অলিখিত স্মৃতির নীলে

0
112

সুন্দরী

বৃষ্টির পানির টুপটাপ শব্দ পুরো বাড়ীর নিরবতা ভেঙে দিচ্ছে। জানালা গলে বৃষ্টির ছিটা ডুকছে ঘরে। জানালার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা এই আমিটা জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে। কেমন গুমোট বাঁধা প্রকৃতি। জোছনার আলো- আধারিতে আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, নদীর নীল জলে কার যেন একটা পুরুষালি অবয়ব কবিতা আবৃত্তি করছে। সেই সুরের মুর্ছনা নির্জন প্রকৃতির বুকে প্রতিধ্বনি তুলে ঠিকরে পড়ছে দিকবিদিক। কিন্তু শত চেষ্টায় আমি সেই ছায়ালোক কে চিনতে পারলাম না। জোছনার আলোয় আমি স্পষ্ট দেখতে পেলাম, কেউ একজন বাড়ীর সদর দোড় খুলে এগোতে লাগলো – সেই নদীর পানে। শুভ্র শাড়িতে মোড়া নববধূ, লম্বা কালো চুলের স্পর্শে বাতাসে এক অদৃশ্য সুর বাজে। চোখে এক অনন্ত প্রতীক্ষার আলো—যেন শত জন্মের প্রতিশ্রুতি আজ পূর্ণতার দিকে এগোচ্ছে। আমি তাকে ডাকছি তো ডাকছি। কিন্তু কিছুতেই সাড়া দিচ্ছে না সে। কন্ঠ আমার ক্ষীণ হয়ে আসছে,হাত-পা আমার অবশ হয়ে গিয়েছে। নড়তে পারছি না। আস্তে আস্তে চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে।
আর তখনই আমার ঘুম ভেঙে যায়।
ওহ, স্বপ্ন ছিল এটা! গলা আমার শুকিয়ে গিয়েছে। কি অদ্ভুত স্বপ্ন। বিছানায় শুয়ে থাকা অবস্থায় আমি অনুভব করলাম,বাইরের প্রচন্ড শীত আবহাওয়ার মধ্যে ও আমার পুরো শরীর ঘামে ভিজে গিয়েছে। বেশকিছুদিন ধরেই এই স্বপ্ন দেখে আমার ঘুম ভাঙে। নাহ, খুব ক্লান্ত আমি।

সকাল হয়েছে সে অনেকক্ষণ হলো। শীতের সকাল, মৃদুমন্দ বাতাসে উড়ছে চুল, তেজহীন সূর্যের কিরণ। এমন সকাল এখন আমার নিত্যসঙ্গি। আজও জানালা গলে চিঠি এসেছে। এই নিঃসঙ্গ চিঠি যেন হৃদয়ে অনুরণন তোলে। এটা নিয়ে আটখানা চিঠি হলো। এই যুগেও কি কেউ চিঠি পাঠায়! চিঠির শেষে লেখা – “নীলাবতি”, যেন এক পুরোনো যুগের নিঃশ্বাস ফেলে যায়। সবগুলো চিঠিই নীলাবতি নামে কাউকে সম্বোধন করে লেখা। আজকে যে চিঠিটা এসেছে তাতে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা –

” নীলাবতি, আজ রাতে আকাশে চাঁদ উঠিবে। পূর্ণিমা যে আজ। নদীর নীল জলে চাঁদের আলো পড়ার দৃশ্য বড়ই অপরুপ। তোমার লাগি সোজন বাদিয়ার ঘাটে অলোকনন্দার নীচে অপেক্ষায় রহিব। বেনীমাধব”।

চোখ আটকে যায় ” বেনীমাধব ” অক্ষরের মধ্যে। সবগুলো চিঠিতেই রয়েছে এক প্রাচীন শব্দশৈলির বুনন। বুঝলাম এখানে কিছু চাপা রহস্য খেলা করছে। কিন্তু কিছুতেই কিছু বুঝে উঠতে পারলাম না।

এই চিঠি পাওয়ার সুচনা হয়েছে আজ থেকে দুমাস আগে। আমি, মায়ের সাথে গ্রামের বাড়ীতে এসেছি। আমার দাদিমার শেষ ইচ্ছে, তিনি জীবনের বাকি আর যে কটা দিন বাঁচবেন, তার নিজের বসতভিটায় থাকতে চান। আমি এই বিষয়টাতে ভারী বিরক্ত। এই দাদি মানুষটা বড়ই অদ্ভুত। অদ্ভুত বলতে ইকটু বেশিই অদ্ভুত। এখানে আসার আগে দাদিমা আমাদের সাথেই থাকতেন। সারাদিন কাঁথা সেলাই করতেন , দেয়ালে কি যেন আঁকতেন, আর রাত হলে একাই কি সব বিড়বিড় করতেন। আর প্রায়শই আমাকে একটা গল্প বলতেন। গল্পটা শুরু হতো খুব সাদামাটা ভাবেই। একটা দোতলা বাড়ী, একটা ঘর নিয়েই। আর সেই গল্পে ছিল এক জোড়া কপোত- কপোতি। একই গল্প দাদিমা একেক দিন একেক ভঙ্গিতে বলতেন। কিন্তু দাদিমা এখন মোটেই কথা বলতে পারেন না। এখন তিনি মৃত্যু সজ্জায়। সারাদিন শুয়েই কাঁটায়। তাই দাদিমার শেষ ইচ্ছে পূরণ করতে মা -বাবা আর আমার ছোট বোন এখন দাদিমার বাড়ীতেই থাকা শুরু করেছে।

আমি নিধি। এবার অনার্স চতুর্থ বর্ষের ছাত্রী। পড়ছি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে। আমার ভার্সিটির ছুটিতে প্রায়ই আসা হয়, থাকা হয় দাদিমার এই বাড়ীতে। দাদিমার বাড়ী বলছি কারণ – শুনেছি দাদু নাকি দাদিমা কে এই বাড়ীটা উপহার দিয়েছিলেন। কি রোমান্টিক!!
এ বাড়ীতে ঢুকতেই চোখে পড়ে, বাড়ীর নামখানা। বড় নেমপ্লেটে খোদাই করা – ” স্মৃতিলতা নিকেতন”।
বড় বড় ইটপাথরে বাঁধা এক চোখ ধাঁধানো গঠন শৈলি এ বাড়ীটার। শুনেছি, এটা নাকি পূর্বে জমিদার বাড়ী ছিল। তা অবশ্য এ বাড়ীটা দেখলেই বোঝা যায়। প্রকান্ড দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই এ বাড়ীর বিশালতা দেখে যে কারোরই চোখ ধাঁধিয়ে যাবে। আমার এ বাড়ীতে আগে দু তিন দিনের বেশি থাকাই হয়নি। তাই ঘুরে দেখার তেমন সৌভাগ্য হয়নি। কিন্তু বিপত্তি সৃষ্টি হয়েছে এইবার ভার্সিটির বন্ধতে এসে। এসেই শুনি, সারাদেশে অধ্যাদেশ জারি হয়েছে, কারফিও সব জায়গায়। তার মানে কম পক্ষে এক থেকে দুইমাস সব যাতায়াত ব্যবস্থা বন্ধ।

প্রথম দিকটায় শহরের কোলাহল আর চাকচিক্যে মোড়া জীবন ছেড়ে এই গ্রামে থাকতে হবে ভেবেই খুব করে বিরক্ত হচ্ছিলাম। কিন্তু পরবর্তী তে পরিবারের সাথে, এই গ্রামীণ পরিবেশে বেশ কিছুদিন থাকতে পারবো ভেবে বেশ ভালোই লাগছিলো। আমার আনাগোনা ছিল শুধু এই বাড়ীর চার দেয়ালের মধ্যে ই। এর একটা কারণও রয়েছে। দাদিমার বাড়ীটা অনেক টা জায়গা জুড়ে হওয়ায়, এর থেকে অনেকখানি দুরে অন্য মানুষদের বসতি। আর তাছাড়াও বাবার বারণ ছিল, বাড়ীর বাইরে বেশি দুর যাওয়ার। কারণ টা কি ; সেটার উত্তর চাইলে বাবা কোনো কিছুই বলেনি। বাবার আরেকটা নিষেধাজ্ঞা ছিল। আর সেটা হলো বাড়ীর দোতলায় যাওয়া। কারণ টা জিজ্ঞেস করায় বলা হয়েছে ; দোতলা টা নাকি চল্লিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে বন্ধ রয়েছে। তাই সেটা নাকি এখন পোকামাকড়ের ঘরবসতির আস্তানা। কিন্তু আমার কেন জানি, সেরকম কোনোকিছু মনে হলোনা। প্রায়ই রাতে যখন আমি পায়চারী করি, আমার মন বলে, কোনো এক চাপা কন্ঠস্বর ভেসে আসে দোতলা থেকে। কেমন করুণ এক ধ্বনি যেন প্রতিধ্বনি তোলে পুরো বাড়ী জুড়ে। আনমনে দোতলার পানে তাকালে মনে হয়, কেউ যেনো আছে, আমাকে ডাকে, কেমন একটা ছায়া খেলা করে চারিধারে। কিন্তু কিছুতেই কিছু বুঝতে পারিনা। এই যুগের মেয়ে আমি। ভুত প্রেত অসোবে তো বিশ্বাস একদমই নেই। তাই হ্যালোসিনেশন ই ধরে নিয়েছি।
তখন প্রায় ভর দুপুর। মৃদু রোদ চারিদিকে। উঠনে বসে গায়ে রোদ মাখছি। দেখলাম ছাদের কার্ণিশ ঘেঁষে একটা হলদে খাম।
চিঠির কাগজে আঁচ ছিল, ছিল পুরোনো বুকশেলফের ঘ্রাণ। চিঠির লেখাটা এরুপ –

” অপেক্ষা বড় জটিল শব্দ, নীলাবতি। এই শব্দখানা বুকে বড় পীড়া দেয়। তোমাকে দেখিনা বহুদিন। তোমাকে তেমন করে আমার চেনাও হয়নি। এবার তাহলে অপেক্ষার পালা শেষ হোক।কথা হোক, আবার শুরু হোক সেই প্রথম থেকেই “।

আবারও চিঠি! কোনো মানেই আমি বুঝলাম না। কে চিঠি দিচ্ছে, কেন দিচ্ছে আর এই নীলাবতি টাই কে ; হাজারখানা প্রশ্ন মাথার ভেতর ঘুরতে লাগলো। কিন্তু মগজ হাঁতরে কোনো উত্তর খুঁজে পেলাম না। ভাবলাম ভুলবশত চলে এসেছে। কিন্তু তাই বলে ন খানা চিঠি। তাও আবার এইরকম ডিজিটাল যুগে। অতঃপর এই সব চিঠিগুলো কে ভিত্তিহীন বলেই ধরে নিলাম।

