মাসুমা সুলতানা হাসনাহেনা
নীল চাঁদোয়ায় ঢাকা আকাশ।
তারাগুলো মিটি মিটি জ্বলছে,
চাঁদের আলোয় চারিদিক ঝলমল করছে।
ঈশার নামাজ শেষে জাবির ও তার বন্ধু বাসায় এসেছে,
বাসায় এসে জাবির খানা শেষ করে একটু হাঁটাহাঁটি করে, ঘুমানোর জন্য বিছানায় গা এলিয়ে দিল।
কিন্তু তার দু-চোখে আজ বিন্দুমাত্র ঘুমের রেশ নেই।
মাথা কালচক্রের মতো ঘুরপাক খাচ্ছে।
কাল যে তাকে রওনা দিতে হবে নারায়ণগঞ্জ মামার বাড়ির উদ্দেশ্যে।
মামা বাড়ির পথ আধো আধো চেনা তার।
সে ঠিক মতো পৌঁছাতে পারবে কি না, মামা বাড়ি পৌঁছে সে কি কি করবে, কোথায় ঘুরবে,
এসব নানান চিন্তায় সে এখন অস্থির।
জাবিরের বাসা মুহাম্মদপুর ঝিগাতলা।
সপ্তম শ্রেণীর প্রথম সারির ছাত্র সে।
সবাই তাকে এক নামেই চিনে।
বাবা- মা চাকুরির কাজে ব্যস্ত থাকায় তাকে একাই পাড়ি দিতে হবে মামা বাড়ির অচেনা পথঘাট।
নানান কথা ভাবতে ভাবতে জাবির ঘুমিয়ে গেল।
মুয়াজ্জিনের সুমধুর কন্ঠে ঘুম ভাঙল তার।
আলসেমি দূরে ঠেলে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ে সে।
নির্মল স্নিগ্ধ সকাল।
পাখিরা কিচির মিচির জিকিরে ব্যস্ত।
সকালের আলো ফুটেছে,
পূব আকাশে সূর্য চিকচিকে আলো ছড়াতে শুরু করেছে।
জাবির ব্যাগ কাঁধে বেরিয়ে পড়ে।
বাবা অফিস যাওয়ার পথে জাবির কে নারায়ণগঞ্জ শহরের বাস ধরিয়ে দেন।
বাসে উঠে পড়ে সে।
পথঘাট,গাছগাছালি, সবুজ বন সব মাড়িয়ে বাস ছুটে চলে তার নিজস্ব গন্তব্যে।
জাবির ব্যাগ থেকে ম্যাগাজিন বের করে পড়তে আরম্ভ করে,
কিছুক্ষণ পর,
কখন যে সে, মামাবাড়ির সামনে পৌঁছে গেছে বুঝতেই পারে না।
জাবিরের আাসাতে মামা মামি খুব খুশি হলেন।
নানু নানি বেঁচে থাকলে উনারাও খুব খুশি হতেন।
কিন্তু কয়েকবছর আগে নানু, নানি গত হয়েছেন।
মামা বাড়ি দু’দিন বেশ আনন্দময় কাটিয়ে বাসায় ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছে জাবির।
মামা জাবিরকে মোহাম্মদপুরের বাসে উঠিয়ে দিলেন,
জাবিরের হাতে গুঁজে দিলেন কিছু টাকা।
জাবির বাড়ি ফেরার বাসে চড়ে বসে।
বাস ছেড়ে দেয়,
কিছুক্ষণ পর,
হঠাৎ পথিমধ্যে, বাসের হেল্পার জাবিরের থেকে বাস ভাড়া নিয়ে, জাবিরকে মাঝরাস্তায় নামিয়ে দেয়।
পথ ঘাট চেনা নেই তার।
সামনে দেখতে পায় একটা সাইনবোর্ড টানানো।
তাতে বড় বড় অক্ষরে লেখা গুলো পড়ে সে বুঝতে পারল,
বাসস্ট্যান্ড পৌঁছাতে এখনো অনেক পথ বাকি।
জাবির একা পথে হাঁটতে লাগলো ।
পকেটে হাত দিয়ে দেখে সেখানের বাকি টাকা গুলোও নেই।
হারিয়ে ফেলেছে সে।
হতাশ হয়ে পড়লো জাবির।
এভাবেই হাঁটতে হাঁটতে
একটা বাসের দেখা পেল ।
দ্রুত সেটাতে উঠে পড়ে।
বাসের কোণায় গিয়ে মন খারাপ করে, নিশ্চুপ হয়ে, বসে থাকে।
তার পাশের সিটে বসা ছিল একজন অফিস ফেরত ক্লান্ত মুসাফির।
সবাই তাকে নূর সাহেব বলে ডাকেন।
সারাদিনের ক্লান্তি শেষে এখন বাসায় ফেরার একমাত্র উদ্দেশ্য তার।
হঠাৎ তার নজরে পড়ে জাবিরের ছোট্ট মন মরা মুখখানা।
নূর সাহেব তার কাছে এসে জিজ্ঞেস করেন,
কোথায় যাবে?
:মুহাম্মাদপুর ঝিগাতলা।
সাথে কেউ নেই?
:না,
জাবির কাঁদো কাঁদো স্বরে বলে, পথ হারিয়ে ফেলেছি।
গিয়েছিলে কোথায়?
নারায়নগঞ্জ মামা বাড়ি।
নূর সাহেব সব শুনে বুঝতে পারলেন জাবির নিঃসঙ্গ এবং পথহারা।
তিনি জাবিরকে ভয় কাটিয়ে উঠার আশ্বাস দিলেন।
সাথে দিলেন এক বুক সাহস।
ইতিমধ্যে তিনি তার নিজ গন্তব্যে এসে পৌঁছালেন।
হেল্পারের সাথে কথা বলে তিনি জাবিরের ভাড়া মিটিয়ে দিলেন।
জাবিরকে বিদায় জানিয়ে বাস থেকে নেমে এলেন। কৃতজ্ঞতায় জাবিরের চোখ ছলছল করে উঠলো।
পুলকিত নয়নে মুসাফির ব্যক্তির যাওয়ার পথে চেয়ে রইল সে।
নূর সাহেব অশান্ত মন নিয়ে বাড়ি ফিরলেন।
তার মনে একটাই চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে,
আদৌও কি ছেলেটা বাড়ি ফিরতে পেরেছে?
নাকি আবার পথ হারিয়ে ফেলেছে!
অজানা শহরের গলিতে।
আল্লাহ ভরসা!
তাওয়াক্কালতু আলাল্লাহ।
