়ই এমন করে। নামাজ পড়তে মনে থাকে না তার। সে
বলে, নামাজ না পড়লে আর কি-ই বা হবে। জাবির সাহেব অনেক বোঝানোর চেষ্টা করেছেন ছেলেকে। লাভ হয়নি।
বৃষ্টির বেগ ক্রমেই আরো বাড়তে লাগলো। সামি তার গায়ের ওপর কম্বল টেনে নেয়৷ রাত তখন ১২ টা বেজে
১৮মিনিট…
বিবেক
সকাল বেলা জাবির সাহেব চা খাচ্ছিলেন আর খবরের কাগজের পাতা উল্টাচ্ছিলেন। হঠাৎ খবরের কাগজের এক কোণে
তার চোখ আঁটকে গেলো। সেখানে লেখা ছিলো,
“পবিত্র রমজান মাসে সেহরির আগে ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় সোমবার মধ্যরাতে নির্বিচারে বোমা
হামলা চালায় দখলদার ইসরায়েল। এতে ৪শ’রও বেশি ফিলিস্তিনির মৃত্যু হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছে গাজার স্বাস্থ্য
মন্ত্রণালয়। বর্বরোচিত এ হামলায় আহত হয়েছেন আরও ছয় শতাধিক মানুষ…”
জাবির সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। আজ মুসলিমরা দেখেও অসহায় এর মতো নিরব ভূমিকা পালন করছে। আজ
মুসলিমরা নিজেদের মধ্যে বিবাদ করতে পারে, কিন্তু নিজেদের শত্রুদের প্রতিহত করতে পারে না। হয়তো সেজন্যই
আজ এতোগুলো প্রাণকে ঝড়ে যেতে হচ্ছে, ঝড়ে যেতে হচ্ছে ছোট ছোট কতগুলো নিষ্পাপ ফুলকে।
জাবির সাহেব আরও একবার দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।
যাত্রা
আজ শুক্রবার। সামির স্কুল নেই। তাই স্বভাবতই তার ঘুম ভাঙতে একটু দেরি হলো। বিছানা থেকে উঠে নিচে নেমে এসে
সামি দেখে বাবা খবরের কাগজ পড়ছেন। বাবার চোখে-মুখে বিষণ্নতার ছাপ। সামি কিছু না বলে খেতে বসে গেলো।
খাবারের মেন্যু দেখে সামির মন খারাপ হয়ে যায়। খানিকটা বিরক্তও বোধ করে সে। মনে মনেই বলে, “আম্মু কি আরো
ভালো কিছু রান্না করতে পারেনা?”
সামি এবার ক্লাস টেন এ উঠেছে। তার ছোট বোন সাদিয়া পড়ে ক্লাস সেভেন এ। বড় ভাই কে অনেক বেশি শ্রদ্ধা করে
সে। তবে সামির ছোট বোনের খবর নেওয়ার সময় নেই। সারাদিন পড়াশোনা আর সহশিক্ষা নিয়ে ব্যস্ত। বড় হয়ে তার
ইচ্ছা বিশ্বের সবচেয়ে ভালো ইউনিভার্সিটিতে পড়বে। তবুও ভাই এর প্রতি কোনো রাগ নেই সাদিয়ার। সেও চায় না যে,
তার জন্য তার ভাই এর সময় নষ্ট হোক।
সামি খাওয়া শেষ করে উঠে পড়লো। আজ দুপুরের পর অঙ্ক প্রতিযোগিতার চূড়ান্ত পর্ব। সেখানে ফার্স্ট প্রাইজ
পাওয়া সামির অনেকদিনের স্বপ্ন। কিন্তু কখনোই সেই স্বপ্ন পূরণ করতে পারেনি সে। আজও তার মনে কিছুটা ভয়
