অবিক্রীত বিকৃতি

0
83

ওয়ালিদ জুমলাত 

অনেকদিন পর নদীর পাড়ে এসেছে রামীম। বাতাসে চুল উড়ছে। আমরা দুজনই উদাস দৃষ্টিতে পানির স্রোত দেখছি। একটু পর “শীতের বাতাসে” গানটা গাইবো।

আমি সম্ভবত ওর একমাত্র বন্ধু। অপ্রকাশ্যতার প্রাবল্যে ভুগতে থাকা একজন রম্য লেখক সে। স্কুল লাইফ থেকেই পত্রিকায় তার লেখা ছাপা হতো। কখনও কৌতুক,কখনও বা ছোটগল্প। পরিচিত মহলে “গুরু” বলে ডাকা হতো তাকে। পাড়ার আড্ডায় ওর কৌতুকগুলো সবার হাসির খোরাক হতো। ছোট-বড় সবার কাছে ভালো একটা গ্রহনযোগ্যতা পেয়েছিল সে শুরু থেকেই। কলমের খোঁচায় সাদা পৃষ্ঠার জগতে খাঁটি বিনোদন এবং সাবলীল হাসির উৎস হিসেবে থাকলেও সামনাসামনি সে খুবই কম মিশুক,স্বল্পভাষী। সাদাসিধা গোবেচারা বলেই জানতো সবাই।

মুদ্রার ওপিঠ টা আমার জানা।
সবসময় দুয়েকটা বোতাম এর অপূর্ণতায় থাকা হাফশার্ট পরাকালীন বাচ্চাকাল থেকে তাকে আমি চিনি। যেভাবে চিনি দারিদ্র্য,চিনি অন্তঃসারশূন্যতা। ট্রাক থেকে টিসিবি-র পণ্য কেনার মতো চরম অনাগ্রহের বিস্বাদ আনন্দ নিয়ে বেড়ে উঠতে গিয়ে আমাদের বাকি পার্থিব উদযাপন এর উপলক্ষ্য সহজেই ফিকে হয়ে গিয়েছিলো। বুঝি এ কারণেই আশেপাশের ধূসর দুঃখের সূক্ষ্মতা চোখে পড়তো প্রগাঢ় হয়ে।
ঠোঁটের ওপর শুল্ক আরোপিত থাকায় সেসব দুঃখ আর অনিয়ম-অনাচার রয়ে যেতো অনুচ্চারিত। তাই রাজনীতি বিষয়ক লেখাগুলোর একমাত্র পাঠক এবং সমালোচক হিসেবে নিজেদের মধ্যে কথা বলেই ভালো সময় কাটাতাম।

সব ঠিকঠাক চলছিলো। কিন্তু কলেজের ত্রৈমাসিক ম্যাগাজিনে কৌতুক আর রাজনীতির মিশেলে তার একটা গল্প প্রকাশিত হওয়ায় বাঁধে বিপত্তি। ইতিহাস,দর্শন,নৈতিকতা ইত্যাদির সাথে কিছু দুরন্ত আক্কেল গুড়ুম ধরনের কথামৃত যোগ করে রাজনীতির মতো কাঠখোট্টা আলোচনাকে রসালো রূপ দেওয়া হয়েছিল গল্পতে। সেখানে ছিল দেশের প্রতি আকুলতা,মানুষের জন্য ভাবনা,সত্যের জন্য চিৎকার আর ভ্রান্তির সমালোচনা। চুপচাপ একটা ছেলে,নিজের গন্ডির বাইরে যে কারোর সাথে সাধারণ আলাপ করতেও দ্বিধায় থাকে,চরম দুরাবস্থার মধ্যেও কাড়ি কাড়ি মিথ্যা শব্দ সাজিয়ে কল্পনায় সুখে থাকা যার কাজ,সে হঠাৎ করে কিছু মানুষের জন্য অনুপ্রেরণা আর কিছু মানুষের চোখে বিষ হয়ে গেলো।
এরপর কয়েকমাসের মধ্যে একইসাথে ওর জীবনে আসলো ভয়,উদ্দীপনা,অনাস্থা,প্রতিবাদ,বিচ্ছেদ – সবকিছুর সমন্বয়ে একটা ঝড়।