কিন্তু ইতিহাস কি কেউ কোনোদিন ভুলিতে পারে, আদৌও কি সম্ভব! যে সত্য গাঁথা আছে এই ইট পাথরের বাড়ীতে ; সেই সত্য কিভাবে ভুলবো? কত কিছুই তো আমার অজানা।

এক অলস বিকেলের কথা। টানা তিনদিন ধরে বৃষ্টি। কেমন স্যাঁতস্যাঁতে পরিবেশ পুরো বাড়ী জুড়ে।বদ্ধ বাড়ীতে অলস সময় কাটাচ্ছিলাম। পুরো বাড়ীতে শুধু আমি আর আমার ছোট বোন আর কাজের মহিলা – রহিমা খালা।
রহিমা খালার ব্যাপারে যদি ইকটু বলি, তাহলে বলবো, তিনি কেমন গুমোট প্রকৃতির একজন মানুষ। কথা কম বললেও ; মাঝে মাঝে এমন কথা বলেন, যা শুনলে গাঁ শিউরে ওঠে। আমাদের আসা র আগে তিনিই এই পুরো বাড়ীর দেখাশোনা করতেন।
বাবা – মা দাদিকে নিয়ে আজ শহরে গিয়েছে। সিদ্ধান্ত নিলাম -পুরো বাড়ীটা ইকটু ঘুরে দেখবো। পুরোনো বাড়ীর প্রতিটি ইট যেন তখন আমাকে ডাকছিল। পায়চারী করছি বাড়ীর এ মাথা থেকে ও মাথা। আমি মানুষ টা বড্ড চঞ্চল তো। কোথাও দুদণ্ড স্থির হয়ে আমার বসা হয়না।
বাড়ীর নিচতলায় যখন আমি পায়চারী করছিলাম – আমি খেয়াল করলাম, রান্নাঘরের একেবারে শেষ মাথায় একটা দরজা। এটা আগেও অনেকবার চোখে পড়েছে। কিন্তু তেমন করে খেয়াল করা হয়নি। আজ খেয়াল করলাম তা সামান্য খোলা। তারই ফাঁকে মৃদু আলো আসছে। এটা কি করে। আমি আসার পর একবারও এদিকটার দরজা খোলা দেখিনি। খালার ভাষ্যমতে, এটা চল্লিশ বছর আগে থেকেই তালা বদ্ধ। তাহলে? আমি এবার দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। আসলেই দরজাটা খোলা। মনে হচ্ছে, এই দরজা যেন নিজ ইচ্ছেতেই খুলে গেছে। দরজাটা ধাক্কা দিয়ে খুলতেই লক্ষ্য করলাম – এটা দোতলার দিকে চলে গিয়েছে। গোপন দরজা! আমি যেহেতু আইন বিভাগের শিক্ষার্থী ; তাই বরাবরই এইসব বিষয়ে আমার উদ্বেগ ইকটু বেশিই বলা চলে।
তাই দোতলায় যাওয়ার জন্য নিলাম একটা হারিকেন। তারপর আলো আধারিতে, ছুট লাগালাম সেই সিড়ি বেয়ে। এই সিঁড়িটার শেষ হলো – দোতলায় গিয়ে। দোতলা টা আস্ত ইটে বাঁধানো, মোজাইকের কাজ করা ফ্লোরে। হারিকেনের আলোটা বাড়িয়ে এগিয়ে চললাম। দেখলেই বোঝা যায়, এ পথে অনেকদিন ধরেই কারো আসা – যাওয়া হয়না। দোতলার যেদিকটায় দাঁড়িয়ে আছি, সেখানে পরপর চারটা রুম, সবগুলোতেই তালা। কিন্তু সিঁড়ি বেয়ে নামতেই একটা কক্ষের সামনে এসে দৃষ্টি আটকে গেলো। দোতলার একেবারে কোণার দিকে একটা রুম। বাকি রুম গুলো থেকে দেখতে আলাদা। সুন্দর পর্দা দিয়ে ঘেরা আর দরজায় ও কতশত ফুল আঁকা। দেখে ই মনে হচ্ছে, এই ঘরটাকে বাকি ঘরগুলো থেকে আলাদা স্থান দিয়েছে আর আয়তনেও বেশ প্রকান্ড। দরজার ওপারে কি আছে সেটা দেখার জন্য মরিয়া হয়ে উঠলাম।
কিন্তু বিপত্তি ঘটলো দরজা খোলা নিয়ে।
ঘরটা তো লক করা। তালা দেওয়া নয়। অন্যরকম লক। এ আবার কেমন লক সিস্টেম! একেবারে ভিন্ন। আদিম কালের মতো। আগে যেমন পাসওয়ার্ড বা পিন সিস্টেমের লক থাকতো ঠিক সেরকম। যদি তালা দেওয়া থাকতো তাহলে অন্তত, আলপিন বা সেপটিপিন দিয়ে খোলার চেষ্টা করা যেত। এতো সিকিউরিটি। how strength! এতে আমার কিউরিওসিটি দ্বিগুন বাড়িয়ে দিল। মন বলছে- ডাল মে কুস কালা হে। এখন যেভাবেই হোক এটা খোলার ব্যবস্থা করতে হবে। তাই চেষ্টা শুরু করে দিলাম।আবোল তাবোল যে নাম মনে আসছে দিতে লাগলাম। যত পরিচিত নাম আছে সব দিতে লাগলাম। But I am failed. আধা ঘণ্টা ধরে চেষ্টা করছি কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। বাইরে সন্ধ্যা নেমে এসেছে।বাইরে থেকে কোনো গাড়ির হর্ন শোনা যাচ্ছে। বাবা বোধহয় চলে এসেছে। লাস্ট একটা চেষ্টা করি। লাস্ট চেষ্টায় যে আমার মাথা ঘুরে যাবে আমি তা স্বপ্নেও ভাবিনি।শেষ চেষ্টায় লক ঠিকই খুলে গেলো আমার মনে হাজারও প্রশ্নের জন্ম দিয়ে। এটা কিভাবে সম্ভব? মন তো মানছেনা। কারণ সেই রুমের লকের পাসওয়ার্ড হলো –
N l L A B O T I .

বাবা মা চলে আসায় সেদিনের মতো আমি আর কিছুই করতে পারলাম না। ব্যর্থ মন নিয়ে চলে আসলাম। কিন্তু মাথায় শুধু সেই আলো আধারি রুমের অপাশে কি আছে তা জানতে আকুল।
তার ঠিক এক সপ্তাহ পর আমার আবার সুযোগ হলো দোতলায় যাওয়ার। সেদিন বাবা মা আবার শহরে গেলো। বাইরে ঝুম বৃষ্টি। তাই সে দিনে বাবা মা আর ফিরবেনা বলে দিয়েছে। আমি আর আমার ছোট বোন আর কাজের মহিলা রহিমা খালা ছিলাম। রহিমা খালার আবার একটা অভ্যেস আছে। বৃষ্টি এলেই উনার আবার ঘুম পায়। তাতে বরং আমার সুবিধাই হলো। আমি আবার হারিকেন নিয়ে এগিয়ে গেলাম, দোতলার সেই গোপন সিঁড়ি বেয়ে। একেবারে শেষ মাথায় সেই রহস্যকুঠুরি। পর্দা সরালাম সন্তর্পণে। কোনো মতে নিজেকে স্টেবল করে দরজার লকে চাপলাম,
N l L A B O T I.

বিশাল দরজা টা হাট করে খুলে গেলো৷ ধুলোয় আমার চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছে।আস্তে আস্তে এগোতে লাগলাম ঘরটার দিকে। ঘরটা অন্ধকারে ডুবে রয়েছে। বাতাসে কেমন একটা পুরোনো পুরোনো গন্ধ। আলোর আশায় সুইচ খুঁজতে লাগলাম। হাতরে ঘরের লাইটের সুইচ চাপলাম। তাও ভালো রুমে যে ইলেকট্রসিটি আছে। বাতি জ্বালিয়ে দিতেই চোখ ধাঁধিয়ে গেল।
রুমটা আয়তনে বিশাল। রুমের মাঝে মাঝারি আকারের একটা ঝাড়বাতি। কি অপরুপ সুন্দর লাগছে। রুমের একেবারে কোণায়, জানালার কিনারে বিশাল বেডসিট। কি আশ্চর্জ! ধুলোর স্তূপে চাপা পড়া চিত্রকর্ম আর রঙিন পত্রমালার জগত যেন এই রুমটা। রুমের একপাশ জুড়ে রয়েছে বড় বড় ক্যানভাসের সারি, তারই পাশে আর্টের সরঞ্জাম। তুলি, পেনসিল নানা সেডের, অ্যাক্রেলিক কালার, পোস্টার কালার, জলরং, ব্রাশ আরও কতো কি। আর ঘরের অন্য কোণে স্থান পেয়েছে মাঝারি আকারের একটা পিয়ানো, একটা বায়োলিন আর একটা গিটার। যদিও দেখে মনে হচ্ছে, এই সবকিছু আদি কালের, গিটার, বায়োলিন সবগুলোর ভার্সনও আদিকালের। এই ঘরটা আসলে কার! আর কেনই বা এই দোতলায় আসার জন্য এতো বারণ! তারপর শুরু হলো- এই ঘরে আমার অভিযান। বেশির ভাগই আগের কালের বাদ্যযন্ত্র আর আর্ট সরঞ্জাম। খোঁজাখুঁজির এক পর্যায়ে একটা কাঠের সিন্দুকের মতো কিছু একটা আমার নজর কাড়লো। কালো রংয়ের সিন্ধুক বলা চলা। তাতেও ঠিক একই লক। লক চাপতেই আড়মোড়া একটা আওয়াজ করে খুলে গেল সিন্ধুক। এটাতেও কয়েকটা ক্যানভাস। সবগুলো তে একজনারই ছবি আঁকা। একটা পুরুষালি অবয়ব। আর একটাতে ছিল একটা যুবতী মেয়ের ছবি। মেয়েটাকে দেখে কেমন জানি চেনা চেনা লাগছিলো কিন্তু ঠিক চিনে উঠতে পারলাম নাহ। সিন্ধুকে একটা ব্যাগ ছিলো। ব্যাগে খুব যতন করে রাখা ছিল অনেকগুলো শুকনো গোলাপ আর নাম না জানা আরও কিছু ফুল। আর তার সাথে ছিল কিছু খাম। আমি একটা চিঠি খুললাম। তাতে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা –

“তোমার সাথে আমার দেখা হবেনা হয়তো বহুদিন! তাতে কি! আমার ঊষ্ণ রক্তস্রোতে, অবাদ্ধ চোখের জলে, বুকের বা পাশ টা জুড়েই তো তুমি। তোমাকে কখনই আমি ছেড়ে যাইনি। ছেড়ে যেতে পারিনি।
ভালোবাসার নীলাবতি”।
আবার সেই নীলাবতি! নীলাবতি তো আমাদের পরিবারের কারো নাম বলে আমার মনে পড়ছে না।
রুমের এক কোণ থেকে হঠাৎ হালকা শব্দ পেলাম। খুব ক্ষীণ, যেন কেউ ধীরে ধীরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে!
আমি ভয় পেয়ে গেলাম। হারিকেনের আলোটা তুলে সেদিকে এগোলাম। রুমের এক কোণায় একটা কাঠের চেয়ার আর তার সামনে রাখা আয়না। আয়নার কাঁচে ধুলো জমেছে, কিন্তু তাও যেন কেমন একটা আবছা প্রতিবিম্ব দেখা যাচ্ছে। আমি ধীরে ধীরে সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম—এবং যেন মুহূর্তেই হৃদস্পন্দন থেমে গেল। আয়নার কাঁচে আমি আমার প্রতিবিম্বের পেছনে আরেকটা ছায়া দেখতে পেলাম। আমি পিছনে তাকালাম—কেউ নেই। আবার আয়নায় তাকালাম, ছায়াটা ততক্ষণে মিলিয়ে গেছে। ভেতরে একটা শীতল শিহরণ বয়ে গেল।

হঠাৎ করে চারপাশ যেন ভারী হয়ে উঠলো। বজ্রপাতের আলোর জলকেই দেখলাম – রুমের দরজার পাশেই টানানো একটি পুরনো, বিবর্ণ ছবি। ছবিটাতে একটি পুরুষ আর একটি নারী—সাদা-কালো রঙের। ছবির নিচে লেখা ছিল কিছু জীর্ণ অক্ষর—‘নীলাবতি ও বেনিমাধব, ১৯৫০’।

ঠিক তখনই বাতি টিমটিম করে নিভে গেল। বাইরে হাওয়ার শোঁ শোঁ শব্দ। জানালার পর্দা উড়তে লাগলো অদ্ভুতভাবে। আমার চোখ তখন স্থির হয়ে গেল – এই ছবিটাতে। কি নিদারুণ সুন্দর করে আঁকা হয়েছে এই ছবিটা। দেখেই বোঝা যায়, শিল্পির প্রতিটা আচঁ খুব সূক্ষ্ম ; যার দ্বারা ফুটে উঠছে এই ছবিটা। ছবিটাতে কি অপরুপ মাধুর্য, ছেলে আর মেয়ের চোখে মুখে মিশে আছে ; এক আর্তনাত, এক না বলা কথা। যা তাদের চোখেমুখে লেপ্টে আছে। কিন্তু বুঝতে পারলাম না – এই নীলাবতি আর বেনিমাধব নামের কোনো ভিত্তি!!

তখনই নিচে থেকে রহিমা খালার ডাক শুনতে পাই। এখন?

রাত্রি কত হবে আর, দশ টা কি সাড়ে দশটা। গ্রাম এলাকা বলেই এখানে দশটায় নামে রাজ্যের আঁধার। মোটামুটি পুরো বাড়ী ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে আছে। কিন্তু এদিকে আমার চোখে ঘুমের ছিটেফোঁটাও নেই। সেইসময় রহিমা খালার ডাকে চলে আসতে হয়েছিল খুব তড়িঘড়ি করে। সবকিছু আগের মতো রেখেই এসেছি।
কিন্তু আমার ভেতরটা তখন আর আগের মতো নেই। একটা অজানা টান, অদ্ভুত এক টানাপোড়েন আমাকে নিয়ে যাচ্ছে কোথায় যেন। মনে হচ্ছিলো, আমার জীবনের সাথে এই রহস্যময় ঘরের, নীলাবতির, বেনিমাধবের—কোনো এক গভীর সম্পর্ক আছে।
সেইদিন আসার সময় সাথে করে আমি নিয়ে এসেছিলাম সেই ব্যাগটা। এখন আমার চলবে অভিযানের স্ট্রিম রোলার।
গুনে দেখলাম এখানে মোট ‘ন’ খানা চিঠি। বেশির ভাগই হিন্দি তে লেখা চিঠি। আর যেগুলো বাংলায় লেখা সেগুলোও খুব ভালো অবস্থায় নেই। কালি দিয়ে লেখা কয়েকটা। কয়েটা চিঠির কালি ছরে দিয়ে ভয়ঙ্কর রুপ ধারণ করেছে। আমি আরেকটা চিঠির ভাঁজ খুললাম। একই হলদে খাম। তাতে লেখা –

” আপনার সহিত তো আর দেখা হয়নাই। পড়ার অজুহাতে কাল বাবা কলিকাতা যাইবে। আমি জারুল গাছটার নিচে আপনার অপেক্ষায় রইবো। মনে করে আমার পাওনা খানা নিয়া আসিবেন। “

  • নীলাবতি

চিঠির ভাষা যেন সময়কে ছুঁয়ে যায়—”যেদিন তুমি চলে গেলে, আমি একটাও কবিতা লিখতে পারিনি। অথচ প্রতিটি শব্দ আজও তোমাকেই খোঁজে।”

প্রতিটি চিঠি একেকটা অধ্যায়, একেকটা অপূর্ণ প্রেমগাথা।

চিঠিগুলো যত পড়ছি ততই রহস্য তলিয়ে যাচ্ছি। কোনো ঠিকানাই উল্লেখ্য করা নেই চিঠিগুলো তে। কিন্তু এটা আমি মোটামুটি নিশ্চিত, চিঠিগুলো এই বাড়ীর কারো কাছেই এসেছিল।

কিন্তু শেষ চিঠিটা যে ঠিকানা থেকে এসেছে, সে ঠিকানা টা অন্য। আর এই চিঠিটা ইকটু বেশি যত্ন সহকারে রাখা। তাতে লেখা –

” আজ রাতে আকাশে চাঁদ উঠিবে। পূর্ণিমা যে আজ। নদীর নীল জলে চাঁদের আলো পড়ার দৃশ্য বড়ই অপরুপ। তোমার লাগি সোজন বাদিয়ার ঘাটে অলোকনন্দার নীচে অপেক্ষায় রহিব।
আমার নীলাবতি। “

চিঠির নিচে লেখা পুরোনো ঠিকানা : স্মৃতিলতা নিকেতন।

ভালোবাসা, গোপনীয়তা আর এক রুদ্ধ রহস্যের শেষ চিঠির প্রতীক্ষা যেন আমাকে ঘিরে ফেললো।

হুট করেই মাথায় একটা ভুত চেপে বসলো। চিঠির উত্তর লিখবো। যেই ঠিকানা থেকে এই চিঠিগুলে আমার কাছে এসেছে ঠিক সেই ঠিকানায়। যেই ভাবা সেই কাজ। পরেরদিনই চিঠি লিখতে বসলাম। কার চিঠি,কাকে লিখছি কিছুই জানিনা। তবুও লিখেছি একপাতা – আধপাতা। আগের যুগের মতোই সাধু বাসায় লিখলাম চিঠিটা। চিঠির ভাষা টা এরুপ ছিল –

” পৃথিবীর সব রুপ সবসময় দেখিতে নাহি। অপেক্ষায় রও আরও কিছু কাল। আমিও তো অপেক্ষাই করছি। অপেক্ষার মৃত্যু নাই গো “।

এতটুকু লিখে কলম থামালাম। চোখে আমার রহস্যরা খেলা করছে। যথারীতিই পরের দিন ডাকে করে চিঠিখানা পাঠিয়ে দিলাম – সেই ঠিকানায়। যদিও মোটামুটি শিওর ছিলাম শুধু শুধুই এগুলো করছি। যেই ঠিকানায় পাঠালাম সেই ঠিকানা আদৌতে বর্তমান আছে কিনা, তাও আমার অজানা।

চিঠি পাঠানোর আজ এক সপ্তাহ পেরুলো। শীতের সকাল। এখনো রোদ উঠেনি। আমি চাতালে বসে কফি খেতে ব্যস্ত। সেখান থেকেই লক্ষ্য করলাম সাইকেলে করে কেউ একজন এসেছে – হাতে কতগুলো ফাইল আর কাগজপত্র। “নীলাবতি” নামে কাউকে খুজছে। আমার দম যেন বন্ধ হয়ে যায়। কোনো মতে নিজেকে সামলিয়ে নিয়ে লোকটার থেকে চিঠিটা নিয়ে সোজা নিজের রুমে চলে গেলাম। সেই হলদে খাম। চিঠির লেখাটা এরুপ –

” অপেক্ষা বড় জটিল শব্দ, নীলাবতি। এই শব্দ খানা বুকে বড় পীড়া দেয়। তোমাকে দেখিনা বহুদিন। তোমাকে তেমন করে আমার চেনাও হয়নি। এবার তাহলে অপেক্ষার পালা শেষ হোক।কথা হোক, আবার শুরু হোক সেই প্রথম থেকেই,
তোমার বেনিমাধব “।

এবার অন্তত এটা নিশ্চিত হলাম চিঠিগুলো ভুল করে মোটেও আসছেনা। কোনো চেনা মানুষই চিঠি পাঠাচ্ছে। কিন্তু এই নীলাবতি টাই বা কে! মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলাম – কাউকে কিছু বলবো না। নিজেই নীলাবতি হয়ে চিঠি লিখবো। দেখা যাক কতদুর এগোয় এই খেলা।

তাই এই চিঠিরও উত্তর দিতে বসলাম। লিখলাম আমি আমার কি পছন্দ, এই আমার প্রিয় রং, প্রিয় ঋতু, প্রিয় লেখক এইসব। এই সবই লেখতাম সেই পাওয়া লাল ডায়েরি থেকে। একপাতা আধপাতা কবিতা ; আরও কতকিছু। রীতিমতো চিঠির উত্তর ও আসতো। তাতে লেখা থাকতো, চিঠিদাতার কথা। তার প্রিয় শরতের আকাশ, কাশবন, প্রিয় কবিতার সুর, সমুদ্দুর ; এই সব। এভাবে চিঠি আদান প্রদানের একমাস পেরিয়ে গেল।
এখন আমার প্রতিদিনকার অভ্যেস পরিণত হলো চিঠি দেওয়া – নেওয়া। কোনো একদিন যদি চিঠি আসতে দেরি হতো আমি মরিয়া হয়ে উঠতাম। যদিও কে এই চিঠিগুলো লিখছে কাকে লিখছে, কি কারণে লিখছে কিছুই আমি জানিনা। তবুও সেই চিঠির মানুষটার ; যার নাম বেনিমাধব তার নীলাবতি হয়ে উঠেছি আমি।