এবং আশা মিশে আছে।
সামি দ্রুত তার রুমে চলে গেলো। তার বন্ধু জায়েদকে ফোন করে বললো,
“জায়েদ, দ্রুত রেডি হয়ে যাও। আমি আগেই বের হতে চাই। আকাশের অবস্থা ভালো না, কোনো রকম রিস্ক নিতে চাই
না।”
জায়েদ ফোনে হেসে উত্তর দিলো, “ঠিক আছে, সামি। আমি পাঁচ মিনিটের মধ্যেই রেডি হয়ে আসছি।”
সামি ফোন রেখে দ্রুত তার ব্যাগ গুছিয়ে নিলো। নোট, কলম, পেন্সিল— সবকিছু ঠিক আছে কিনা তা বারবার দেখে
নিলো। বৃষ্টি থেকে রেহাই পেতে সাথে নিলো ছোট্ট একটি ছাতা। সামি ঘড়ির দিকে তাকালো। ঘড়ির কাঁটায় দুপুর ১২টা
বেজে ৩১ মিনিট। সামি আর দেরি না করে দ্রুত বেরিয়ে পড়লো।
থমথমে
বাইরে বেরিয়েই সামি আকাশের দিকে তাকালো। আকাশে কালো মেঘ জমে আছে, সেই সাথে কেমন গুমোট ভাব। বাতাসে
এক ধরনের বিষণ্ণতার ছাপ। সামির কাছে মনে হলো, প্রকৃতি যেনো কোনো বড় ঘটনার ইঙ্গিত দিচ্ছে। গাছের ডালপালা
নড়ছে না, পাখিরা ডাকছে না, সব কেমন থমথমে হয়ে রয়েছে। সামি রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে এই গুমোট ভাব অনুভব করতে
লাগলো। তার গায়ে এক ধরনের অস্বস্তি অনুভব হতে লাগলো। হঠাৎ মনে হলো, আজ ফজরের নামাজ পড়া হয়নি তার।
পরে পড়বে ভেবে আপাতত নামাজের চিন্তা বাদ দিলো সামি। সে দ্রুত হাঁটার চেষ্টা করলো। বাসার গলি থেকে বের হতে
দশ মিনিটের মতো লাগবে। রিক্সা নেওয়ার উপায় নেই। সামি একবার হাতে পড়া ঘড়িতে সময় দেখে নিলো। ১২টা বেজে
৩৯ মিনিট। সে তার হাঁটার গতি কিছুটা কমিয়ে দিলো। “এখনো তো অনেক সময় আছে”, মনে মনে নিজেকে আশ্বস্ত
করলো সামি।
কিছুক্ষণ পর সামি লক্ষ্য করলো একটি ছোট ছেলে গলির একপাশে শুয়ে আছে। পড়নে হাফ প্যান্ট। গায়ে কোনো জামা
নেই। ছেলেটির মুখ বিবর্ণ ও ফ্যাঁকাসে। সেলশমের মতো সেই দৃশ্য সামির বুকে এসে বিঁধলো৷ সামি ছেলেটির দিকে চেয়ে
রইলো। আশ্চর্য! এর আগেও তো সে অনেক ভিক্ষুককে দেখেছে, আগে তো কখনো এমন হয় নি! সামি ছেলেটিকে কিছু
জিজ্ঞেস করবে করবে করেও করতে পারলো না। সে দ্রুত সামনের দিকে হেঁটে গেলো। গুড়িগুড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। সামি তার
হাতে থাকা ছাতাটি খুলে ফেললো। সেই সাথে হাঁটার বেগও বারিয়ে দিলো। বৃষ্টি নামার পূর্বেই পৌছাতে চায় সে। সে দ্রুত
গলি পার হয়ে একটি রিক্সা নেয়। দরদাম করার সময় নেই!