কলেজের বিভীষিকা বলে পরিচিত কয়েকজন ছাত্রনেতা এসে ওকে শাসিয়ে গেলো, ম্যাগাজিন টা বাজেয়াপ্ত করা হলো শুধু একটা লেখার কারণেই। এমনকি প্রিন্সিপাল তাকে ডেকে বললো, “লোক হাসানোর কথা বানিয়ে দু’কলম বাণী উগড়াও শুনলাম। ওসবই লিখো,গভীরে ভাবতে যেও না। পাস করে তো বের হওয়া লাগবে,না কি?”
প্রিন্সিপাল এর কক্ষের দরজার ওপরে বড় হরফে “জ্ঞানের জন্য এসো,সেবার ব্রতে বেরিয়ে পড়ো” লেখাটাকে কোনো চিড়িয়াখানার চকমকে সাইনবোর্ড এর সাথে তুলনা দেওয়া যায়। তারচেয়ে বরং “এখানে বিবেক জলাঞ্জলি দেওয়া হয়” লিখলে মানাতো।
পা-চাটা ওই নেতাদের একজন আবার এলাকার প্রভাবশালী ছোটন ভাইয়ের কাছের লোক,তার সাথে নাকি মিনিস্টারের যোগাযোগ আছে। সব দুষ্ট লোকেরই হয়তো একটা অভ্যন্তরীণ সিম্ফনি থাকে। রামীম এর মনে আছে,গতবছর ভোট দিতে গিয়ে সে দেখেছিলো তার ভোট ইতোমধ্যে দেওয়া। তাকে বলা হয়েছিল সে যেন অন্য একজনের ভোট দিয়ে দেয়,ভোট দিতে পারলেই তো হলো। সেদিন রামীম হাতে থাকা ভোটার স্লিপটা ছিঁড়েছুঁড়ে ফেলে চলে আসা ছাড়া কিছু করতে পারে নি।
এবার লেখায় কী ভুল আছে তা জানতে চেয়ে কলেজে সবার সামনে ওকে হেনস্তার শিকার হতে হলো,মার খেতে হলো। কয়েকজন ওর পক্ষ হয়ে কথা বলায় ‘দেখে নেওয়ার’ হুমকি শুনে বাড়ি ফিরলো।
আর ক্লাসের একটা মেয়ে অঝোরে কিছুক্ষণ কাঁদলো।
মেয়েটার নাম শিউলি,রামীম এর প্রেম।

ঘটনার জটিলতা দীর্ঘায়িত হলো যখন সচেতন ছাত্রদের মধ্যে কেউ একজন রামীম এর লেখাটা ফেইসবুকে পোস্ট করলো। যেহেতু বেশ কিছুদিন ধরে বিষয়টা আলোচনায়, এবং রামীমকে মোটামুটি অনেকেই চেনে,তাই পোস্ট টা ছড়িয়ে গেলো মুহূর্তেই। এবার তার ওপর আঘাত আসলো সরাসরি বাড়িতে। ছোটন গ্যাং এর সদস্যরা এসে ছোট্ট বেড়ার ঘরটা ভেঙে দিলো। মিনি নামে একটা ছাগল ছিল,সেটা নিয়ে গেলো। অনলাইন থেকে চাইলেই সে হুট করে গল্পটা সরাতে পারছে না, বা এতে তার হাত নেই- এটা বারবার বলাতেও তাদের উগ্রতা কমার কোনো সম্ভাবনা না দেখে অবশেষে বাবা-মায়ের মুখ চেয়ে রামীম সিদ্ধান্ত নিলো তার লেখা সব পুড়িয়ে ফেলবে। নিজের কারণে সাদা সহজ পরিবারে কোনো ঝঞ্জাট আনতে সে নারাজ,ক্ষতি যা হয়েছে তা তো হয়ে গেলোই।