একদিন রাতের কথা। নতুন চিঠিটার খাম খুললাম। তাতে লেখা –
” অচেনা হরিণী, নীলাবতি। জানিনা কেমন তুমি, কেমন তোমার সুবাস। হিয়াকোণে শুধু একটাই শব্দ – নীলাবতি। জানিনা তোমার হাসিখানা কেমন। শুধু মন দিয়ে অনুভব করিতে পারি। এখন মনে হইতেছে, চক্ষু দিয়াও তোমার দেখা প্রয়োজন। তোমার আমার বলা প্রয়োজন অনেক কিছু। অতকিছু চিঠিতে লেখার সাধ্যি আমার নাই। শুধু লিখিতে পারি – এই মাধব তোমারে
” ভালোবাসে “
অপেক্ষায়, আক্ষেপে আর ভাসাইয়ো না মোরে। “

আমার হৃদস্পন্দন বেড়ে গেলো। চোখে আমার শ্রাবণের ঢল। হাত পা কেমন অসাড় হয়ে আসছে। কেমন অদ্ভুত অনুভব। আচ্ছা, আমিও কি তাকে ভালোবাসি! এভাবেও কি কারো প্রেমে পড়া যায়! শুধু কয়েক টুকরো কথায় কি প্রেম হয়, না জানলাম, না চিনলাম, না দেখলাম ; শুধুই চিঠির বিনিয়ম। চিঠির বিনিময়ের দ্বারা কি মনেরও বিনিময় হয়! হয় তো! এই যেমন আমার হয়েছে। কিন্তু এটা ভিত্তিহীন। নিজেকে বুঝার চেষ্টা করলাম। তাই চিঠির উত্তর দিলাম না। দেখতে চাইলাম জীবন আমাকে কোথায় নিয়ে যায়।
এখন একটা বড় প্রশ্নবোধক চিহ্ন হলো – এই নীলাবতি টা আসলে কে? উপরের দোতলার রুমটাই বা কার ? আমি যতদুর জানি, দাদির তো আর কোনো আত্মীয় এই বাসায় থাকতো না আগে। বন্ধই ছিলে এতো বছর। তাহলে? বাবা, কি কিছু জানতে পারে? নাহ, বাবা কেই জিজ্ঞেস করতে হবে। মনে হচ্ছে, অনেক কিছুই আমার অজানা।

একরাতের কথা। দাদি ঘুমিয়ে পড়েছে সে মিনিট পাঁচেক হবে।আমরা সবাই নিচের বড় ঘরটায় খেতে বসেছি। খাওয়ার শেষে এক পর্যায়ে কৌশলে জিজ্ঞেস করলাম – বাবা, শোনো না৷

  • হুম বল।
  • এই বাড়ীটায় আমরা এসেছি অনেকদিন হলো। কিন্তু এই বাড়ীটা ঠিক করে আমার ঘোরাই হলো না। কেন?
  • অত ঘুরে কি করবি বল? এতো বড় বাড়ীটাতে আমাদের যতটুকু দরকার ততটুকুই ঠিক আছে।
  • আচ্ছা, বাবা। তুমি তো একাই। তোমার কোনো ভাইও তো নেই না। ফুফু যিনি আছেন তিনিও বিদেশে। আচ্ছা, দাদার আরও কোনো ছেলে মেয়ে,যা আমি জানি না?
  • দুর কি বলছিস! আমিই আমার বাবার একমাত্র ছেলে।
  • আচ্ছা, বাবা। দোতলার ঘরগুলো কেন বন্ধ করা? আমরা কি ঐ দিকটায় যেতে পারিনা?
  • নাহ। আমি আগেই বলেছি, ঐ ঘরগুলো সব নোংরা। আর ঐ দিকটায় যেতে তোর দাদিমার নিষেধ আছে।
  • কেন এটা কি ধরণের কথা বাবা!
  • নাহ, আর কোনো কথা না।
  • আচ্ছা, বাবা এই বাড়ীতে সত্যি কি আগে কেউ ছিল, যাকে আমি চিনিনা? আমি তো কতকিছুই জানিনা। তোমরা আমাকে কেন বলোনা? এই যে এই বাড়ী, তার অতীত কি, আমার পূর্বপুরুষ কে; কিছুই আমি ঠিক জানিনা। হুট করেই তোমাদের সিদ্ধান্ত, আমাকে দাদিবাড়ী যেতে হবে।
  • আচ্ছা, নিধি, থামো। খাওয়া শেষ করো।
  • আচ্ছা, তুমি তো আমাকে বলেছো, এই দাদিমার নাম – নীলিমা। আর এই বাড়ীতে কেউ নেই। কখনো ছিল না। তাহলে – নীলাবতি কার নাম?
    মুহূর্তেই বাবা মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেলো। হঠাৎ করেই রহিমা খালার হাত থেকে একটা কাঁচের বাটি পড়ে শব্দের আলোড়ন তুলল। তার চোখেমুখে যেন কেমন কেমন ভাব। রহিমা খালা অপ্রস্তুত হয়ে আমতা আমতা করে বললো –
  • ও না না ম। তু মি কো থায় শুনেছো? কি বলছো? কেউই না হ। এ ই নামে কেউ নাই গো।
    এই বলে রহিমা খালা দৌড়ে চলে গেলেন। আর ফিরেও তাকালো না। কোনো এক রহস্যের আঁধার যেন নেমে এলো – রহিমা খালার মুখ জুড়ে। এ রহস্যের কোনোরুপ মানে আমি বুঝতে পারলাম না।

তারপরে চলে গেলো মাস দেড়েক। প্রতি রাতেই আমার ঘুম আসেনা। কোনো এক গোমট বাঁধা আর্তচিৎকার যেন পুরো বাড়ির আনাচে কানাচে। নিয়ম করে প্রতি মাঝরাতে আমার ঘুম ভাঙে। আজও তাই। বাইরে আজ পূর্ণিমা। জোছনার আলো আকাশ জুড়ে থইথই করছে। ছাদে চলে গেলাম। জোছনার রুপালি আলো যেন ঢেউ তুলছে পুরো বাড়ীতে। সেই জোছনার আলোতে আমি স্পষ্ট দেখতে পেলাম – দাদিমার ঘর থেকে কেউ একজন বের হলো।
দাদিমা? তা তো সম্ভব নয়। দাদিমার তো পায়ে খুব ব্যাথা। সবসময় শুয়েই থাকেন। তাহলে কে? আমি দেখতে পেলাম – সেই ছায়া মানব বাড়ীর সদর দরজা ঠেলে বাইরে বের হলো৷ কি করবো বুঝতে না পেরে,আমিও তার পিছু নিলাম। যেতে যেতে সেই ছায়া মানব, বাড়ীর থেকে মাইল দুরে গিয়ে থামল। সামনে একটা বিল। বিলের পাশেই জারুল ফুল আর অলোকনন্দার ঝাড়। আর আকাশে চাঁদ। এই দৃশ্য দেখে আমার সেই চিঠির কথা মনে পড়ে গেলো। তাহলে কি এই নদী তীরের কথাই বলা হয়েছিলো চিঠিতে? কোনো কিছুরই কূল পেলাম নাহ। মিনিটখানেক পরিবেশ নীরব থাকার পর সেই ছায়ামূর্তি হু হু করে কেঁদে উঠলো।
এই সুরের মূর্চ্ছনা এই জোছনার নিরবতা যেন ভেঙে দিচ্ছে। আর তারপর আবার সব চুপ। শুধু প্রকৃতির নিস্তব্ধ চিৎকার।
তারপর সেই ছায়ামূর্তি আবার বাড়ীতে চলে এলো।এবার আমি এটা পুরোপুরি বুঝেছি যে – এটা নিছকই কাকতালীয় ঘটনা নয় ; এর রয়েছে ইতিহাস ; যা আমাকে জানতেই হবে।

বাড়ী থেকে এখন আছি এক কিলোমিটার দূরে হবে। এদিকটায় বেশ লোকালয়। গিঞ্জি গিঞ্জি বাড়ী। তার বেশির ভাগই ছোট দোতলা। যে রাস্তাটায় আমি দাঁড়িয়ে সেটা মোটামুটি ব্যস্তই বলা চলে। মহিলাদের আনাগোনাও আছে। নিচ তলায় তারা তাদের নিত্যদিনকার কাজে ব্যস্ত। আমি মূলত এসেছি – “মনিপুর বইঘর ” এর খোঁজে। শুনেছি এটাই এই এলাকার বুকে সবচেয়ে পুরনো বইয়ের দোকান। আসলে আমি সত্যি ই সংকীর্ণ যে আদৌতে এই নামে কোনো বইয়ের দোকান আছে কিনা। যেই খামগুলো দাদিমার ঘর থেকে পেয়েছি, তার একটার খামে লেখা ছিল – এই বইঘরের ঠিকানা। কিন্তু কাজটা যত সহজ ভেবেছিলাম – কাজটা ঠিক ততোটাই কঠিন। দুই ঘন্টা যাবৎ খুঁজে চলেছি কিন্তু পাওয়ার নাম নেই। এখন সত্যি ই খুব করে অস্বস্তি লাগছে। এমন এমন পাগল পাগল ভাব দেখে মানুষের দৃষ্টি আমার দিকেই আড়ষ্ট হচ্ছে। তারপর অনেক খোঁজাখুজির পর একটা বইয়ের দোকান চোখে পড়লো। কিন্তু তার নাম ছিল – “মণিপুর বাতিঘর”। বোধকরি কালের বিবর্তনে নামটা বদলে গেছে।
দোকানটা একটা দোতলা বাড়ীর নিচতলায় অবস্থিত। বইয়ের দোকটা পর্যাপ্ত গোছানো, দোকানে ঢুকতেই পুরোনো বইয়ের গন্ধ নাকে এসে ভিড় জমাতে লাগলো। আমি এখনও জানিনা, এখানে আমার প্রশ্নগুলোর উত্তর পাবো কিনা ; তবুও একটা চেষ্টা, একটা আশা।
দোকানে ঢুকতেই দেখতে পেলাম –
একটা বয়স্ক লোক বসে আছে। খবরের কাগজে চোখ বুলাতে ব্যস্ত তিনি। আমাকে দেখেই আড়মোড়া ভাব ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। আমি ভণিতা না করে সোজাসুজি বিনয়ের সাথে বললাম – চিঠির খাম বিক্রি করেন?
লোকটা বোধহয় এই প্রশ্ন শোনার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। তিনি ম্লান হেসে বললেন :