রিক্সা যখন পৌঁছলো তখন ঘড়ির কাঁটায় দুপুর ১টা বেজে ৫৩ মিনিট। সামি দ্রুত রিক্সা থেকে নেমে ভাড়া মিটিয়ে
ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির ভেতরে ঢুকে গেলো। সেখানেই তো আজকের প্রোগ্রাম। সামি কিছু দূর এগিয়ে যেতেই দেখতে
পেলো জায়েদ, সানাম, আরাফাত আর মাহিন তার জন্য দাঁড়িয়ে আছে। কথা বলার সময় নেই। প্রতিযোগিতা শুরু হতে আর
মাত্র ১৫ মিনিট বাকি। তারা দ্রুত যার যার কক্ষে চলে গেলো।
প্রতিযোগিতা শেষ। ফলাফল অনলাইনে প্রকাশ করা হবে। তাই আজকে আর কোনো কাজ নেই। সামি সবার কাছ থেকে
বিদায় নিয়ে বাসায় ফেরার জন্য রওনা হলো। সে বের হয়ে আবার আকাশের দিকে তাকালো। নাহ, কোনো তারা দেখা
যাচ্ছে না। সে এবার ঘড়ির দিকে তাকালো। “সর্বনাশ! ছয়টা বেজে গিয়েছে! ফিরতে ফিরতে নিশ্চিত রাত হয়ে যাবে।”, মনে
মনে বললো সে।
সামি দ্রুত একটি রিক্সা নিলো। রিক্সা যখন সামনে এগোচ্ছিলো তখন আবার সামির মনে পড়লো, আজকে কোনো
ওয়াক্তের নামাজ-ই পড়া হয়নি তার। সে খুব বেশি চিন্তা করলো না। উল্টো আজকের প্রতিযোগিতার ফলাফল নিয়ে
ভাবতে লাগলো। সে মনে মনে চিন্তা করতে লাগলো, কালকে যদি সে প্রাইজ পেতে পারে, তাহলে সবাই তাকে অনেক
সম্মান করবে। ক্লাসে তার দাম বেরে যাবে অনেক। সে সার্টিফিকেট দিয়ে অনেক কিছু করতে পারবে। এসব ভাবতে
ভাবতে সামির রিক্সা এসে দাঁড়ালো তার বাসার ছোট্ট গলিটির সামনে। ভাড়া দিয়ে সে আবার গলির ভেতরে হাঁটা শুরু
করলো। ছোট গলিতে রিক্সা চলাচলের উপায় নেই।
অন্ধকারাচ্ছন্ন শুনশান একটি গলি। আশেপাশে মানুষজন নেই বললেই চলে। কেবল মাঝে মাঝে দূর থেকে বাতাসের শব্দ
শোনা যাচ্ছে। রাস্তার পাশের ল্যাম্পপোস্টের আলো ম্লান হয়ে জ্বলছে। আর তার নিচে ছায়াগুলো কেমন রহস্যময় হয়ে
উঠেছে। হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ সামি লক্ষ্য করলো যে, ঠিক একই জায়গায় সেই একই ছোট্ট ছেলেটি ঘুমিয়ে আছে।
ছেলেটির শরীরে পাতলা একটি কম্বল জড়ানো, আর তার পাশে ছোট্ট একটি ব্যাগ। সামি অবাক দৃষ্টিতে তার দিকে চেয়ে
রইলো।
সামি বুঝতে পারছিলো না সে কী করবে। সে একবার ভাবলো ছেলেটির সাথে কথা বলে দেখবে। কিন্তু নাহ, এখন রাত হয়ে
গিয়েছে। এই ভেবে সামি ছেলেটির দিকে একবার ভালো করে তাকালো। তারপর ধীরে ধীরে বাড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করল।
আকাশে তখনো কোনো তারার দেখা নেই…।
চিন্তা
সামি বাসায় ঢুকে ফ্রেশ হয়ে আবার পড়ার টেবিলে বসে গেলো। তার ছোট বোন এসে তাকে খাবার দিয়ে গেলো। সারাদিন