তৃতীয় পর্যায়ের জঘন্যরকম পরিস্থিতি আসে কলেজ পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের পর। টেস্ট পরীক্ষায় রামীম ফেইল করেছে। এতে খুব বেশি অবাক না হলেও পরের ঘটনা টা রামীম এর কাছে আকাশ থেকে পড়ার মতো। শিউলি,রম্য পড়ে যে সবার আগে হাসতো,যে কখনও রম্যের চরিত্র হতে চায় নি,যে ভালোবেসেছিল,যে মেয়েটা কেঁদেছিল কলেজ মাঠে বসে,যে কান্না আমি ছাড়া কেউ দেখে নি,রামীম ও না,সেই শিউলির বিয়ে হয়ে গেলো। বিয়ে হয়ে গেলো কলেজ প্রিন্সিপালের এক প্রিয়পাত্রের সাথে,যে সরব ছিল রামীম এর বিরূদ্ধে।

আমার সবচেয়ে কাছের দুজন মানুষের দুইজোড়া স্নিগ্ধ চোখ ছিল। রামীমের চোখ যেন শুষ্ক মরুভূমি। কাঁদবার অবকাশ নেই। মরিচীকার ছটা এই আসে,এই যায়। আর শিউলির নীলকান্তমণি বুঝি নায়াগ্রা হয়ে গেছে সারাজীবন জন্য।

আমি বুঝতে পারছিলাম,রামীম নিজের কাছে হেরে যাচ্ছে। সামগ্রিক পরিস্থিতির দোলাচালে সে তখন স্বভাববিরুদ্ধ,ক্ষুব্ধ,বিভ্রান্ত। হতবিহ্বল হয়ে থাকার সর্বশেষ ধাপটা নিমিষেই কেটে যায় যখন একদিন সকালে তার বাবার মুদি দোকানটা দাউদাউ করে জ্বলতে দেখে।
কারা কেন এটা করেছে সব জেনেও যেন কিছু করার নেই,এটা মেনে নেওয়া অসম্ভব।

ক্ষুধা আর আত্মসম্মান বড় ভয়ানক বিষয়। প্রকৃতির আদিম খেয়ালে একটা ব্যাঙ কোনো সাপকে তার খাবার হিসেবে সাব্যস্ত করতে পারে। বাস্তুতন্ত্রের মতো গোছানো একটা সিস্টেমও কদাচিৎ ভেঙে যায়,ভুল প্রমাণ হয়। মুরগির দলও বুঝি ক্রমবিলুপ্তির ধাক্কায় জর্জরিত হয়ে শেয়ালের বিরূদ্ধে আওয়াজ তোলে উচ্চৈস্বরে!

এক মাসের ব্যবধান মাত্র,চুপচাপ কলেজ পড়ুয়া সাধারণ ছাত্র রামীম এখন শক্তিশালী একটা গোষ্ঠীর শত্রু। হঠাৎ সে সিদ্ধান্ত নিলো তার সব লেখা প্রকাশ করবে। শত্রুতা যেহেতু একপাক্ষিক রাখা অনুচিত,এবং ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা সবসময়ই আছে,তাই খেলাটা সমানে সমান হওয়া চাই।

লিখুন প্রতিধ্বনিতেলিখুন প্রতিধ্বনিতে

রামীম এর সাইকোলজিকাল অবস্থা এতোটাই বিষম গতির হয়ে উঠেছিল যে,জাগতিক স্থবিরতা,অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ কিংবা ধ্বংসাত্মক সত্তায় তার ভয় ছিল না। ওর কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠলো শত্রুদের রূপ। টিসিবি-র পণ্য আনতে গিয়ে ওর মায়ের বেহাল দশার কথা নতুন করে মাথাচাড়া দিলো,বাবার দোকানে চাঁদাবাজদের দৌরাত্ম্য মনে পড়লো,সহায়তার নামে এলাকার নেতৃস্থানীয়দের প্রহসনের কথা ওর মস্তিষ্কে ঝড় এনে দিলো। তার অপ্রকাশিত সব রাজনৈতিক লেখা ডায়েরির পাতা ভেদ করে ফুটে উঠতে লাগলো সচেতন মহলের ফেইসবুক ওয়ালে। বেশ কয়েকটা প্রথিতযশা পত্রিকা ও প্রকাশ করলো তার মুখরোচক কিছু লেখা। এরই মধ্যে দেশে শুরু হয় ছাত্র আন্দোলন,যা রামীম এর মাথার আগুনে নতুন করে ঘি ঢালার মতো ভূমিকা পালন করেছিল।