  • এই যুগে কি এসবের প্রচলন আছে, খুকুমণি? আগে বিক্রি হতো খুব। মানুষ এখন ডিজিটাল হয়েছে, চিঠির দেওয়া নেওয়া কে করে? তবুও আমি স্টকে রেখেছি। তা কেমন খাম চান?
    আমি আমার ব্যাগ থেকে সেই পুরোনো চিঠির হলদে খামগুলো বের করলাম ; যেটা হয়তো একসময় এখান থেকেই কেনা হয়েছিল। খাম টা দেখেই লোকটা হয়তো চিনে ফেললো। তার চোখ জুড়ে যেন স্মৃতিরা ঝেকে বসলো।
    আমাকে জিজ্ঞেস করলো – আমি এটা কোথায় পেয়েছি। আমি বললাম – “স্মৃতিলতা নিকেতনে আমি থাকি। সেখানেই পেয়েছি। “
    লোকটা ধপ করে চেয়ারে বসে পড়লো। আমি সরাসরি ই বললাম – ” আমার যতটুকু ধারণা, এই খামগুলো আপনার দোকান থেকেই নেওয়া। আপনি কি জানেন, কোন ব্যক্তি চিঠিগুলো নিয়েছে। তার নাম কি আদিত্য?
    উনি এবার সম্পূর্ণ আমার দিকে ফিরে বসলেন। তারপর মিনিটখানেক নিরবতা।
    তারপর তিনিই আবার বলতে শুরু করলেন-

” তুমি ঠিকই ধরেছো, এগুলো আমার দোকান থেকেই কেনা। তখন আমি দোকানটা সবেমাত্র চালু করি। এই আদিত্যনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন আমার দোকানের নিত্যদিনকার কাস্টমার। প্রতিদিনই খাম কিনতো। কার জন্য এগুলো কেনা হচ্ছে, জিজ্ঞেস করলে মুচকি হাসতো আর বলতো – তার প্রিয়ার জন্য। তাকে আমি তার প্রিয়ার নাম জিজ্ঞেস করায় আমাকে বলে, তার নাম নীলিমা। শুনেছি, সে জমিদারের কন্যা। জানিনা কেন সেই জমিদার কন্যা – এই নিম্নবর্গের চিত্রশিল্পী আদিত্যের প্রেমে পড়ে? আসলে আদিত্য খুব ভালো লোক ছিল। প্রেম জিনিসটাই আসলে এরুপ।কোনো জাতিভেদ মানে না। একদিন হুট করেই আদিত্য আর আমার দোকানে আসে না। লোকে মুখে শুনেছি – আদিত্য আর নীলিমার প্রেমের ব্যাপারটা জানাজানি হয়ে যাওয়ায় এরুপ হয়েছে। কিন্তু আদিত্য আর নীলিমার প্রেম যে কতটা খাঁটি ছিল – তা আমি দেখেছি। কত যতন ভরে দুজন দুজন কে চিঠি দিতো! লোকেমুখে শুনেছি আদিত্য নাকি খুন হয়েছে। কিন্তু আবার কেউ কেউ বলে মাঝেমধ্যে ই নাকি আদিত্যকে দেখা যায়। ৷ কিন্তু শেষমেষ কি হলো – তা আমার জানা নেই।

এখন নতুন করে হোঁচট খাচ্ছি – নীলিমা আর আদিত্য নামে। নীলিমা? মানে তো আমার দাদিমা?
কেমন যেন ধোঁয়াশায় আমি তলিয়ে যেতে লাগলাম। মনে হচ্ছে যতই জানছি, ততই যেন অতলে তলিয়ে যাচ্ছি। নতুন করে আমার বিভ্রান্ত শুরু হলো – এই “নীলাবতি আর বেনিমাধব ” কে নিয়ে। এরা কারা? যদি আদিত্য আর নীলিমা প্রেমিক – প্রমিকা হয় ; তাহলে “নীলাবতি আর বেনিমাধব” কারা? মাথা ভার হয়ে আসলো। না, আমার ইকটু ঘুম দরকাম। লম্বা, শীতল ঘুম।

সেইদিনের নীলাবতির ঘটনার পর রহিমা খালা অনেক অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। এখন সব সময়ই তার ঘরেই থাকেন। তার এরকম ব্যবহার আমাকে খুব ভাবাচ্ছে। আচ্ছা সে তো অনেকদিন ধরে এই বাড়ীতে আছে। তার তো এই বাড়ীর ইতিকথা জানার কথা। হ্যাঁ, ঠিক তাই।
সবাই রাতের খাওয়া দাওয়া শেষে যার যার ঘরে চলে গিয়েছে ঘুমের প্রস্তুতি নিতে। কিন্তু আমি রুমে যাইনি। সোজা চলে যাই, রহিমা খালার ঘরে। তিনিও ঘুমোনোর প্রস্তুতি নিতে ব্যস্ত। আমি সোজা রুমে ঢুকে তার পাশে গিয়ে বসলাম। আর জানতে চাইলাম – আমার দাদিমার ব্যাপারে, আর সেই বইঘরে যেটা যেনেছি ; সেই প্রেমের ব্যাপারে। বুঝলাম রহিমা খালা খুব চাপা। কিন্তু আমার অনেক জোড়াজুড়ি তে বলতে বাধ্য হলো।
রহিমা খালার কথা শুনে মনে হলো – আমি এতোদিন যা জেনেছি, সব ভুল। আমি নিজেও ভুল। কিন্তু কিভাবে?
রহিমা খালার ভাষ্যমতে – ” বইঘরের লোকটার বলা সব কথাই সত্যি। আমার দাদিমা মানে নীলিমা সত্যি তার আর্ট শিক্ষক আদিত্যের প্রেমে পড়ে এবং তা একসময় তার বাবা প্রমথনাথ চৌধুরী যেনে গেলে শুরু হয় সমস্যার। তিনি নাকি মেয়ের ভালোবাসা কে সম্মান করে তাদের বিয়ের ঘোষণাও দেয়। রহিমা খালার মতে, এই বিয়ের ঘোষণা দেওয়ার পেছনে নাকি এই জমিদারের কুটনীতি ছিল। তার কিছুদিন পরেই নাকি সেই শিক্ষক হাওয়া। তার আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়না। প্রথমে সবাই ভেবেছিল, সে খুন হয়েছে। কিন্তু তার কোনো মরদেহ না পাওয়া যাওয়ায়, নীলিমা মানে আমার দাদিমা এটা বিশ্বাস করেনি।
রহিমা খালার বলা সবচেয়ে আশ্চর্য খবর হলো – আমার দাদিমা নাকি মনে করে তার প্রেমিক এখনও বেঁচে আছে এবং সে একদিন ফিরে আসবে এই আশায় তিনি বিয়ে করেনি কখনো। আমার দাদিমা নাকি আজও অবিবাহিত, এখনো অপেক্ষায় রয়েছে, তার প্রেমিক আদিত্যের।
এখন আমার মনে আরেকটা রহস্য খেলা করছে। তা হলো – দাদিমা যদি বিয়েই না করে, তাহলে আমি কার নাতি?

এক সন্ধ্যায়। হুট করেই মা এলেন আমার ঘরে৷ আমার গা ঘেঁষে বসলেন। মায়ের এরকম চলন আমার চেনা। এরকম হুটহাট করে তখনই আসেন, যখন তিনি নিরুপায় হয়ে যায়, আমার সাথে কথা বলতে চায়।
আমি কম্পিউটারের স্ক্রিন থেকে চোখ না সরিয়েই বললাম –

  • কি বলবে?
    মা কোনো ভনিতা ছাড়াই আমার মুখ পানে চেয়ে বললেন,
  • তুমি এখন অনেক বড় হয়েছো, অনেক কিছুই বোঝো। তাই তোমার থেকে গোপন করাটা এক প্রকার অন্যায়ই বটে।
  • তুমি কি বলছো? কিসের কথা?
  • এই বাড়ীর পূর্বের কথা।
  • পূর্বের কথা?
  • হুম। আমি চাই তুমিও জানো। আসলে, তুমি ছোট থেকে যাকে তোমার দাদিমা হিসেবে যেনে এসেছো তিনি তোমার আসল দাদিমা নন। তোমার দাদিমা তোমার জন্মের আগেই মারা গেছেন।
  • তাহলে? তাহলে উনি কে?
  • উনি হলেন তোমার বাবার ফুফি। এই ফুফির নাম হলো – নীলিমা। আর এই বাড়ীটা হলো তার বাবার। যুবতি বয়সে এই ফুফি বড়ই সুন্দরী ছিলেন। খুব সুন্দর চিত্রাংকন আর গান জানতেন। তাকে একনজর দেখার জন্য নাকি ছেলেরা বাড়ীর সামনে ভীড় জমাতো। তো এই নীলিমা যখন যুবতী, তখন নাকি তিনি তার আর্ট শিক্ষকের প্রেমে পড়ে। যদিও বহুকাল যাবৎ এটা গোপন ছিলো ; কিন্তু একটা সময় এই নীলিমার বাবা এটা যেনে যায়। তিনি ছিলেন তখনকার সময়ের জমিদার। সম্মান রক্ষার্থে তিনি সেই শিক্ষকের সাথে বিয়েও দিতে চায় তার মেয়েকে। সেই শিক্ষকও রাজি হয়ে যায় ; কিন্তু হুট করেই গায়েব হয়ে যায়। আর কোনোদিনও নাকি সে এই বাড়ী মুখো হননি। কেউ কেউ বলে মারা গেছেন উনি। আর কেউ বলে পালিয়ে গিয়েছে। ধোঁকা দিয়েছে তার প্রেমিকাকে। এই শোকে তোমার এই দাদিমা আর বিয়েও করেনি, একাই কাটিয়েছেন পুরো জীবন। বৃদ্ধ হয়ে যাওয়ায় আমাদের সাথেই থাকতেন। আর তোমার বাবার যেহেতু আর কোনো ভাই নেই আর এই ফুফি তোমার বাবাকে খুব স্নেহ করে ; তাই তিনি এই বাড়ীটা তোমার বাবার নামে করে দিয়ে যায়।
  • তাহলে নীলাবতি টা কে?
  • এইটা একটা উড়ো নাম। ভিত্তিহীন নাম।
    এই বলে মা চলে গেলেন।

মনে হলো, এই শোকের গল্প পুরো বাড়ী জুড়ে বাজতে লাগলো। দৌড়ে দাদিমার ঘরে গেলাম। তিনি তখন শুয়ে ছিলেন। ঘরটা যেন বিচ্ছেদে বুনন করা। কতো নিদ্রাহীন রাত, কত আক্ষেপ, কত ঘৃণা, কত অপেক্ষা মিশে আছে দাদিমার শরীর জুড়ে। ভাবতেই বুকটা ভারী হয়ে আসছিলো।

