নুজহাত বিনতে গাউসুল
সারাবছর খেটে পেলুমটা কী? এই ঢেঁকি চালের দু – মুঠো ভাত আর ধনেপাতার ভর্তা ।কতদিন হলো একটা সন্দেশ খাই না !” বলতে বলতে ধানক্ষেতের আইল দিয়ে হরিণের মতো বেগে ছুটে চলেছে কুমুদী সবজিওয়ালী।মাথায় তার এক ঝুড়ি পটল ও হাতে ছেড়া কাপড়ের থলে ।চোখে মুখে ক্লান্তি ও বেদনার স্পষ্ট প্রলেপ যেন ময়লা সাদা শাড়ির মলিনতা আরও দশগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। ধানক্ষেত পেরিয়ে চৌরাস্তার মোড়ে শিমুল গাছটার কাছে আসতেই নরেন দৌড়ে এসে মা কে জড়িয়ে ধরে…।
“কই ছিলি রে মা এতক্ষণ? খিদের চোটে পেটের ইঁদুরগুলো যেন এক্কাদোক্কা খেলছে।”
“আসার সময়টুকু তো দিবি আমাকে ! চল বাড়ি চল । গিয়ে সেদ্ধ ভাত খেতে দেব।আজ সাথে করে রমেশ বুড়োর বাগান থেকে কয়েকটা পটল এনেছি। পটলভাজি দিয়ে খাবি , চল।”
“কতদিন মাংস খাই নারে মা।একটু মাংস রেঁধে দে না।”একমাত্র ছেলের এই ছোট্ট আবদার শুনে কুমুদীর চোখে মুখে আঁধার নেমে এলো।কথা না বাড়িয়ে হুট করে ছেলের গালে কষিয়ে পরপর দুটো চর মেরে দিল।
“এত্ত আবদার কেন রে তোর! হাবার বংশের পুত হয়েছিস?যা আছে তাই দিয়ে খেলে খাবি নইলে মাথা ঠুকে মর।”
“আর কত্ত সইবো মাগো, মন আর পেট দুটোই যে ভরে না।”
ছেলের কথা শুনে চোখের কোণে জল আসলেও পরক্ষণে ছেলের হাতটা ধরে বাড়ির দিকে ছুটে চলে কুমুদী। তুখর রোদে খেটেখুটে বাড়িতে এসেও কুমুদীর দায়িত্বের সমাপ্তি ঘটে না।কুমুদীর বয়োজ্যেষ্ঠ পতি কুষ্ঠরোগে মারাত্মকভাবে আক্রান্ত ।
” লোকটার হাতে বোধহয় আর বেশিদিন নেই ” বলতে থাকে পাশের বাড়ির পিসিমা । রাখালের মা উচ্চস্বরে কুমুদীকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলে ,” মিছে খেটে মরছে বাপ মা হারা মেয়েটা ।”
এসব শুনেও কুমুদীর কোনো ক্ষোভ প্রকাশ পায়না , রাগ হয়না।স্বামী সন্তানের মঙ্গল সাধনা করাটাই তার কাছে একমাত্র ব্রত।গায়ের মানুষের কথা ও টিটকারি তোয়াক্কা না করেই দিন কাটিয়ে দেয় কুমুদী। হাঁড়ি থেকে দু – মুঠো ভাত নিয়ে ছেলের পাতে দিয়ে বলে ,” ভালো করে খা বাবা, এর চেয়ে বেশি আর নেই।”
” মাগো তুই খাবিনে?”
” খেয়েছি রে বাবা , অঢেল খেয়েছি।”
কুমুদীর বলা কথাটা যে মিথ্যে টা উপলব্ধি করতে নরেনের বেশি সময় লাগলো না ।
” মিছে কথা বলিস কেন মা?”