কিছু খাওয়া হয়নি, তবুও যেনো কোনো খিদে নেই সামির। পড়ার টেবিলে বসে থাকলেও পড়ার মধ্যে মন নেই। বইয়ের
পাতাগুলো উল্টে যাচ্ছে, কিন্তু পড়া যেনো মাথায় ঢুকছে না। নিজের মধ্যে কেমন যেনো একাকীত্ব ও বিষণ্ণতা অনুভব
করছিলো সামি। “হয়তো অতিরিক্ত জার্নি করার জন্যই এমন লাগছে”, মনে মনে ভাবলো সামি। সে দ্রুত খেয়ে উঠে
পড়লো। আজ আর পড়বে না সে।
আকাশে মেঘের আনাগোনা। সামি শুয়ে শুয়ে আকাশের দিকে তাকিয়েছিলো। বাইরের মৃদু আলো জানালার কার্নিশ ভেদ
করে তার বিছানায় এসে পড়েছে। ঘুম আসছিলো না সামির। মনটা ভারী, চিন্তায় ভরা। হঠাৎ তার বাইরের সেই ছেলেটির
কথা মনে পড়ে গেলো। “আহা! কত কষ্টই না পাচ্ছে ছেলেটি”, মনে মনে বললো সামি।
সে মনে মনে ভাবলো, “সেই ছেলেটির মতো অবস্থা তো আমারও হতে পারতো। আমি কত নিশ্চিন্তে বাসায় বসে পড়তে
পারি, খেতে পারি, ঘুমোতে পারি। কিন্তু ঐ ছেলেটি তো তা পারছে না। তার কি বাড়ি নেই? পরিবার নেই? কত কষ্টেই না
সে দিন কাটাচ্ছে!”
সামি চিন্তাগুলো মাথা থেকে বাদ দেওয়ার চেষ্টা করলো। সে চোখ বন্ধ করলো। ঘুম পাচ্ছে তার। কিন্তু কেমন যেনো
লাগছে। মনের ভেতর এক অদ্ভুত রহস্যময় ভারী ভাব। সামি চোখ বন্ধ করে শুয়ে রইলো। বাইরে মৃদু বাতাসের শব্দ আর
জানালার পাশ দিয়ে আসা আলো যেনো তার মনের বিষণ্ণতা আরো বাড়িয়ে দিলো। ঘড়ির কাঁটায় তখন ১২ টা বেজে ৫৩
মিনিট…।
বজ্রপাত
গভীর রাতে তীব্র শব্দে সামির ঘুম ভেঙে গেলো। চারপাশে মানুষের আওয়াজ, আর্তচিৎকার আর দৌড়াদৌড়ির শব্দ।
সামি তড়িঘড়ি করে বিছানা থেকে উঠে জানালার ভেদ করে বাহিরে তাকালো। পাশের বিল্ডিংয়ে আগুন লেগেছে! আগুনের
লেলিহান শিখা আর ধোঁয়ায় আকাশটা যেন লাল হয়ে গেছে। সর্বনাশ! পাশের বিল্ডিংয়ে তার প্রাণের বন্ধু রাফি থাকে!
সামির বুক কেঁপে উঠলো। সে দ্রুত তার রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। বাইরে আব্বু, আম্মু আর ছোট বোন দাঁড়িয়ে আছে।
সবাই উদ্বিগ্ন চোখে পাশের বিল্ডিংয়ের দিকে তাকিয়ে। বাইরে থেকে ফায়ার সার্ভিসের হুইসেলের শব্দ আসছিলো।
সামি বাইরে বেরিয়ে দেখলো এ্যাম্বুলেন্স এসেছে। ফায়ার সার্ভিসের গাড়িগুলো আগুন নেভানোর চেষ্টা করছে। হঠাৎ
তার চোখ পড়ল এ্যাম্বুলেন্সের দিকে। স্ট্রেচারে কাউকে শুইয়ে নিয়ে যাচ্ছে। সামি আঁতকে উঠলো! সে চিনতে পারলো,
তার বন্ধু রাফি! রাফির অবস্থা ভালো না। তার সমস্ত মুখ কালো হয়ে গেছে, শরীরে পোড়ার চিহ্ন।
সামির চোখে পানি চলে এলো। সে ঠিক করলো, সেও তার বন্ধুর সাথে হাসপাতালে যাবে। রাফির পাশে থাকবে, তাকে