রাতটা ঘুমাতে পারিনি। জানালার পাশে বসে সারারাত আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। মনটা ভার হয়ে আছে, যেন হৃদয়ের গভীরে কেউ ধীরে ধীরে গেঁথে দিচ্ছে কোনো এক পুরনো স্মৃতি।
পরদিন সকালে এক অদ্ভুত টান নিয়ে আবার গেলাম সেই দোতলার ঘরে। এবার লক্ষ্য করলাম সিন্ধুকের নিচে মেঝেতে হালকা আঁচড়ের দাগ। হাত দিয়ে ঠেলেই বুঝলাম, সিন্ধুকটা সরানো যায়। টেনে সরাতেই নিচে বেরিয়ে এলো কাঠের তৈরি একটা ঢাকনা—একটা গোপন কুঠুরি!
হৃদস্পন্দন দ্বিগুণ হয়ে গেল। ঢাকনাটা খুললাম। ভেতরে থাকা কুয়াশার মতো ধুলো সরাতেই দেখতে পেলাম কিছু পুরনো চিঠি, ছোট্ট একটা ডায়েরি, আর তার সাথে কিছু পুরোনো বিজ্ঞাপন। আর তা হলো হারানো বিজ্ঞপ্তি আর তা হলো আদিত্যনাথের জন্য। চোখে আর তখন বাঁদলের ধারা। আরও একটা জিনিস পেলাম আমি। আর তা হলো – একটি রুপার লকেট।

আমি প্রথমে ডায়েরিটা খুলি। তা খুলতেই ভেতরের লেখা দেখে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে গেল আমার। ‘নীলাবতি’—এই নামেই শুরু হয়েছে ডায়েরির প্রতিটি পৃষ্ঠা। তাতে কত কিছুই না লেখা। বুঝলাম “নীলাবতি ” নামের সাথে কোনো যোগসূত্র আছে দাদিমার।
চোখের কোণে জল এসে গেল আমার। আমি কাঁপতে কাঁপতে রুপার লকেটটা খুললাম। ভেতরে ছোট্ট একটা ছবি—সেই একই নারী, সেই একই মুখ, যে ছবি আমি দেয়ালে দেখেছিলাম। এবং তার পাশে ছোট্ট করে লেখা—
“আমার কবিতা, আমার নীলাবতি।”

আরেকটা জিনিস খুঁজে পেয়েছি, সেই ডায়েরির শেষ পৃষ্ঠার ভাঁজে। একটা চিঠি আর একটা ক্যাসেট।
চিঠির ভাষা এরকম :

“তুমি চলে গেলে চুপিচুপি—আমার ঘরের বাতাসে আজও তোমার চিঠির খামের গন্ধ,একটু ফিরে তাকালে হয়তো টের পেতে—একটা হৃদয় আজও পড়ে আছে সেই বাঁশবাগানে,অলোকনন্দা ঝাড়ের ভিড়ে- নীলাবতি।”

তারপর আমি ক্যাসেটের অন বাটনে চাপ দিলেন। আর একটা মেয়েলি কন্ঠের কন্ঠ নিশ্রিত কথার ধ্বনি বাজতে লাগলো।
সেখানে বলা হয়েছে –
” অবশেষে সেইদিন এলো। আজই সেইদিন। যেদিনের জন্য আমি অপেক্ষার প্রহর গুনেছি, গেঁথেছি অপেক্ষার মালা। সেইদিনটি ছিল সবদিনের থেকে আলাদা,অন্যরকম।সেই দিনের আলো ছিল সবচেয়ে মধুর, সতেজ। সেইদিনের প্রথম আলোতে আমি চোখ বিজালাম ; যেন দীপ্ত আলো আমার দেহকে মাতিয়ে তুলল। আমার কিন্তু অপেক্ষার পালা শেষ হয়নি। কখন আসবে সেই প্রহর; যেই প্রহরে আমি নিজেকে সোপে দিবো তার পদতলে।
সেইদিনের বিকেলে ছিল রক্তিম আভা। লাল আভা কেটে গেলে আকাশে আসে একরাশ মেঘ। তার সাথে আসে একপশলা বৃষ্টি ; বৃষ্টির সাথে যেন পৃথিবীতে নেমে আসে প্রশান্তি। অবশেষে আসে সেই প্রহর। শুরু হয় আমার প্রস্তুতি।মেরুন রঙের বেনারসি, পায়ে নুপুর, হাতে রেশমি চূড়ি, মাথায় গাজরা, হাতে – পায়ে গাঢ় আলতা আর কপালে লাল টিপ। এবার আমি তৈরি।
জানালা দিয়ে বাইরে তাকাতেই দেখি – আকাশে উঠেছে – একবাটি চাঁদ। তারই শুভ্র জোছনায় পুরো বাড়ি মাতোয়ারা। আমি গুটি গুটি পায়ে সেই জায়গায় এগুচ্ছি। যেখানে আছে কেমন নীল জলের দিঘি, অলোকনন্দা আর জারুলের ঝাড়, চাঁদের আলো আর ভালোবাসা পূর্ণ একজোড়া হাত। আমি জানি, আমার বেনিমাধব পঙ্খীরাজ ঘোড়া নিয়ে এসে আমাকে নিয়ে যাবে। আমি আসছি। “

তারপর কট একটা শব্দ করে ক্যাসেটটা বন্ধ হয়ে গেল। আমি বুঝলাম – আমার চোখ ভিজে গিয়েছে।

বেনিমাধব কি এখনো কোথাও আছে, নীলাবতির অপেক্ষায়? নাকি সেই ভালোবাসা কেবলই অতীতে হারিয়ে যাওয়া এক কবিতা, যার শব্দেরা এখনো বাতাসে ভেসে বেড়ায়?

আজ আমি অনেকদিন পর চিঠি লিখতে বসেছি। আমার মন বলছে এই চিঠিদাতাই আমাকে সব প্রশ্নের উত্তর দিবে। তাই ভনিতা ছাড়াই লিখলাম-

” অপেক্ষার পালা তবে শেষ হোক, দেখা হোক আবার নতুন করে, নতুন রুপে। “

চিঠি পাঠানোর তিন দিনের মাথায় এর উত্তর এলো। সাথে একটা ঠিকানা দেওয়া।

চট্টগ্রামের একটা ঠিকানা। আমি যাত্রার প্রস্তুতি শুরু করে দিলাম। সেই ডায়েরি, পুরুষের স্কেচ আর সব পুরোনো চিঠি ; নিয়ে নিলাম সাথে। বাবা মা কে বিশ্ববিদ্যালয় যাবো বলে বাসা থেকে বের হলাম। এখন দেশের অবস্থা মোটামুটি শান্ত হয়েছে। অনেক জায়গার কারফিউ তুলে দেওয়া হয়েছে। তাই যাত্রাপথে তেমন অসুবিধা হলোনা।
বুকে আমার হাজারখানা প্রশ্ন, শুরু হলো এক অনিশ্চিত যাত্রা। চিনিনা, জানিনা ; শুধু চিঠির একটা ঠিকানার উপর ভর করে ছুটে চলেছি। অবশেষে গ্রামের প্রকৃতি পেরিয়ে পৌঁছে গেলাম চট্টগ্রামে। যে ঠিকানা টা দেওয়া ছিল – তার অবস্থান চট্টগ্রাম শহরের পেরিয়ে আরও ভিতরে। সেই ঠিকানা আমাকে নিয়ে যে জায়গায় থামালো – তা একটা পুরোনো কটেজ। চারিদিকে জারুল আর বাগানবিলাস গাছ। কাঠের একটা দোতলা বাড়ী। বাড়ীর নেমপ্লেট লেখা – ” চিত্রশালা সম্ভার “।
সামনের আঙিনা পেরিয়ে পৌঁছে গেলাম চিত্রশালার একদম মেইন ফটকে। কোনো মানুষের উপস্থিতি না পেয়ে চলে গেলাম ভেতরে। দেখলাম, চিত্রশালার একেবারে কোণার দিকের ঘরটায় সোডিয়ামের আলো জ্বলছে। মনে আমার হাজারো সংকট। তবুও গেলাম।
যে ঘরটায় গেলাম তা নানা চিত্রকর্মে ঠাসা। পেছন থেকেই কেউ একজন বলে উঠলো –

  • এসেছেন? আমার চিঠির নীলাবতি কি আপনিই?
    আমি চমকে উঠলাম৷ পেছনে তাকিয়ে দেখলাম – এক যুবক। বছর আর কত হবে – ২৫, ২৬। তার উৎসুক দৃষ্টি আমার পানে। নিজেকে শান্ত করে বললাম –
    -আপনি কে?
    ছেলেটা মুচকি হাসলো। মুখের এক কোণায় খুব সুন্দর টোল পড়ে।
  • আপনিই আমার সেই চিঠি দাতা?
    আবার হাসা শুরু করলো। কি আজব!
  • আমি হাসির কি বললাম?
  • আপনি তো ভয়ে ঘেমে যাচ্ছেন। ভয় পাবেন না। আগে শান্ত হোন।
  • আমি ভয় পাচ্ছি না। আপনি আগে উত্তর দিন।
    ছেলেটা আমাকে বসতে বললো। তারপর বলা শুরু করলো
  • আমার নাম অর্ঘ্যনাথ। আপনি আমাকে অর্ঘ্য ডাকতে পারেন। আপনিও নিশ্চয়ই নীলাবতি নন।
  • জ্বী, আমি নীলাবতি নই। কিন্তু এটা ঠিক যে আমিই চিঠিদাতা। আমার নাম নিধি। এখন বলুন কেন আমাকে চিঠি পাঠাতেন? আর নীলাবতি বলেই বা কেন সম্বোধন করতেন?
    অর্ঘ্য নামের ছেলেটা বলতে শুরু করলো –
  • আপনি আমার সাথে আসুন।
    এই বলে সে আমাকে এক গুপ্ত কুঠুরিতে নিয়ে গেলো ; যেটার অবস্থান এই চিত্রশালারই একেবারে নিচে। যেটাতে ছিল সারি সারি পেইন্টিং। যার বেশিরভাগই একটি মেয়ের। এই মেয়েটি হুবহু সেই মেয়েটির মতো যা ঠাই পেয়েছিল ; আমার দোতলা ঘরটায়।
    আমাকে জিজ্ঞেস করা হলো – আমি আগে কখনো দেখেছি কিনা? আমি আমার কাছে থাকা পেইন্টিং গুলো দেখালাম। অর্ঘ্য মুচকি একটা হাসি দিলো। তারপর বলা শুরু করলো-
  • এই চিত্রশালা টা হলো আমার বাবার একমাত্র মামার, মানে আমার দাদু তিনি। সেই দাদু এখন বৃদ্ধ। তাই আমার উপর ভার পড়েছে এর দেখাশোনা করার। তাই একবছর ধরে আমি এর তত্ত্বাবধায়ন করছি। একদিন হুট করেই এই চিত্রশালা পরিষ্কার করতে গিয়ে আমি এই ঘরটা আবিষ্কার করি। সাথে পাই অনেকগুলো চিঠি আর কিছু পেইন্টিং। সবগুলো চিঠিই শুধু একজনের থেকে আসা – আর সে হলো -” নীলাবতি “নামের কেউ। আমি যতদুর জানি, আমার এই দাদু বিয়ে করেন নি। আর সবগুলো ক্যানভাসে শুধু একটা মেয়েরই ছবি আঁকা। আমার বাবা কে আমি এই নীলাবতি কে নিয়ে জিজ্ঞেস করায় বাবা আমাকে এমন এক ঘটনা বলে যা শুনে আমি সত্যি ই আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ি, চোখ ভিজে যায়।

