শামীমা বেগম
পৃথিবীর প্রতিটি স্তব্ধতা একেকটি চিৎকারের রূপ। কিছু চিৎকার উচ্চারিত হয় শব্দে, কিছু নিঃশব্দে। রাহেলার জীবনের গল্প সেই নিঃশব্দ চিৎকারের সুর—যা আকাশ ভেদ করে না, তবে আত্মাকে ক্ষতবিক্ষত করে।
রাহেলার বয়স তখন ষোলো। স্কুলের বারান্দায় দাঁড়িয়ে সে আকাশের দিকে তাকিয়ে স্বপ্ন বুনতো—একদিন সে শিক্ষিকা হবে, ছাত্রীদের স্বপ্ন দেখাবে, মাটির মতো কোমল আর দীপ্তির মতো শক্ত হয়ে সমাজের চোখে চোখ রাখবে।
কিন্তু হঠাৎ করেই তার সেই স্বপ্নে ঝড় নামে। এক সন্ধ্যায় তার বাবা তাকে জানালেন, সে এক ব্যবসায়ীর ঘরণী হতে চলেছে। কথাটি ছিল খুব শান্ত, কিন্তু রাহেলার ভেতরে যেন বাজ পড়ল। সে কিছু বলেনি, চোখ মেলে তাকিয়েছিল বাবার মুখে—সেই মুখে ছিল সমাজ নামক শেকলের নির্ভেজাল ছাপ।
রশিদ, তার স্বামী, ছিল গোঁড়ামির প্রতিমূর্তি। প্রথম দিনেই তাকে বলেছিল—”এই ঘর তোর পৃথিবী। বাইরে যাওয়া মানা, বেশি কথা বলা মানা, প্রতিবাদ করা মানা।”
প্রতিদিন যেন এক নতুন বন্দিত্ব। কখনো সন্দেহের বিষ, কখনো হঠাৎ করেই উড়ে আসা চড়-থাপ্পড়, কখনো অকারণ অপমান।
রাহেলা বোবা হয়ে উঠেছিল। যে কণ্ঠে স্বপ্নের কবিতা ছিল, সে কণ্ঠ হয়ে গেল নির্বাক। আত্মীয়রা বলত, “সব মেয়েই তো এমন করে, তুইই বা আলাদা কী?”
কিন্তু এক রাতেই তার বোবাকণ্ঠের রক্তমাখা ইতিহাস রচিত হয়।
গর্ভে চার মাসের সন্তান নিয়ে মারধরের শিকার হয়ে সে যখন মেঝেতে লুটিয়ে পড়ে, তখন ঘরের বাতাসও যেন তাকে দেখে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল। তার রক্ত মিশে গিয়েছিল বিছানায়, কিন্তু সে সেদিন মরেনি—সে সেদিন জন্ম নিয়েছিল এক নতুন রাহেলা হয়ে।
তিন বছর সে সহ্য করে। ভিতরে ভিতরে লিখে রাখে একখানা ডায়েরিতে প্রতিটি অত্যাচারের বিবরণ, প্রতিটি দিনের অভিশাপ, আর নিজের প্রতিজ্ঞা—”আমি একদিন চুপ থাকবো না।”
এক সকালে সে কোলে সন্তান নিয়ে হাজির হয় শহরের এক নারী অধিকার সংগঠনে। মুখে কোনো কান্না নেই, চোখে কোনো অসহায়ত্ব নেই—শুধু একটি নিঃশব্দ আগুন।
মানুষ অবাক হয়। আত্মীয়স্বজন মুখ ঘুরিয়ে নেয়। সমাজ তাকে বলে “চরিত্রহীন, স্বামীবিরোধী!”
কিন্তু রাহেলা জানে, সমাজের এই মুখগুলোই একদিন তার নিঃশব্দ চিৎকারের প্রতিধ্বনি শুনবে।
মামলা করে সে। তার ডায়েরি হয়ে ওঠে সাক্ষী, হাসপাতালের রিপোর্ট হয়ে ওঠে সমর্থন, প্রতিবেশীদের চাপা কান্না হয়ে ওঠে দলিল।
বছর দুয়েকের মধ্যেই রশিদ শাস্তি পায়। সংবাদপত্রে হেডলাইন হয়—”এক নারীর সাহসে মুখ থুবড়ে পড়ল নির্যাতন।”
আজ রাহেলা এক নারী সংগঠনের প্রধান। প্রতিদিন অসংখ্য নারী তার কাছে আসে। কেউ মুখ ঢাকে ওড়নায়, কেউ চোখ লুকায় কান্নায়।
রাহেলা তখন শান্ত গলায় বলে—
“তোমার চোখের জল কোনো দুর্বলতা নয়, বরং তা প্রতিরোধের অস্ত্র। ভেঙে পড়ো না, জেগে উঠো।”
