জুবায়ের হুসাইন
আজ যেনো কিসে পেয়ে বসেছে নূরুল ইসলামকে। অনবরত স্মৃতির খাতার একেকটা পাতা হাতড়ে চলেছেন তিনি। স্মৃতির খাতাটা এখনও খুবই স্পষ্ট তার কাছে। তাই ছবি হয়ে বয়োস্কোপের মতো সম্মুখে ভেসে উঠছে সব।
নূরুল ইসলাম আজ সকাল সকাল অফিস থেকে চলে এসেছেন। বছরের এ দিনটাতে তিনি এরকমই করেন। ঘরে ফিরে সোজা বিছানায়। চিত হয়ে শুয়ে আকাশ-পাতাল ভাবেন। শৈশব ও কৈশোরের চঞ্চলতায় অস্থির হয়ে ওঠেন। তারুণ্যের উš§াদনায় হারিয়ে যান। কেমন ছটফট করতে থাকেন তিনি।
আজও এসবের ব্যতিক্রম হল না। দরোজা ভেজিয়ে দিয়ে শরীরটা এলিয়ে দিলেন বিছানায়। শক্ত বিছানা। কাঠের খাটের উপর কাগজের কার্টুন, তার উপর একটা মোটা কাঁথা ও একটা বেডশীট পাতা। শরীরটাকে টানটান করে দিয়ে চিত হয়ে শুয়ে পড়লেন তিনি। হাতজোড়া উঠিয়ে নিলেন কপালে। বৃদ্ধাঙ্গুলি দু’টো দু’পাশের রগে লাগাতে ও দু’টোর চঞ্চলতা স্পষ্ট টের পাচ্ছেন তিনি।
এই মুহ‚র্তে নূরুল ইসলাম তার শৈশবের দিনগুলোতে সাঁতার কাটছেন।
নূরুল ইসলামের জš§ গ্রামে, তার মামা বাড়িতে। ছায়া-ঢাকা, সবুজে মোড়া, খোলা আসমান নিয়ে ছিলো গ্রামটি। অপরূপ সৌন্দর্যের যেনো এক আধার!
শৈশবের দিনগুলোতে তিনি ছিলেন খুবই চঞ্চল। কতো রকম স্বপ্ন যে তখন তার হৃদয়ে বোপিত হতো! তার কোনোটিই হয়তো বাস্তবায়নের ছিলো না। তারপরও তিনি স্বপ্ন দেখতেন। নিত্য-নতুন স্বপ্ন চাষ করতেন মনে। ক্রমে তার ডাল-পালা গজাতো। বিস্তার লাভ করতো। তিনি হয়ে উঠতেন স্বপ্নচারী। মনটা হয়ে উঠতো স্বপ্নের একটা বিশাল বৃক্ষÑ ঠিক যেনো গ্রামের মাঝখানে প্রকাÐ বট গাছটা। চারিপাশে অনেকখানি জায়গা নিয়ে তার স্বগৌরব উপস্থিতিÑ ঝুরিগুলো বিস্তৃত। সবুজ পল্লবে ছায়াদার। কতো না কালের, কতো ইতিহাস আর ঐতিহ্যের সাক্ষী এই বটগাছ!
বটগাছটার কাছে গেলেই তিনি যেনো কেমন হয়ে যেতেন। কতোবার যে গেছেন আর ঝুরি ধরে টারজানের মতন দোল খেয়েছেন তার ইয়ত্তা নেই।
শৈশবে নূরুল ইসলাম যতোটা না ছটফটে ছিলেন কৈশোরে ছিলেন আরো দূরন্ত, বাঁধনহারা। সমস্ত গ্রামের ওলি-গলি-ঘুপচি ছিল তার নখ দর্পনে। চৌধুরীদের প্রকাÐ প্রাসাদ, সৈয়দ বাড়ির বিশাল আমবাগান, নায়েব মুন্সীর কলাবাগান ও কচুক্ষেত, রাসুদের সুপারি বাগান এবং টিপুদের শাপলা ফোটা পুকুরÑ সবটাতেই ছিলো তার অবাধ বিচরণ। বন্ধুদের সাথে দল বেঁধে হই-হুল্লোড় করেই কাটতো তার সারাটা দিন।
সে সময় রোজা এলে পুরো মাসটাই স্কুল ছুটি থাকতো। সকালে শুকনো মরিচ পোড়া ও পিঁয়াজ দিয়ে পান্তা ভাত খেয়ে ছুটতেন খেলতে। একদিন-দুইদিন পর একটা করে রোজা রাখতেন।