সাহস দেবে। সামি দ্রুত রুমে গিয়ে ব্যাগ গুছিয়ে নিলো। সাথে নিলো কিছু জরুরি জিনিসপত্র, পানির বোতল, আর রাফির
জন্য কিছু জামাকাপড়। তারপর সে এ্যাম্বুলেন্সের দিকে দৌড়ে গেল। ঝিরঝির করে বৃষ্টি হচ্ছে। হাসপাতালের দিকে
এ্যাম্বুলেন্সের গতি যেনো সময়ের সাথে পাল্লা দিচ্ছে।
হাসপাতালে পৌঁছে সামি দেখলো, সেখানে চিকিৎসার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেই। রাফিকে আরেকটি হাসপাতালে নিয়ে যেতে
বলা হলো। অবস্থা ভালো না। হাসপাতালের দূরত্বও অনেক। দ্রুত এ্যাম্বুলেন্স ছেড়ে দিলো। সামির কেমন যেনো ভয়
করছিলো।
রাস্তায় এ্যাম্বুলেন্সের সাইরেন বাজছে না। শুনশান রাস্তা। সাইরেন বাজানোর প্রয়োজন নেই। আশ্চর্য! এতো ব্যস্ত
রাস্তায় একটি গাড়িও নেই! মাঝে মধ্যে এক-দুটি ট্রাক যাচ্ছে। সামির মনে হচ্ছিলো সময় যেনো থেমে আছে।
একা
এখনো বৃষ্টি হচ্ছে। তবে বৃষ্টির বেগ থেকে বাতাসের বেগ বেশি। দমকা হাওয়া বইছে, গাছের ডালপালা দুলছে। রাস্তার
পাশের ল্যাম্পপোস্টের আলো ম্লান হয়ে জ্বলছে। সবকিছু উপেক্ষা করে এ্যাম্বুলেন্স এগিয়ে চলছে। সামি বসে থেকে
জানালার বাইরে তাকিয়ে থাকে। তার চোখে পানি। কখনো এভাবে চোখে পানি আসেনি তার। বাসায়, ক্লাসে, সব জায়গায়ই
সে অনেক হাসিখুশি থেকেছে। কিন্তু আজ তার মনটা ভারী, চোখে অশ্রু।
সামি পকেট থেকে ফোন বের করলো। ঘড়ির কাঁটায় ২টা বেজে ২৩ মিনিট। সে দেখলো, জাহিন ম্যাসেজ দিয়েছে।
কোনোরকম আগ্রহ ছাড়াই ম্যাসেজটি খুললো সামি। জাহিনের ম্যাসেজে লেখা, “অভিনন্দন! আজকের প্রতিযোগিতায়
তুমি চ্যাম্পিয়ন হয়েছো!”
চ্যাম্পিয়ন হওয়ার খবর শুনে সামির মুখে আনন্দের ছাপ পর্যন্ত দেখা গেলো না। খুশি হওয়ার কথা। কিন্তু তার কেমন
যেনো কান্না পাচ্ছিলো। নিজের প্রতি বিরক্তি আর অসহায়ত্ব অনুভূত হচ্ছিলো তার। মনে হচ্ছিলো, এই সাফল্য যেনো
একেবারেই অর্থহীন। সে ফোনটা পকেটে রাখলো।
সামি এক দৃষ্টিতে জানালার বাইরে তাকিয়ে ছিলো। তার কাছে পৃথিবীটা কেনো যেনো অনেক ছোট মনে হচ্ছিলো। হঠাৎ
করে তার আবার মনে পড়ে গেলো সেই ছোট্ট ছেলেটির কথা। সামির তো পরিবার আছে, বাবা-মা আছে। যারা তাকে
সবসময় ভালোবাসে, যত্ন করে। কিন্তু ঐ ছেলেটির তো কোনো পরিবার নেই। বাবা-মা নেই। সামির কাছে তো জামা-কাপড়
আছে, সে খেতে পারে, নিশ্চিন্তে ঘুমোতে পারে, পড়াশোনা করতে পারে। বড় বড় স্বপ্ন দেখতে পারে। কিন্তু ঐ ছেলেটি
কি এত কিছু করতে পারে? তার তো কোনো সুযোগই নেই। সামির আজ বৃষ্টির হলে ভিজতে হয় না, ঘরের মধ্যে নিরাপদে
থাকতে পারে। কিন্তু ঐ ছেলেটির তো কোনো উপায় নেই। বৃষ্টি, ঠান্ডা, গরম— সবই তাকে সহ্য করতে হয় রাস্তার
