মো: হাসিবুল হাসান
জমিদার পরাণ দত্ত যখন পুকুরের পানি সেচে ফেলতে চাইলেন,
তখন চাঁদের আলোয় লাল পদ্মটি যেন আরও লাল হয়ে উঠেছে। রক্ত জমে আছে তার সারা গায়ে। রক্তস্নানে সে আরও লাল হতে চায়। আরও মানুষ চায় সে।
এতটুকু বলেই নিশ্বাস ফেলল লীলাবতী। আতঙ্ক আর বিস্ময়ে জলের মধ্যে ঘেমে পদ্মটির দিকে চেয়ে আছে সফি।
ঘটনাটি শুরু থেকে শুরু করা যাক।
বাংলাদেশের যশোর জেলার গভীরে, সাতক্ষীরা জেলার কোল ঘেঁষে মনিপুর গ্রাম। একবিংশ শতাব্দীর কিশোর বয়সে এসেও বিদ্যুৎ ছাড়া আধুনিক সভ্যতার কোনো ছোঁয়া এখানে তখনো পুরোপুরি পৌঁছায়নি। কৃষিকাজ এখানকার প্রধান পেশা হলেও মাধ্যমিকের ছেলেরা প্রবাসী হবার স্বপ্ন দেখে। ১৪ থেকে ১৭ বছরের মধ্যে মেয়েদের বিয়ের বয়স। মসজিদ আর চায়ের দোকান এলাকার গনজমায়েতের মিলনস্থল।
বাড়ির মহিলারা সব চাতালে সষ্য শুঁড়নোর ফাঁকে ফাঁকে গল্প করে সময় কাটান।
এক বৈশাখের শেষ ভাগে তীব্র রোদে মাঠ পুড়ে যায়, ধান উঠানোর সময় তাই অবসর নেই কারো।
এখনো বৃষ্টির দেখা নাই, রোদের তেজও বেশি। তীব্র গরমে চাইলেও সহজে মজুর পাওয়া যাচ্ছে না। উপরি, আমের মৌসুম চলায় অনেকে আম ভাঙার কাজও করে। অর্ধেক বেলার পারিশ্রমিক, মোট আয়ের ৩ ভাগের ৪ ভাগ।
সফি তাদের এক জন। গায়ে আদুরে লোক। সংসার বলতে ছেলে আর সে। বউ গৃহত্যাগী হয়েছে স্বামীর অত্যাচারে। তাই খরচ কম, আয়ের চিন্তাও কম। সে আম ভাঙার কাজ করে। দুপুরের আগে কাজ শেষ করে বসে থাকে চায়ের দোকানে। অনেকের তখন ধান উঠানো শেষ, তারাও আসে বসে থাকে, গল্প হয় অনেক। আকাশে মেঘ দেখে অনেকে বৃষ্টির দিনক্ষণ ঠিক করে।
সেই দিন আর দিনক্ষণ ঠিক করতে হয়নি। বিধাতা সন্তুষ্ট হলেন। সূর্য ঢেকে গেল কালো ছায়া মেঘে। বৈশাখের শেষে এসে প্রথম ঝড় শুরু হলো। ধান ঝাড়ার মানুষের হট্টগোলে একটা ব্যস্ততা নেমে আসে সারা গ্রামে। কাজ শেষ না হতেই বৃষ্টির ফোটা বড় বড় হয়ে নেমে আসে। সকলে আশ্রয় খুঁজে নেয়।
সফি বাড়ির পথে হাঁটতে শুরু করে। জানালার কপাট খোলা। টিনের চালের ফুটো দিয়ে পানি পড়ে বিছানায়। সব ভেবে দ্রুত পা চালায় সে। বড় রাস্তায় না গিয়ে আমের বাগানের মধ্য দিয়ে হাঁটে। নির্জন, কিন্তু দূরত্ব কম। বাগানের মাঝামাঝি নফর গাজীর পুকুর। মানুষের যাতায়াত কম থাকায় বউঝিরা অনেকেই গোসলে আসে এই পুকুরে। উত্তর-পশ্চিমে বাঁশের ঝাড়। লোকমুখে শোনা যায়, অনেকে নাকি ভূত দেখেছে, বসতি কম তাই দরকার না হলে কেউ আসে না এই দিকে।
সফি সাহসী যুবক। ভয় তার কম। নির্দ্বিধায় হেঁটে চলে। মাঝে মাঝে যাতায়েত করে এই পথে।
আজ বৃষ্টি ভেজা দুপুরে বাতাসে কাঁচা চন্দনের গন্ধ। নিক্কণে নজর চলে যায় পুকুরের ঘাটে।