গোল হয়ে বসে বন্ধুদের সাথে খেলা করছেন তিনি। এ সময় মার্বেল খেলা হতো বেশি। সাতচাড়া, হা-ডু-ডু, ডাংগুলি এসব খেলাও চলতো সমানে। খেলতে খেলতে কখন যে দুপুর হতো, দুপুর গড়িয়ে বিকেল আর তারপর ঝুপ করে নামতো সন্ধ্যা তা তারা কেউ টের পেতেন না।
নুরুল ইসলাম বন্ধুদের সাথে খেলা করছেন; হঠাৎ দে ছুট। কারণ, মায়ের হাতের লাঠি “সপাং” করে পড়েছে তার পিঠে। কখনও কখনও জুটতো ধুমধুম কিল কিংবা চড়াৎ চড়াৎ চড়্। আড়ালে লুকিয়ে অপেক্ষা করতেন। মা শাসিয়ে চলে যেতেন। তারপর বেরিয়ে আসতেন তিনি এবং আবার খেলায় মন দিতেন। বন্ধুরা অবশ্য মানা করতো; কিন্তু কে শোনে তাদের মানা! নূরুল ইসলাম লক্ষ্য করতেন কেবল তার মা-ই এভাবে তাকে শাসন করতেন। তখন না বুঝলেও আজ তার কারণ তিনি বোঝেন। আজ তার ফলও তিনি পেয়েছেন।
সন্ধ্যায় ধুলো-ময়লা মেখে বাড়ি ফিরতেন নুরুল ইসলাম। অবশ্য রোজার দিনে ফিরতেন ইফতারের আগেই। তখন ছাড়া অন্য দিনগুলোতে চলতো মায়ের দ্বিতীয় প্রস্থ অ্যাকশন, বকুনি। তিনি সোজা চলে যেতেন কলপাড়ে, মুখ-হাত-পা ধুয়ে বারান্দায় মাদুর (খেজুর পাতার তৈরি) বিছিয়ে বই-খাতা নিয়ে বসে যেতেন। মা গজরাতে গজরাতে ঝকঝকে কাঁচের হারিকেনটা দিয়ে যেতেন। চোখে আলো লাগতো বলে খাতার কাগজ ছিঁড়ে চিমনিটা ঢেকে দিতেন। নিচের দিকে ফাঁক থাকতো যেখান দিয়ে আলো এসে পড়তো বই-খাতার উপর।
শব্দ করে পড়তেন নূরুল ইসলাম। তার ভাই বোনেরাও পড়তো চারিপাশে বসে। বাবা রান্না ঘরে মায়ের ওখানে বসে বই পড়তেন। রান্না শেষ হলে মা খেতে ডাকতেন। ব্যস, আজ ছুটি। আর পড়তে হবে না। রান্না ঘরে কাঠের পিঁড়িতে বসে খেতে বসতেন সবাই। মা ভাত-তরকারি বেড়ে দিতেন।
এতো দূরন্তপনার পরও ছাত্র হিসেবে ভালো ছিলেন নূরুল ইসলাম। ফাইভে ট্যালেন্টপুল এবং এইটে জেনারেল গ্রেডে বৃত্তি পেয়েছেন তিনি। এসএসসিতে ৫টি বিষয়ে লেটারসহ স্টার মার্কস আদায় করে নিয়েছেন। অবশ্য এইচএসসিতে কোনোরকম ফার্স্ট ডিভিশন পেয়েছেন তিনি। ম্যাথ ফার্স্ট পেপারের আগের দিন বকুলপুরের সাথে হা-ডু-ডু খেলাটা না থাকলে আরো ভালো করতে পারতেন হয়তো। গায়ে প্রচÐ ব্যথা হওয়ায় বেশিক্ষণ পড়তে পারেননি তিনি। আর এই পরীক্ষাটা খারাপ হওয়ায় অন্যগুলোর উপরও তার প্রভাব পড়ে ।
‘আব্বু, আব্বুজি…’
মেয়ের ডাকে স্মৃতিচারণে ছেদ পড়লো। কপাল থেকে হাত সরিয়ে বললেন, ‘কী মা-মনি? কিছু বলবে?’
‘আব্বু আপনি কি এখন কোনো নাস্তা করবেন?’