ধারে। অন্যদিকে এতো কিছু পেয়েও সামির তৃপ্তি হয় না।
সংঘর্ষ
সামি অনুশোচনায় দগ্ধ হতে লাগলো। তার চোখে পানি চলে আসে। সে রাফির দিকে তাকায়, যার মুখে অক্সিজেন মাস্ক,
শরীরে নানা রকম তার জড়ানো। সামি ভাবে, আজ তো রাফির মতো অবস্থা তারও হতে পারতো। আল্লাহ তাকে সুস্থ
রেখেছেন, এত রহমত দিয়েছেন, এতো নেয়ামত দিয়েছেন। কিন্তু তাও সে নামাজ পড়ে না। ভালো কাজ করতে চায় না।
বাবা- মার কথা শোনেনা। সে আজ পৃথিবী নিয়ে ব্যস্ত। পড়াশোনা, সফলতা, প্রতিযোগিতা— এসব নিয়ে মগ্ন। কিন্তু
মৃত্যুর পর কি এসবের কোনো অর্থ আছে?
আচমকা বিকট শব্দে চারপাশ আলোকিত হয়ে গেলো। সামি দেখলো, তাদের এ্যাম্বুলেন্স একটি ট্রাকের ধাক্কায়
উলটে যাচ্ছে। সে আতঙ্কে চিৎকার করে উঠলো। হঠাৎ তার চারপাশে সবকিছু অন্ধকার হতে শুরু করলো। সে কেমন
একটি আওয়াজ অনুভব করতে লাগলো। সেই সাথে দেখতে পেলো অন্ধকারাচ্ছন্ন একটি ছায়া। যেটি মানুষের নয়! ধীরে
ধীরে সামির চোখ বন্ধ হয়ে গেলো।
কিছুক্ষণ পর সামির চোখ খুললো। সে দেখতে পায়, চারপাশে সব কিছু অন্ধকার হয়ে আছে। তার সামনে কেউ একজন
দাঁড়িয়ে আছে। তার পরনে কালো আলখাল্লা। সামির মুখ দিয়ে কোনো আওয়াজ বের হচ্ছিলো না। সে চেষ্টা করলো
চিৎকার করতে, কিন্তু কোনো শব্দই বেরত হলো না। সে চারপাশে ভালো করে তাকালো। কোথাও কেউ নেই। তার বুক
ধড়ফড় করতে লাগলো। হঠাৎ সে শুনতে পায় কেউ একজন বলছে,
“মানুষের কাছে সুশোভিত করা হয়েছে নারী, সন্তান, স্বর্ণ ও রৌপ্যভান্ডার, চিহ্নযুক্ত অশ্বরাজি, গৃহপালিত পশু এবং
শস্যক্ষেত্র। এসব পার্থিব জীবনের সম্পদ। আর আল্লাহ -তাঁরই নিকট রয়েছে উত্তম আশ্রয়স্থল।”
সামি কথাগুলোর অর্থ বুঝতে চেষ্টা করলো। সত্যিই তো। সে দুনিয়ার মোহে এতটাই মগ্ন ছিল যে আখিরাতের কথা
ভুলেই গিয়েছিলো। আবারো সেই কণ্ঠ থেকে শোনা গেলো,
“হে ঈমানদারগণ! তোমাদের কী হলো? যখন তোমাদের বলা হয়, আল্লাহর রাস্তায় বের হও, তখন তোমরা মাটি জড়িয়ে
ধরো? তবে কি তোমরা আখেরাতের পরিবর্তে দুনিয়ার জীবনে সন্তুষ্ট হলে? অথচ দুনিয়ার জীবনের ভোগ-সামগ্রী
আখেরাতের তুলনায় একেবারেই নগণ্য।”
কথাগুলো সামির বুকে তীরের মতো বিঁধলো। সে আফসোস করতে লাগলো। অনুশোচনায় ভেঙে পড়ল। কেনো এত অন্ধ ছিল
সে? কেনো আল্লাহর পথ থেকে দূরে সরে গিয়েছিলো? হঠাৎ সে দেখলো কেউ একজন তার দিকে এগিয়ে আসছে। সামি
তার মুখ দেখতে পেলো না, কিন্তু ভয়ে তার গা শিউরে উঠল। সামি হঠাৎ বুঝতে পারলো, সে কথা বলতে পারছে।
সামি ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলো,”আপনি কে?”