ছেলের কথাটাকে রীতিমতো উপেক্ষা করে কুমুদী ছুটে যায় তার পতির কাছে।ভাত ও পটলের তরকারি মেখে খাইয়ে দিতে দিতে বলে ,” ওগো , তুমি কবে সুস্থ হবে? মনে আছে আমাদের সদ্য বিয়ের পরে নবান্ন মেলায় তুমি আমাকে রেশমি চুড়ি উপহার হিসেবে দিয়েছিলে । গুটি কয়েক ভেঙে গিয়েছে। তবে জানো তো, প্রতিদিন এগুলো পরেই কাজ করতে যাই।তোমার ভালোবাসার চিহ্ন আমার সাথেই রাখি । মুছে যেতে দিই না।”কুমুদী এভাবেই আপন মনে তার স্বামীর সাথে নিত্যদিনের সুখ দুঃখের আলাপ করতে থাকে । প্রত্যুত্তরে বিশাল উত্তর আশা করলেও শোনা যায়না কোনো শব্দ। তবে তার এতে কোনো যায় আসে না । নিজেকে সান্তনা দেওয়ার মতো আর কোনো ভাষার শব্দ খুঁজে না পেলেও মনে মনে বলে , ” সবকিছু নিশ্চয়ই একদিন ঠিক হয়ে যাবে ।ভগবান আমার প্রতি অবিচার করবেন না ।”
তার মনের কোণে এই বৃথা সান্তনা যেন মোমবাতির নিভু নিভু আলোর মতো মাঝে মাঝে প্রজ্জ্বলিত হয়। কখনো নিভে যায় , আবার কখনো জ্বলে ওঠে , যেন কোনো নিশ্চয়তা নেই।এভাবেই কুমুদীর দিন কাটে ।স্বামীর সেবা করে,ছেলের ক্ষুদ্র আবদার পূরণের প্রচেষ্টা করেই তার কপাল থেকে শনি বিদায় নেয়। নিজের জন্য কোনো সময়ই খুঁজে পায়না কুমুদী। মাথায় শুধু সংসার সামলানোর দুশ্চিন্তাই ঘুরপাক খায়।তবে সংসারটাকে মন প্রাণ দিয়ে ভালোবাসে সে। সংসারের মায়াজালে নিজেকে বন্দী দেখতে চায়। সংসার নিয়েই সুখী হতে চায়।অবহেলিত মানবী হলেও বিশাল আকাঙ্ক্ষা তার।
তবে কল্পনার জগৎ ও বাস্তবতার মধ্যে ফারাকটা সে উপলব্ধি করতে পারে না।নইলে স্বামী ও ছেলের মৃত্যুর পরেও তাদের যত্ন নেওয়ার স্বপ্নটা পূরণে নিজের বানানো জগতে হারিয়ে যেতে পারতো না।লোকে বলে কুমুদীকে ভূতে ধরেছে। ওঝা নিয়ে এসে ঝাড়ফুঁক করিয়ে কোনো লাভ হয় না।রাখালের মায়ের পরামর্শ অনুযায়ী মরিচ পোড়া, কলা পোড়া খাইয়েও ব্যর্থতার গ্লানি ঘুচে যায় না। কুমুদী কোনোভাবেই তার জীবনের কঠোর সত্যটাকে মেনে নিতে রাজি নয়।কল্পনা ও বাস্তবতার ভেতর সেতুবন্ধ তৈরি করার বৃথা প্রচেষ্টায় সে মগ্ন। লোকে তাকে বোঝানোর হাজার চেষ্টা করলেও সব চেষ্টাই বৃথা।আবেগ আপ্লুত কুমুদী প্রতিদিনের কর্তব্যগুলো নিপুণভাবে পালন করে। স্বামী ও ছেলের জন্য লাল চালের ভাত রান্না করে সে। ছেলের জন্য মাংস কিনে আনার ব্যবস্থা করতে দু – ঘণ্টা বেশি কাজ করে । সংসারের সকল দায়িত্ব পালনে সে দৃঢ়বদ্ধ।
গ্রামের কবিরাজ, শহুরে ডাক্তার, ওঝা, হজুর , পুরোহিত মশাই সকলেই ব্যর্থ।তাই কেউ আর তাকে বাধা দেয় না । কল্পনার জগতে বাস করেই সে যদি সে আনন্দ পায়, তবে তাই হোক।তাই গ্রামের সকলে না চাইতেও তাকে মিথ্যে কল্পনার জগতে আটকে থাকতে সহযোগিতা করে। প্রতিদিনের সাংসারিক কাজকর্ম শেষ করে কুমুদী যেন আলাদা প্রশান্তি লাভ করে।কল্পনার জগতকেই সে বাস্তবতা হিসেবে স্বীকার করে নিয়েছে । নিজের অজান্তেই হয়ে উঠেছে তথাকথিত মানসিক রোগী।তবে লোকের কথায় কান না দেওয়া তার স্বভাব।তাই ভগবানের ওপর আস্থা রেখে সাংসারিক দায়িত্ব পালন করে যেতে চায় আজীবন। অবুঝ মানবী বলতে থাকে ,” ভগবান নিশ্চয়ই আমাকে নিরাশ করবেন না। স্বামী ও ছেলে নিয়ে একদিন আমি স্বর্গে যাবই।”তার ক্ষুদ্র কল্পনার জগত হয়তো মৃত্যুর সাথে সাথেই ভেঙে চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে যাবে।তবে তার ঠোঁটের কোণে হাসি, চেহারায় প্রশান্তি ও আনন্দের প্রলেপ স্পষ্ট দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।
কুমুদী তাই রঘু কাকার দোকানে গিয়ে এখনো বলে, “দুটো নলেন গুড়ের সন্দেশ দিন না কাকা। ছেলেটা খাবে। আমিও নাহয় একটা খেলাম।”
~সমাপ্তি~