‘না আম্মু, এখন নাস্তা করবো না।’
‘থ্যাংকিউ আব্বুজি।’
নূরুল ইসলাম আবার হারিয়ে গেলেন। তবে শীত শীত লাগাতে পাতলা কাঁথাটা গায়ে জড়িয়ে নিলেন।
নুরুল ইসলাম বরাবরই তার দাদীর সাথে এক বিছানায় ঘুমাতেনÑ যতোদিন দাদী জীবিত ছিলেন। দাদী তাকে খুবই আদর করতেন। একমাত্র তিনিই তাকে ‘নূরো’ বলে ডাকতেন। ডাকটা খুবই মধুর লাগতো নূরুল ইসলামের কাছে।
দাদী পান খেতেন। সে কারণে তার চারপাশ ঘিরে আলাদা একটা ঘ্রাণ ভুরভুর করতো। আজও ভাবলেই সেই ঘ্রাণ নূরুল ইসলাম অনুভব করতে পারেন। গরমের সময় দাদী হাত পাখার বাতাস করতেন। সারা গায়ে হাত বুলিয়ে দিতেন। কতোই না কোমল ছিলো সেই হাত! শীতের সময় খেয়াল রাখতেন লেপের ভেতরে যেনো কোনোরূপ ঠাÐা ঢুকতে না পারে। তাতে যে তার আদরের নাতি কষ্ট পাবে! ভোরে ঘুম ভাঙলে দাদীকে পাশে জায়নামাজে দেখা যেতো। নূরুল ইসলাম উঠলেই তিনি বলতেন, ‘কি গো ভাই, ঘুম ভাঙি গেলো? নামাজ পড়বা? তাইলে যাও ওজু করি আসো।’ নূরুল ইসলাম ওজু করে এসে নামাজে দাঁড়াতেন। দাদী শিখিয়ে দিতেন কীভাবে নামাজ পড়তে হয়।
এই দাদী যেদিন তাদের সবাইকে ছেড়ে চলে গেলেন, সেদিন অনেক কেঁদেছিলেন তিনি। কেউই তার কান্না সেদিন থামাতে পারেনি। এক সময় নিজেই থেমে গেছেন।
আজও তার চোখজোড়া ছলছল করে উঠলো সেই স্মৃতি মনে করে।
‘আম্মু সুমি? মা-মণি?’ ডাকলেন তিনি।
তার মেয়ে সুমি রুমে প্রবেশ করে বললো, ‘জ্বি আব্বু, কিছু বলবেন?’
‘বড্ড তেষ্টা পেয়েছে। এক গেলাস পানি দাও তো।’ বলে উঠে বসলেন নূরুল ইসলাম।
সুমি পানি নিয়ে এলো । সেই সাথে একটা পিরিচে সেমাই। কেবলমাত্র রান্না করা। এখনও ধোয়া উঠছে।
‘নেন আব্বু,’ বললো সুমি। ‘সেমাইটা খেয়ে নেন।’
নূরুল ইসলাম বললেন, ‘ওটা তো পরের জন্য আম্মু।’
‘পরের কথা পরে হবে। এখন খালি পেটে পানি না খেয়ে আগে এটা খেয়ে নেন।’
খুশি হলেন নূরুল ইসলাম। বললেন, ‘এই না হলে আপনি আমার মা-মণি? সব কিছুতেই কেমন খেয়াল! দাও, সেমাইটা খেয়েই নিই।’
চামচ দিয়ে উঠিয়ে গরম গরম ভাঁপ ওঠা সেমাই খেলেন নূরুল ইসলাম। আজকের দিনের বিশেষ আয়োজনের একটি এই সেমাই।
পানি খেয়ে গেলাসটা টেবিলে রাখতেই সুমি বললো আবার, ‘আব্বুজি!’
‘বলো আম্মু, কিছু বলবে?’
‘হ্যাঁ আব্বুজি। আপনি তো ভাইয়াকে কিছুই বলেন না। আজকের দিনটা খেলতে না গিয়ে ঘরে থাকলে কী হতো? আম্মুকে একটু সাহায্য তো করতে পারতো!’ নালিশের সুর সুমির কণ্ঠে।
নূরুল ইসলাম কিছুক্ষণ মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন। ভেসে ওঠে দাদীর মুখটা। যেনো দাদীর শরীর থেকে পানের গন্ধটা তার নাকে সুরসুরি দিচ্ছে। মুগ্ধ হয়ে গেলেন তিনি। বুকের গভীরে একটা দীর্ঘশ্বাস চাপা দিলেন। তারপর গাল ভরে হেসে বলেন, ‘কী করবো মা-মণি, ওর মতো বয়সে আমিও তো কম দূরন্ত ছিলাম না।’
‘কিন্তু তাই বলে আজকের দিনও?’
‘অবশ্য তা ঠিক, আজকের দিনে ও বাইরে না গেলেও পারতো। আচ্ছা ও ফিরুক, আমি বলে দেবো ভবিষ্যতে যেনো এমন আর না করে। এখন খুশি তো?’