লোকটি রূঢ় কন্ঠে জবাব দিলো, “তুমি গতকাল একটি পরিক্ষায় ভালো ফলাফল করেছো?”
সামি ভয়ে ভয়ে উত্তর দিলো, “হ্যাঁ। কিন্তু আপনি কীভাবে জানেন?”
লোকটি আবার জিজ্ঞেস করলো, “তুমি কি পৃথিবীর ভোগ-বিলাস, মায়া- মমতা, সম্মান অনেক বেশি পছন্দ করতে না?
সামি মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো।
লোকটি বলল, “এবার আমার মূল প্রশ্ন। যখন তোমাদের এ্যাম্বুলেন্স উলটে যাচ্ছিলো, তুমি মৃত্যুর একদম কাছাকাছি
ছিলে। সেই মুহূর্তে তোমার মাথায় প্রথম কী চিন্তা এসেছিলো? যদিও তোমার কাছে সময় ছিল খুবই অল্প।”
সামি বললো, “আমি কিছু ভাবার সময় পাইনি। শুধু একটি বারের মতো চেয়েছিলাম, আমার জীবনের যেনো কিছু না হয়।
লোকটি এবার হাসির মতো শব্দ করলো। তারপর বলল, “সর্বনাশ! তুমি তোমার পরিবারের কথা ভাবলে না? তোমার
প্রিয় বন্ধু রাফিসহ অন্যান্য বন্ধুদের কথা? তোমার এত দিনের স্বপ্ন, সেই প্রাইজের কথা? তোমার সম্মানের
কথা? অথচ, এসবই তো ছিল তোমার প্রিয় বস্তু!”
সামির মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। সে হতবাক হয়ে গেলো। সত্যিই তো! এভাবে তো কখনো ভেবে দেখেনি সে।
যেসবের জন্য এত কষ্ট করেছে সেগুলোকেই সে ভুলে গেলো কীভাবে?
সামির কাছে সব পরিষ্কার হতে শুরু করলো। বাবা হয়তো তাকে এই মুহূর্তগুলোই বোঝানোর চেষ্টা করতেন। কিন্তু সামি
শুনেনি। সে নামাজ পড়েনি। বাবার কথাগুলো অনর্থক ভেবে উড়িয়ে দিয়েছে। অনুশোচনায় আর কষ্টে সামি নিঃশব্দ হয়ে
গেল। মনে মনে বললো, “আর কি কোনো সুযোগ নেই? আমি আর কখনো নামাজ বাদ দেব না। দুনিয়া নিয়ে পড়ে থাকব না।
কিন্তু গুনাহ করেছি অনেক। এগুলোর ক্ষমা এতো তাড়াতাড়ি পাবো কীভাবে?”