চিকন গড়নের ভেজা কাপড়ে এক ১৬/১৭ বছরের যুবা নারী মূর্তি পানি থেকে উপরে উঠছে। পেছন ফিরে থাকায় চেহারা দেখা যায় না। ভেজা শরীর, শাড়ি লেপ্টে আছে দেহে। যৌবনের ছাপ স্পষ্ট। সফি মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে দেখে লোভাতুর চাহনিতে।
সাদা পায়ের পাতা যেন পুকুরের জলে ভিজে আরও সাদা হয়ে উঠেছে। সে ঘোরেই আটকে যায় সফি। কতক্ষণ তাকিয়ে আছে জানে না।
তন্দ্রা ভাঙে বজ্রপাতের শব্দে। যেন স্বপ্ন থেকে বাস্তবে ফিরে সফি।
চিন্তা, চেতনায় বারবার সেই বাঁকা দেহে, নাম না জানা বউটা।
কিছুদিন যেতেই দিনের কর্মব্যস্ততায় ভুলে যায় সেই স্মৃতি। মনের ভুল ভেবেও এড়িয়ে চলে।
মাঝে এক দিন বেশি খাটুনিতে ক্লান্ত শরীরে তাই বাগানের পথ ধরে সফি। গাজীর পুকুরের কাছে আসতেই আবার কাঁচা চন্দনের গন্ধ। মন ভরে যায় উৎসুখে ক্লান্তি কেটে যায়। চোখ চলে যায় পুকুর ঘাটে।
এ কে সে ! কাঁচা হলুদের মত উজ্জ্বল দেহ। জবার মত গাল, কমলার মত ঠোঁট। মাথায় লম্বা রেশমি চুল। আদুরে হাতে ধুন্দুলের ছোঁবা দিয়ে শরীর মাজছে। চোখে মার্বেলের মত মনি। সফির চোখ আটকে আছে মুগ্ধতায়।
মাজা শেষে আস্তে আস্তে পানিতে নামে বউটা। চোখাচোখি হয় সফির সঙ্গে। চাহুনি স্বাভাবিক। যেন জানত সফি এখানে আছে। কোনো ভয় নেই, সংকোচ নেই। বরং ধরা পড়ে যাওয়ায় সফি লজ্জিত হয়।
স্নান শেষে সে কোথায় মিলিয়ে গেল বোঝা গেল না—জলে, না বাঁশবনে।
দিন গড়িয়ে যায়। সেই রূপ, সেই চাহনি তাকে আবদ্ধ করে রেখেছে।
এখন প্রতিদিন এই পথেই যাতায়াত করে সফি কার্যত বউ কে দেখার উদ্দেশ্যেই। কিন্তু আর দেখা মেলে না।
বৃষ্টির বিকেলে কোচ হাতে মাছ ধরতে পুকুরে আসে সফি ,বাতাসে সেই কাঁচা চন্দনের গন্ধ। চারদিকে ঘুরে ঘুরে সেই পুকুরেই ফিরে আসে বারবার। কোথাও কারো দেখা নেই।
মায়ার টানে এখন নিয়ম করে রোজ পুকুরের ঘাটে আসে সফি।
এক পড়ন্ত বিকেলে সন্ধ্যার আগমুহূর্তে দেখা মেলে বউটার। সাহস করে সফি হাত ধরে তার। শীতল শিহরণ বয়ে যায়।
– বউটা অস্ফুটস্বরে বলে, “ছাড়ুন, লাগছে।”
এই প্রথম স্পর্শ। প্রথম শোনা সুর। যেনো কোন অভিজ্ঞ বাদ্যকারকেও হার মানানো সেই সুর।
সফি আরও জোরে চেপে ধরে হাত।
– “আজ দেরি হয়েছে, আবার আসব,” বলে হাত ছাড়িয়ে নেয় বউটা।
সফি মন্ত্রমুগ্ধ। কিছু জিজ্ঞেস করতে পারে না। শুধু চেয়ে থাকে।
তার হাতে লেগে থাকে চন্দনের গন্ধ। মনের মাঝে আকুলতা।
ইদানীং পুকুরের পাশে তার বেশি সময় কাটে। পুকুর পাড়ের চালতা গাছ, বাঁশবন সবাই তার বন্ধু। কিন্তু বউটার দেখা আর মেলে না।
লক্ষ্য করে পুকুরে নতুন এক পদ্ম ফুটেছে। দূর থেকে দেখে মনে হয় রমণীর কপালের টিপ। রক্তলাল পদ্ম।