তবুও খুশি হতে পারে না ক্লাশ এইটে পড়া মেয়েটা। আব্বুর মুখের হাসি ক্রমে তার মুখে সঞ্চারিত হয়। ‘আব্বুজি…!’ বলে পিরিচ ও গেলাস নিয়ে বেরিয়ে যায়।
নূরুল ইসলাম আর শুলেন না। মাথাটা কেমন ঝিম হয়ে গেছে। আবার হারিয়ে গেলেন স্মৃতির পাতায়।
অনার্সটা শেষ করতে পারেননি নূরুল ইসলাম। থার্ড ইয়ারে থাকতেই সংসারের হাল ধরতে হয়। ছোটোখাটো ব্যবসা থেকে শুরু করে অনেক কিছু করেছেন তিনি। টিকতে পারেননি কোনোটাতেই। এক সময় ছবি আঁকতেন। সেই ছবি আঁকাকেই পরবর্তীতে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছেন। একটা সাপ্তাহিক পত্রিকায় কাজ করেন তিনি। তবে হাতে এখন আর বেশি ছবি আঁকতে হয় না। ইন্টারনেটের সহজলভ্যতার কারণে সেখান থেকেই অধিকাংশ ছবি নামানো হয়।
বাবা-মা মারা যাবার পরই এই চাকরিটা নেন নূরুল ইসলাম। বাবা-মা চলে যাওয়াতে খুবই অসহায় মনে হয় তার নিজেকে। সারাদিন ঘরের কোণে বসে থাকেন। চঞ্চল চির উচ্ছ¡ল ছেলেটি হয়ে পড়ে ঘরকুণো। কোনোকিছুতে মন বসাতে পারেন না।
খবর পেয়ে ছুটে আসেন হাবিবুল্লাহ, তার ছোটবেলার খেলার সাথী। শহরে থাকেন। চাকরি করেন একটা পত্রিকার বার্তা বিভাগে। বন্ধুকে নিয়ে এলেন শহরে। ঢুকিয়ে দিলেন সাপ্তাহিক পত্রিকাটিতে। থাকতে দিলেন নিজ বাড়িতে। সেই শুরু নূরুল ইসলামের শহুরে জীবনের।
নূরুল ইসলাম এখন আলাদা বাসা ভাড়া করে থাকেন।
বালিশের পাশে রাখা হাত ঘড়িটা উঠিয়ে সময় দেখলেন। অল্প কিছুক্ষণ পরই মাগরিবের আজান দেবে।
মেঝেতে পাইচারি শুরু করলেন নূরুল ইসলাম। আর মনে মনে বলতে লাগলেন, ‘হাবিবুল্লাহ অবশ্যই আসবে। নামাজের আগেই আসবে। প্রতিবারের মতো আজও পাশাপাশি দাঁড়িয়ে নামাজ পড়বেন দু’বন্ধু।’
তিনি ভাবলেন, আজকেই হাবিবুল্লাহকে কথাটা বলবেন। তার অফিসে একটা ব্যবস্থা করে দিতে বলবেন। সাপ্তাহিক পত্রিকাতে দুইদিন কাজ করলেই হয়ে যায়। বাকি দিনগুলো প্রায় ফ্রি থাকতে হয় তাকে। তাছাড়া সংসারে খরচও বেড়েছে। দু’টো অফিসে ভাগাভাগি করে ঠিকই চালিয়ে নিতে পারবেন তিনি। আজকাল তো অনেকেই এটা করে।
‘ক্রিং… ক্রিং…’ দরোজার কলিংবেল বেজে উঠলো।
পাইচারি থামিয়ে দিলেন নূরুল ইসলাম। হাবিবুল্লাহ এসে গেছে। হঠাৎ বুকের কোণায় কেমন যেনো একটা “খচ্” করে উঠলো। চমকে উঠলেন তিনি। ভাবলেন, তাই তো! এটা তো তিনি আগে কখনও ভাবেননি। জীবনটা তো এমনই। প্রতিনিয়ত কড়া নেড়ে যাচ্ছে সে, জানিয়ে দিয়ে যাচ্ছে সময়ের হিসেব। মানুষের বয়স বাড়ছে মানে তার আয়ু থেকে সময় মাইনাস হচ্ছে। ঠিক যেনো কলিংবেলের মতো! ‘ক্রিং ক্রিং’ করে জানান দিচ্ছে জীবন ফুরিয়ে যাবার। আজ কতোতম জš§দিন যেনো তার? নাহ্, কিছুতেই মনে করতে পারছেন না তিনি।
দৃষ্টিটা কেমন ঝাঁপসা হয়ে এলো নূরুল ইসলামের।