আমি চোখের সামনে দেখতে লাগলাম নীরব-নিবিড় একজন রামীম এর ক্ষিপ্ত তেজোদ্দীপ্ত পদক্ষেপ। কণ্ঠে শুনতে পেলাম Bullet or Equality এর স্পষ্ট উচ্চারণ,যা অনুরণনিত হয়েছে শত শত কণ্ঠে। ওর লেখায় ভাসতে লাগলো অপমানিতের প্রতি শক্তিশালী প্রতিশ্রুতির আশা…

একদিন সবার আশা সত্যি হলো। রক্ত-ঘাম একাকার করে রাজপথে বিলীন হতে আসা মানুষের প্রার্থনা বিফলে যায়নি। অনেকগুলো প্রাণ ঝরে গেছে। বলিদান হয়েছে শিশুর নিষ্পাপ চাহনি,মায়ের সারল্য,বোনের কোমল আলিঙ্গন,প্রেমিকের চোখের ভাষা।
তবে সবাই একটা স্বস্তির প্রশ্বাস পেলো। অযুত-নিযুত রামীম এর জন্ম দিলো দেশ। যারা শিখেছে যুদ্ধের কৌশল,জেনেছে বিসর্জনের পুণ্য,বুঝেছে নিজের মধ্যে থাকা সুপ্ত আমিত্ববোধের শক্তি।

রামীম আজ প্রায় দেড়মাস পর বাসা থেকে বের হলো। গুলি খাওয়া পা টা পুরো সারতে আরও অনেক সময় লাগবে বলে ডাক্তার জানিয়েছে। আমার খুব ভালো লাগছে ওকে নদীর পাড়ে নিয়ে এসে। প্রিয় চাদরটা গায়ে জড়িয়ে এসেছে সে। আশেপাশের মানুষের জীবন কাটছে আশা-নিরাশার দোটানায়। আরও অনেক অস্পষ্ট যুদ্ধ জয় করা বাকি। জীবনের আকস্মিকতায় হকচকিয়ে যাওয়া প্রাণ এখন যেন মৃত্যু অমিয় পানে দুবার ভাববে না।
প্রাপ্তি অপ্রাপ্তির হিসেব বড় গোলমেলে। এসব ভাবতে ভাবতে আনমনে গাইতে শুরু করলাম,”শোনো কবি,তোমার দুর্গত মনে ত্রাণের নৌকা আর যাবে না কখনও।”

ঝরা শিউলি কুড়িয়ে নিয়ে একটা পাথরের ওপর বসলাম। রামীম এর গলাটা কেমন যেন ধরা।
বাতাসে চুল উড়ছে। __

Previous articleদৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য
Next articleনুপুর
প্রতিধ্বনি
প্রতিধ্বনি একটি অনলাইন ম্যাগাজিন। শিল্প,সাহিত্য,রাজনীতি,অর্থনীতি,ইতিহাস ঐতিহ্য সহ নানা বিষয়ে বিভিন্ন প্রজন্ম কী ভাবছে তা এখানে প্রকাশ করা হয়। নবীন প্রবীণ লেখকদের কাছে প্রতিধ্বনি একটি দারুণ প্ল্যাটফর্ম রুপে আবির্ভূত হয়েছে। সব বয়সী লেখক ও পাঠকদের জন্য নানা ভাবে প্রতিধ্বনি প্রতিনিয়ত কাজ করে চলেছে। অনেক প্রতিভাবান লেখক আড়ালেই থেকে যায় তাদের লেখা প্রকাশের প্ল্যাটফর্মের অভাবে। আমরা সেই সব প্রতিভাবান লেখকদের লেখা সবার সামনে তুলে ধরতে চাই। আমরা চাই ন্যায়সঙ্গত প্রতিটি বিষয় দ্বিধাহীনচিত্ত্বে তুলে ধরতে। আপনিও যদি একজন সাহসী কলম সৈনিক হয়ে থাকেন তবে আপনাকে স্বাগতম। প্রতিধ্বনিতে যুক্ত হয়ে আওয়াজ তুলুন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here