হঠাৎ লোকটি বলে উঠল, “দুঃখিত সামি। তোমার সময় শেষ। তোমার মতোই অনেকেই মৃত্যুর পর আফসোস করবে।
কিন্তু কোনো লাভ নেই। তাদের জ্বলতে হবে ভয়ঙ্কর আগুনে। তাদের জন্য রয়েছে ভয়ানক শাস্তির ব্যবস্থা।”
এসব শুনে সামি আঁতকে উঠল। তার চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়লো। সে লক্ষ্য করল, লোকটি ধীরে ধীরে অদৃশ্য হয়ে
যাচ্ছে। সেই একই কন্ঠ থেকে আবার শোনা যাচ্ছে,
“তোমার কিতাব (আমলনামা) পাঠ কর; আজ তুমি নিজেই তোমার হিসাব- নিকাশের জন্য যথেষ্ট।”
সামি অনুভব করলো চারদিক থেকে মাটি চেপে আসছে। সামির শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল। সে বাবা-মাকে ডাকবে ডাকবে
করেও ডাকল না। সে জানে, এখন আর কেউ তাকে সাহায্যের জন্য আসবে না। সে আল্লাহকে ডাকতে লাগল। এভাবে
কখনো রবকে ডাকেনি সে। সে বুঝতে পারলো, আজ আল্লাহ ছাড়া সাহায্যকারী কেউ নেই। সামি বুঝতে পারলো মাটি
আরো বেশি চেপে যাচ্ছে। সে শেষবারের মতো চিৎকার করে উঠলো, “হে আল্লাহ! দয়া করে আমাকে মাফ করে দিন!”
আলো
সামি হুড়মুড় করে বিছানা থেকে উঠে বসে। তার শরীর ঘামে ভিজে গেছে। সামি বুঝতে পারে, এতক্ষণ সে স্বপ্ন
দেখছিলো। সে শুনতে পায়, ফজরের আজান হচ্ছে। সামি নিজের মধ্যে এক ধরনের আতঙ্ক অনুভব করে। সে দ্রুত
বিছানা থেকে নেমে জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়। নাহ, সব ঠিক আছে।
বাইরে এখনও গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। সামি হঠাৎ বুঝতে পারে, আল্লাহ তার প্রতি রহম করেছেন। তাকে পথ
দেখিয়েছেন। তাকে সুযোগ দিয়েছেন। সামি নিজেকে ভাগ্যবান মনে করে। এমন সুযোগ তো সবাই পায় না। সে প্রতিজ্ঞা
করে, সে আর কখনো নামাজ বাদ দেবে না। নিয়মিত কুরআন পড়বে। বেশি বেশি দান করবে। ভালো কাজ করবে। কিন্তু
সে চিন্তিত হয়ে যায়, কীভাবে সে এত গুনাহ থেকে রক্ষা পাবে?
সামি কিছুটা আশা এবং খানিকটা কষ্ট নিয়ে পড়ার টেবিলের জানালার সামনে এসে দাঁড়ায়। কুরআন তেলাওয়াত শোনার
ইচ্ছা হয় তার। সে ইউটিউবে সার্চ করে প্রথম যে ভিডিওটা আসে, সেটাই শোনার জন্য খুলে। সামি প্ৰশান্তি খুঁজে পায়।
এরকম শান্তি সে আগে কখনো পায়নি।
হঠাৎ তার দৃষ্টি চলে যায় একটি আয়াতের বাংলা অনুবাদের দিকে। তেলাওয়াত করা হচ্ছিল,
“আর কেউ যদি কোনো মন্দ কাজ করে অথবা নিজের প্রতি যুলুম করে পরে তা বর্জন করে এবং আল্লাহর কাছে ক্ষমা
প্রার্থনা করে, তাহলে সে আল্লাহকে ক্ষমাশীল এবং পরম দয়ালু হিসেবেই পাবে।”
সামি আশার আলো নিয়ে আকাশের দিকে তাকায়। মেঘগুলো সরে যেতে শুরু করেছে। বাতাসে একধরণের সুঘ্রাণ ভেসে
আসছে। প্রকৃতি যেনো নতুন করে জেগে উঠছে। আকাশে একটি-দুটি করে ঝিলিমিলি তারাও উঁকি দিতে শুরু করেছে…