সফির মনে হয়, আজ যদি বউটা আসে, তার খোলা খোঁপায় গুঁজে দেবে পদ্মটি। কিন্তু সে আসে না।
নিয়ম করে প্রতিদিন অপেক্ষায় থাকে সফি।
বিকেল থেকে সব কিছু স্তব্ধ। আকাশে ধূসর মেঘ। সফির ছেলে এসে জড়িয়ে ধরে।
সে বিরক্ত হয়। যদি বউটা জেনে যায় তার ছেলে আছে, সে বিবাহিত তখন হয়তো দূরে সরে যাবে! এমন ভাবতে ভাবতে ছেলেকে সরিয়ে নেয়। ছেলের গায়ে জ্বরটা সে টেরও পায় না।
কমনার টানে পুকুরের দিকে চলে যায়।
আজ পুকুরে সেই চন্দনের গন্ধ আরও তীব্র। বাঁশ গাছ বেশিই নুয়ে পড়েছে। পদ্মটি আজ আরও লাল। সন্ধ্যা জুড়ে মন বলছে বউ আসবে তাই সফি সেখানেই থেকে যায় আজ পুর্নিমা জেগেছে
রূপালী আলোয় জল ছুঁয়ে ভেসে আসে নূপুরের শব্দ। বউটা কখন এসেছে খেয়াল করেনি। আজ সে এসেছে সাদা শাড়িতে, অন্তর্বাসবিহীন।
কামনায় উন্মাদ হয়ে নিজেই জলকেলি খেলতে জলে নামল সফি। বউটার চোখে সম্মতি। ঠোঁটে হাসি।
সফি ব্যাকুল কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে, “কে তুমি? কোন মোহে আমায় ডেকে আনছো?”
বউটা ধীরে বলে, “আমি লীলাবতী।”
সফি চেনে না। চেনার দরকার নেই তার।
– “আমি যে বন্দিনী,” বলে বউটা।
– “জগতে সব বন্ধন ছিন্ন করে তোমাকে পেতে চাই।”
– “লালসার চোখ আমায় বন্দি করে রেখেছে।”
– “কে সেই পাষণ্ড?” ক্রোধে জিজ্ঞেস করে সফি।
– “আমার অতীত। স্বামীর সংসারে ঠাঁই হয় নাই তার পরকীয় প্রেমের কারণে। বাবার অভাবের সংসারে আমি হাতির খরচ। পূর্ণ যৌবনা কত ছেলের কল্পনায় আমি থাকি বলা মুসকিল। তাদের মধ্যে একজন জমিদার পরাণ দত্ত। সে আমাকে পেয়ে চায় ভোগ দাসীর রূপে। তাই
মানুষ থেকে আড়াল করে, জমিদার পরাণ দত্ত আমাকে আমারই বসতঘরে বন্দি করল।
উম্মাদ স্বামীর সাক্ষ্যতে বদনাম রটালো—আমার ওপর জীনের আসর। ঘর থেকে বের হওয়া বন্ধ হলো। বাবা দ্বিতীয় বার বিয়ের আশা করলেন জীনের আসরের কথা শুনে বহু বিয়ে ভেঙে গেল। মানুষের সঙ্গ কমতে থাকলো। পৌড়া মহিলা কিশোরী,অন্তস্তত্বা মেয়েদের আমার থেকে দূরে রাখা শুরু করলেন।
এই দিকে পরাণ দত্ত প্রতিনিয়ত তার প্রচেষ্টা করেই যাচ্ছে। সকল চেষ্টা করেও যখন পরাণ দত্ত আমাকে পায় না। তখন হুমকি দেয় মৃত্যুর। অনেককে নাকি মেরে ডুবিয়েছে এই পুকুরে। আমার পরিণতিও তাই হবে। আমি বিস্মিত হয় কিন্তু সাহস রাখি নিজের কাছে।
কিন্তু এক পূর্ণিমা রাতে দত্তের পৈশাচিক শক্তিতে পরাস্ত হই।আমার সকল সাধনা সকল সাহস এক লহমায় ভেঙে যায়। কিছুদিন পর আমি গর্ভবতী হই। লোক জানাজানি হলে পরিবারও আমার থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়।চরিত্রহীনা বলেও আমার নাম রটে যায়। আমি সবার থেকে হারিয়ে যেত চাই। পুকুরের এই কোনে নিজের মত করে থাকা শুরু করি। বনের ফলে আহার চলে যায়।