এতটুকু বলেই অর্ঘ্য একটা দম নেয়। আমার মাথায় যেন আসমান ভেঙে পড়েছে। কোনো কিছুই বুঝতে পারছিলাম নাহ।

  • তারপর? কি বললো আপনার বাবা?
  • সে অনেক আগের কাহিনি। সালটা বোধকরি,১৯৪৫. তখনো ভারত আর পাকিস্তান ভাগ হয়নি আমার এই দাদু ; যার নাম আদিত্যনাথ ; তিনি সবেমাত্র চারুকলা অনুষদের পড়া চুকিয়ে এই পূর্ব বাংলায় আসেন, মানে এখনকার জাফলং এ। তিনি সেখানে একটা ছোটখানো আর্ট স্কুল খুলেন। দিব্যি তার দিন চলে যেতো। তখনকার এক জমিদারের মেয়েকে আর্ট আর গান শেখানোর দায়িত্ব পড়ে আমার এই দাদুর উপর। ভালো মাইনে পাওয়ার আশায় তিনি এই চাকুরী টা নেন। সেই মেয়েকে বাসায় গিয়ে শেখাতেন তিনি। তো দিন যেতে লাগলো। একটা সময় সেই ছাত্রীর সাথে আমার এই দাদুর প্রেম হয়। দাদু তখন ২১ বছরের আর মেয়েটি তখন ১৭ কিংবা ১৮। একসাথে আলাপন, ছবি আঁকা, বেহালা, হারমোনিয়ামে সুর তোলা আর চোখে চোখে মনের ভাবের আদান-প্রদান।
    কিন্তু সমস্যা টা তখনই সৃষ্টি হয়, যখন সেই মেয়েটির বাবা এ ব্যাপারে জেনে যায় আর রাতারাতি সেই মেয়েটির বিয়ে ঠিক করে ফেলে। আর তা জেনে আমার দাদুর সেই প্রেমিকা, দাদুকে তা জানায়। আর দাদুও প্রতিশ্রুতি দেয় – সেই মাসেই যেদিন পূর্ণিমা, সেই পূর্ণিমার রাতেই যখন জোছনা উঠবে, তখন অলোকনন্দা ফুলের নিচে তিনি অপেক্ষা করবেন। আর দু’জন পালিয়ে যাবেন। কিন্তু নিয়তি তো অন্য কিছু ছিল। সেই দিনই জমিদার নিজে এসে দাদু কে এখনি দেশ ত্যাগ করতে বলে। সেই জমিদার তার মেয়ের দোহাই দিয়ে তাকে চলে যেতে বলে। তাছাড়া আমি এই ঘরে একটা চুক্তিনামা পাই ; যেটার লেখা এরুপ ছিল – যদি কোনোদিন দাদু এইবাড়ীতে আসার চেষ্টা করে, কোনোদিন যদি তার মেয়ের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করে ; তাহলে, চিরতরে নীলাবতি কে তিনি একঘরে করে দিবে।
    তাই দাদু কাউকে কিছু না বলেই চলে আসে ভারতে। তারপর অনেক যুগ কেটে যায়। দেশ স্বাধীনের পর দাদু গিয়েছিলো সেখানে একপলক দেখতে। কিন্তু কাউকেই আর খুঁজে পায়না। বাড়ীর মানুষজন বলেছে, নীলাবতির বিয়ে হয়ে গিয়েছে। তারপর চট্টগ্রামে চলে এসে দাদু চিত্রশালা দেয়, আমাদের সাথে থাকে। কিন্তু সেই মেয়ের স্মৃতি তিনি আর ভুলতে পারেনা।
    আমি অর্ঘ্য কে জিজ্ঞেস করলাম –
  • সেই মেয়েটির নাম কি?
  • সেই মেয়েটির নাম নীলিমা। দাদু নাকি তাকে আদর করে ডাকতো – “নীলাবতি “। দাদুর সবগুলো চিঠিতেই সেই নাম দ্বারাই তাকে সম্বোধন করা।
  • নীলিমা আমার বাবার ফুফু হন। আমার দাদিমা তিনি! আপনি তাহলে কিভাবে জানলেন এই নীলাবতির ঠিকানা?
  • আমার দাদুর আগের এক ডায়েরি থেকে। দাদুকে নাকি নীলাবতি ” বেনিমাধব ” বলে চিঠিতে সম্বোধন করতেন। জানেন, আমার এই দাদু আর কোনোদিনও অন্য কাউকে ভালোবাসতে পারেনি, আর দ্বিতীয়বারের মতো প্রেমে পড়েনি কারো। শুধু সেই নীলাবতিকেই ভালোবেসে আজও তিনি অবিবাহিত। প্রায়ই নাকি বাবাকে বলতো – “নীলাবতি তো এখন খুব সুখে আছে। স্বামী, সন্তান, সংসার নিয়ে। ও ভালো থাকলেই আমি সুখি। “
    নীলাবতির খবর নিতে আমি যাই আপনাদের বাড়ীতে। যদি দেখা পাই! দাদুর ডায়েরির সেই ঠিকানা কে কেন্দ্র করেই আমি যাই। আর আপনাকে চিঠি দিতাম।
  • তাহলে মাঝেমধ্যে ই আমি দোতলায় যে ছায়া দেখতাম, সেটা আপনারই?
  • হুম। আমারই। রাত হয়ে যাওয়ায় থাকতে হয়েছিল। কি নিদারুণ প্রেম কাহিনি নাহ!

এই পর্যায়ে আমার চোখের পানি আর বাঁধ মানলো না। অঝোরে চোখ দিয়ে পানি পড়তে লাগলো।
এভাবেও ভালোবাসা যায়! কি পবিত্র অনুভুতি। এবার আমি বলতে শুরু করলাম

  • আপনি ভুল। আমার সেই দাদিমাও এখনো অবিবাহিত। আমার দাদিমা কে বলা হয়েছে, আপনার দাদু মারা গিয়েছে। দাদিমা নিখোঁজ বিজ্ঞপ্তিও বের করে। কিন্তু যখন লাশ পাওয়া যায় না ; তখন তাকে বলা হয় আপনার দাদু ইচ্ছে করেই চলে গেছে। কিন্তু তিনি বিশ্বাস করেননা। এখনো তিনি রাত জাগেন। এখনো তিনি আপনার দাদুর জন্য অপেক্ষার প্রহর গুনেন। এখনো তিনি প্রতি জোছনার রাতে নদীর পাড়ে যান। আপনার দাদুর স্মৃতি নিয়ে তিনি একজনম পার করে দিলো৷
    এবার অর্ঘ্যও কান্না করতে শুরু করলো।
  • কি আজব নাহ, অর্ঘ্য । দুই প্রান্তে দুইজন দুইজনার জন্য জনমভর অপেক্ষা করে গেলো, ভালোবেসে গেলো কিন্তু জানলোই না অন্তরের গহীনের কথা। কি পবিত্র ভালোবাসা ছিলো তাদের। হায়, যদি একবার তাদের দেখা হতো – তাহলে হয়তো তাদের এই একাকিত্ব জীবনের গল্প টা অন্যরকম হতো।
    তারপর দুজনের মাঝেই এক অদৃশ্য নিরবতা।
    নিরবতা ভাঙতেই অর্ঘ্য বলে উঠলো –
  • নিধি,আপনি এতোদুর থেকে এলেন, আসুন আপনাকে এই চট্টগ্রাম শহরটা ঘুরিয়ে আনি। আপনি হলেন আমার অতিথি।
    আমিও খুশি হলাম। চট্টগ্রাম শহরটা ঘুরে দেখার ইচ্ছে ছিল অনেকদিন আগে থেকেই। তাই এই সুযোগটা আর হাতছাড়া করলাম না। অর্ঘ্যের সাথে জামালখান, যাত্রাবিরতি, বইঘর সহ পুরো চট্টগ্রাম শহরটা ঘুরে বেড়ালাম।
    এই ঘোরাঘুরির ফাঁকে তার ব্যাপারে অনেক কিছুই জানার সুযোগ হলো। আস্তে আস্তে সখ্যতা বাড়লো।
    শেষে অর্ঘ্য আমাকে নিয়ে গেলো – তার দাদুর সাথে দেখা করতে। দেখলাম এক বৃদ্ধ লোক বসে আছে বাসার সামনের বেঞ্চে। মাথায় সাদা চুল বাতাসে উড়ছে, চোখ মুখ দেখলেই উপলব্ধি করা যায় – তিনি একজন শিল্পী মানুষই বটে। আমাদের দেখেই মুচকি হাসলেন। আমি তার পদতলে বসলাম। আদিত্য মশাই নাকি এখন কাউকেই চিনতে তেমন পারেন না। অর্ঘ্য অনেকক্ষণ পরিচয় দেওয়ার পর দাদু তাকে চিনলো।
    অর্ঘ্য তার দাদু কে আমাকে দেখিয়ে বললো:
  • ওর বাড়ী সিলেটে দাদু। বাড়ীর নাম : স্মৃতিলতা নিকেতন।
    আমরা ধরেই নিয়েছিলাম উনার এগুলো কিছুই মনে নেই। অর্ঘ্য শেষ চেষ্টা করতে বললো :
  • এই মেয়েটার দাদিমার নাম হলো – নীলাবতি।
    মুহূর্তেই উনার মুখ রাঙা হলো। চোখ জুড়ে ঝড় এলো। উনি আমার দিকে তাকিয়ে শুধু জিজ্ঞেস করলেন – নীলাবতি, কেমন আছে? স্বামী, সংসার, নাতি- নাতনি সব নিয়ে ভালো আছে তো?
    আমি ও বলতে শুরু করলাম –
  • কিভাবে ভালো থাকবে উনি? ভালোবাসার মানুষ ছেড়ে কি ভালো থাকা যায়, দাদু? আপনি কি ভালো আছেন?
  • আমি শুধু চেয়েছি – ও ওর সংসার নিয়ে ভালো থাকুক। তাতেই আমার শান্তি।
  • কিভাবে একটা সংসার হবে শুনি! আপনার যেমন স্বপ্ন ছিল, দাদিমার সাথে একজনম পার করার, দাদিমাও তো তাই ছিল। আপনি যেমন পুরো জীবনটা দাদিমার তরে শেষ করলেন, তেমনি দাদিমাও তাঁর পুরো জীবনটা কাটিয়ে দিয়েছেন শুধু আপনাকে মনে রেখে,আপনার অপেক্ষার প্রহর গুনে। তিনি আর কোনোদিন বিয়ে করেননি। প্রতিটি পূর্ণিমা রাতে নদীর পাড়ে গিয়ে বসেন। এখনো আপনার পাঠানো শেষ চিঠিটা তাঁর সিন্দুকে তুলে রেখেছেন।