এই বাঁশবন তখন আরও গভীর। এই পুকুর তখন আরও স্বচ্ছ। প্রায়শই এখানে স্নানে আসতেন পরাণ দত্তের ষোড়শী মেয়ে। তেমনি একদিন,
গায়ের অলংকার খুলে নামলেন পুকুরের জলে।
মনের পাপে সেই অলংকার আমি চুরি করি। ইচ্ছে ছিল, আমি অন্য শহরে চলে যাব।
মরার ইচ্ছে আমার ছিল না।
চুরির খবর চাপা থাকলো না—ছড়িয়ে গেল হাটে-বাজারে। সেই অলংকারের মধ্যে ছিল পর্তুগিজ নাবিক ক্যাসেজের দেওয়া একটি বাজু,
যা উপহার পেয়েছিলেন পরাণ দত্তের মা তাঁর ১১তম জন্মদিনে।
সেই অলংকার তিনি দিয়ে গিয়েছিলেন পরাণ দত্তের মেয়েকে।
ক্যাসেজের সেই বাজু তখন এতটাই মূল্যবান যে পরাণ দত্তের মা প্রতি উৎসবে তা পরতেন।
তাই সকলের কাছে পরিচিত ছিল সেই অলংকার।
দুর্লভও বটে, তাই সহজেই ধরা পড়ে যাই আমি।
রাগে-ক্ষোভে পরাণ দত্ত আমাকে তার অন্ধ কুঠুরিতে বন্ধ করে রাখেন।
কিছুদিন পরে আমাকে নেওয়া হয় তার রংমহলে—পরিচিত বন্ধুদের কামনার আগুন মেটানোর এক ভোগের বস্তু হয়ে উঠি আমি।
গর্ভের সন্তান গর্ভেই মারা যায়।
অসুস্থ হয়ে চারদিন পর আমিও মারা যাই।
আমার লাশ পুতে ফেলা হয় এই পুকুরের জলে।
সবাই জানলো, আমাকে আবার জীনে ধরেছে।
আমি হয়তো পরীস্থানে চলে গেছি।
সেই থেকে আমি বন্দি এখানে, এক লাল পদ্ম হয়ে।
প্রতিবেশিরা হায় হায় করলো।
বাবা-মাকে অনেকে সান্ত্বনা দিলেন।
মানুষের মনে তখন আমি লোককথা হিসেবে রয়ে গেলাম।
এরই মধ্যে আবার একদিন জমিদার কন্যা স্নানে আসে পুকুরে।
হিংসা ও ক্ষোভে পদ্মের লতায় আটকে রাখি তাকে।
আমার সামনে পানিতে ডুবে মারা গেল সে।
আমার তখন অনেক আনন্দ।
আমার তখন রক্তের নেশা জেগেছে।
দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়।
বোকা জমিদার সমস্ত গ্রাম খুঁজে খুঁজে হয়রান।
পুকুরের ঘাটে যখন তার মেয়ের শাড়ি দেখে, তখন তার বুঝতে বাকি থাকে না—তার মেয়ে এই পুকুরের জলে মিশে গেছে।
তাই সে সব জল সেচে ফেলতে চায়।
রূপালী চাঁদের আলোয় পদ্ম তখন আরও লাল।
তার আরও রক্ত চাই।
রক্তের পিপাসায় মত্ত আমি তখন।
লাল পদ্মকে আরও লাল করতে চাই।
মানুষের মৃত্যুতে পাপড়ি গজায়—আরও পাপড়ি চাই আমার।
এই বলে উচ্ছ্বসিত হাসির শব্দ যেন আকাশ-বাতাস ভারি করে দিচ্ছে।
পুকুরের জলের মধ্যেই বিস্ময়ে ঘামছে শফি।
বাতাসে চন্দনের গন্ধ।
আস্তে আস্তে একটা পদ্মের লতা তার পা বেয়ে উপরে উঠে আসছে।
নিচের দিকে তলিয়ে যাচ্ছে শফি।
নিঃশব্দ আর হাসির শব্দে ভরে উঠছে চারদিক।
শেষবার দেখলো—পদ্মটা আরও লাল হয়ে আছে।
বউটা হাসছে,
সাথে ক্যাসেজের বাহুবন্ধনী পরা এক মেয়ে।
তার গৃহত্যাগী বউ তাকে স্বাগতম জানাচ্ছে।
চাঁদের রূপালী আলোয় লাল পদ্ম আরও লাল।