বৃদ্ধ মানুষটার চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে গেলো। ঠোঁট কাঁপছে। অর্ঘ্য তাঁর কাঁধে হাত রাখলো।
আমি মাথা নেড়ে বললাম,
— “দাদিমার সেই চোখে আজও আপনার ছবি আঁকা। সেই মন আজও আপনার ভালোবাসায় রঙিন।”

একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিলেন বৃদ্ধ। তারপর বললেন,
—“আচ্ছা, তুমি কি তাকে নিয়ে যাবে একদিন? শেষবার… একটিবার যদি দেখি তাকে… আমার নীলাবতিকে…”

আমার চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছিলো। অর্ঘ্যের হাত তখন আমার হাতের ওপর। এক অদ্ভুত নীরবতা চারপাশে নেমে এলো—সেই নীরবতা, যা শুধু সত্যিকারের ভালোবাসার ভাষা বোঝে।

শেষ দেখার প্রতীক্ষা—আসলে তা আর কেবল একটি দেখা নয়, একটি জীবনভর অপেক্ষার গল্প। দুইটি হৃদয়ের, যারা এক জীবনে কাছে আসতে পারেনি, কিন্তু ভালোবাসা দিয়ে একটা যুগকে বেঁধে রেখেছে।

আমি সিদ্ধান্ত নিলাম – দুইদিন বাদে পূর্ণিমায়, যেই জায়গায় এর সমাপ্তি হয়েছিলো, সেইখান থেকেই আবার শুরু করতে। হোক না একটু দেরি, তবুও হোক না শেষ দেখা, সেই প্রথম ভালোবাসার মানুষটির সঙ্গে।

লিখুন প্রতিধ্বনিতেলিখুন প্রতিধ্বনিতে

তবুও প্রশ্ন থেকে যায়—
ভালোবাসা কি শুধু দেখা হওয়ার জন্যই, নাকি চিরদিন অদেখা থেকে যাওয়ার মধ্যেই তার পবিত্রতা?

ট্রেন চলেছে আপন গতিতে। আমি চলে আসছি। পরেরদিন আসবে অর্ঘ্য আর তার দাদু।
মা কে ফোন দিচ্ছি সে অনেকক্ষণ হলো। কিন্তু মা ফোনই ধরছেনা। তাই মেসেজ দিয়ে বললাম – ” মা শোনো, সানাই বাজাও বাড়ী জুড়ে। ফুল দিয়ে সাজাও পুরো জমিদার বাড়ী। “
মাঝে একবার চোখের পাতা লেগে এলো। বোধহয় অনেকটা সময় কেটে গেছে এর মাঝে। উঠে দেখি, ট্রেন সিলেটে ঢুকে পড়েছে। আর মিনিট পাঁচেক লাগবে। আমার ফোনে মায়ের হাজার খানেক ফোন। বায়োব্রেট করায় শুনতে ই পাইনি। কি হলো? খারাপ কিছু ?

সবেমাত্র বাড়ীর সামনে আসলাম। বাইরে থেকে বাড়ীটাকে কেমন অচেনা ঠেকলো। মনে হচ্ছে, এই বাড়ীটাকে আমি চিনিনা। বাড়ীতেই ঢুকতেই দেখি – পুরো জমিদার বাড়ী জুড়ে মানুষ আর মানুষ। কিছুই বুঝতে পারলাম না। সবাই কেমন করে আমার দিকে তাকাচ্ছে। তাদের দৃষ্টি কেমন অচেনা। কোত্থেকে জানি, মা এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করে দিলো। মায়ের কান্নার ভাষা আমি বুঝতে পারলাম না। জিজ্ঞেস করলাম – কি হয়েছে?
মা যে উত্তর দিলেন, তার জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না।

  • তুই ফিরলি রে মা, কিন্তু উনার যে আর অপেক্ষা সহ্য হলো না।
    আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না। বললাম,
  • কি হলো?
  • তোর দাদিমা আর নেই রে। জীবন নাট্যের অবসান করে আমাদের ছেড়ে চলে গেছে রে।
    এই বলে আমার কান্না করতে লাগলো।

তারপর আর কিছুই কানে ঢুকছে না। মাথা ধরে এসেছে। কিন্তু কাঁদতে পারিনি। শুধু ভাবলাম – ” জীবনের অংকে সত্যি ই আমরা কাঁচা “

অর্ঘ্য, তার দাদু আর আমি দাঁড়িয়ে আছি – দাদিমার সমাধি স্তম্ভের সামনে। সেই নদী তীরের অলোকনন্দা গাছের নিচেই দাদিমার সমাধি। দাদু দাদিমার কবরের পাশেই দাঁড়িয়ে রইলেন মিনিট পাঁচেক। তারপর বললেন – “নীলাবতি, আপনি আমার অপেক্ষায় সারাবেলা কাটালেন ; কিন্তু আমি তো এসেছিলাম সন্ধ্যাবেলায়, তখন কেন আপনি চলে গেলেন? আরও কিছুক্ষণ কি রহিতে পারতেন নাহ?”
বলেই স্তম্ভের পাশে বসে পড়লেন।
এখন থেকে উনি সারাদিন দাদিমার সমাধির পাশে বসে কি যেন বিড়বিড় করতেন। লোকে বলে, উনার চিকিৎসা দরকার। কিন্তু আমি আর অর্ঘ্য জানি, এটা ভালোবাসার এক অনন্য বহিঃপ্রকাশ।

তার সাতদিন পর নয়নের দাদুও মারা গেলেন। উনার বোধহয় আর তর হইলো না। আমি আর অর্ঘ্য তাকে অলোকনন্দা গাছের নিচে, দাদিমার সমাধির সাথেই সমাধি স্তম্ভের ব্যবস্থা করলাম।

সময়টা ২০২৫ সাল। আমি আর অর্ঘ্য —একটি পূর্ণতা, একটি উত্তরাধিকার। সে এখন আমার স্বামী, আমার সহযাত্রী, আমার অর্ধাঙ্গ। আর এই পুরনো বাড়িটা? এখন আর ওটা কোনো ‘দাদিমার বাড়ি’ নয়, এটা এখন একটা প্রেম-স্মৃতির প্রাসাদ।

আমরা বদ্ধ কক্ষগুলোর সব তালা খুলে দিয়েছি—যেভাবে খুলে দিয়েছিলাম নীলাবতির অন্তরাল, আর বেনীমাধবের থেমে যাওয়া চিঠির প্রবাহ।
জীর্ণ দেয়ালে আজ ঝুলছে ল্যামিনেট করা প্রেমপত্র, আঁকা পেইন্টিং, পুরোনো কালি-মাখা কাগজ, চোখের জল শুকিয়ে যাওয়া রঙ।
এই বাড়িটা এখন এক জীবন্ত চিত্রশালা, এক অমর প্রেমের জাদুঘর —যেখানে প্রতিটি কোণ, প্রতিটি নিঃশ্বাসে মিশে আছে এক অস্পৃশ্য অনুভব।

মানুষ আসে, দেখে—কেউ ক্যামেরায় ধরে, কেউ চোখের পাপড়ি ভিজিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে দীর্ঘ সময়।
তারা বলে না কিছু, কিন্তু তারা বোঝে—সব প্রেম একে অপরের হাত ধরতে পারে না; কিছু প্রেম কেবল অপেক্ষা করে…
অপেক্ষা করে নতুন জন্মে আবার এক হওয়ার।
আমরা, আমি আর অর্ঘ্য, এখন কেবল এই বাড়ির মালিক নই—
আমরা নীলাবতি আর বেনীমাধবের পূর্ণজন্ম।
আমরা বেঁচে আছি, তাদের অসমাপ্ত গল্পকে সম্পূর্ণ করার জন্য।
তাদের নিরব কান্নার প্রতিধ্বনি আজ আমাদের হাসিতে বাজে।
আমাদের ভালোবাসায় তারা বাঁচে—প্রতিটি নিঃশ্বাসে।

এক সন্ধ্যায়, যখন মৃদু বৃষ্টির শব্দে চারপাশ ভিজে উঠছিল,
আমি আর অর্ঘ্য হাত ধরাধরি করে দাঁড়ালাম সেই কক্ষে—
যেখানে একদিন একটা নাম লেখা ছিল ধূলিভরা তালায়:
“NILABOTI”
আর আজ, ঐ দরজার ওপাশে লেখা এক সোনালী ফলকে, চকচকে করে:
“শেষ রাতের কবিতা – একটি প্রেমের জাদুঘর”
আর নীচে ছোট অক্ষরে—
“কিছু প্রেম শেষ হয় না। তারা রয়ে যায় গল্প হয়ে, নিশ্বাস হয়ে,
আর… নতুন দু’টি হৃদয়ে জন্ম নিয়ে আবার ভালোবাসে।”

আমরা চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকি—আর মনে হয়, দূরে কোথাও,
নীলিমার হাসি ভেসে আসছে বাতাসে…
আর সেই হাসিতে আমি নিজেকে খুঁজে পাই।

শেষ নয়
এটা এক নতুন যাত্রা।

Previous articleঅশ্রু
Next articleগাজীর পুকুরের পদ্ম
প্রতিধ্বনি
প্রতিধ্বনি একটি অনলাইন ম্যাগাজিন। শিল্প,সাহিত্য,রাজনীতি,অর্থনীতি,ইতিহাস ঐতিহ্য সহ নানা বিষয়ে বিভিন্ন প্রজন্ম কী ভাবছে তা এখানে প্রকাশ করা হয়। নবীন প্রবীণ লেখকদের কাছে প্রতিধ্বনি একটি দারুণ প্ল্যাটফর্ম রুপে আবির্ভূত হয়েছে। সব বয়সী লেখক ও পাঠকদের জন্য নানা ভাবে প্রতিধ্বনি প্রতিনিয়ত কাজ করে চলেছে। অনেক প্রতিভাবান লেখক আড়ালেই থেকে যায় তাদের লেখা প্রকাশের প্ল্যাটফর্মের অভাবে। আমরা সেই সব প্রতিভাবান লেখকদের লেখা সবার সামনে তুলে ধরতে চাই। আমরা চাই ন্যায়সঙ্গত প্রতিটি বিষয় দ্বিধাহীনচিত্ত্বে তুলে ধরতে। আপনিও যদি একজন সাহসী কলম সৈনিক হয়ে থাকেন তবে আপনাকে স্বাগতম। প্রতিধ্বনিতে যুক্ত হয়ে আওয়াজ তুলুন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here