back to top
Google search engine

গুটি আমের ঢিল

শেখ আবদুল্লাহ্ নূর

বোশেখের ভর দুপুর। বাড়ির পেছনের আম বাগানে দাঁড়িয়ে আছে শিউলি। সামনে অবারিত মাঠ। ধান ক্ষেত। বাতাসে ঢেউ বয়ে যায়, যেন অসীম সাগর। শিউলি ধানের ক্ষেতে বাতাসের খেলা দেখছিল। এমন সময় তার কানে ভেসে আসে ঘু- ঘুঘুঘু – – ঘু- ঘু- ঘু। তাদের বাড়ির উত্তর পাশের বাঁশঝাড়ের চূড়ায় বসে আছে পাখিটি। ডাকছে ঘু- ঘুঘুঘু – – ঘু- ঘু- ঘু। বড় মনকাড়া সুর। বড় অভিমানী, করুন, বিষদময়। ঘুঘুপাখির সুরেলা শব্দে ঝিম ধরে আছে দুপুর। ঝিম ধরে আছে শিউলিদের সারা গাঁও।
নীরব নিস্তব্দ গ্রামটি যেন রোদের পরাগ মেখে ধ্যান করছে। বৃক্ষ তরুলতা এই পাখিটির করুণ সুরের মোহে যেন হারিয়ে গেছে। রোদের স্রোতে বয়ে যাচ্ছে করুণ সুরের মোহনীয় বাণী। শিউলি ভাবছে, এতো অভিমানী সুর পাখিটির। ঘু- ঘুঘুঘু – – ঘু- ঘু- ঘু। পাখিটি এমন করুন সুরে ডাকে কেন? নিঝুম দুপুরে কারে বলছে সে- ঘুমাইও না, জেগে ওঠো। অল্পক্ষণ পরেই গোধূলী নামবে। ঝিমিয়ে যাবে রোদ। গোটা গাঁয়ে নেমে আসবে নরম ছায়া, গোধূলির ইন্দ্রজাল। ওঠো গো, ওঠো। তপ্ত দুপুর শেষ হতে চললো। ঘু- ঘুঘুঘু – – ঘু- ঘু- ঘু। ঘুম থেকে ওঠো।
শিউলি ভাবছে, আসলেই কি ঘুঘুপাখিটি এসব বলছে? নাকি এটা ওর নিছক কল্পনা। ঘুঘুপাখির ভাষা যদি বুঝা যেতো! পাখি এমন মনকাড়া সুরে কী কথা কয়?
বারো বছরের মেয়ে শিউলি। তাদের বাড়ির পেছনে আমবাগান। বাগানের পরেই অবারিত মাঠ। মাঠের পরে আরেক গ্রাম। বহু দূর সেই গ্রাম। ছোট ছোট ধানের চারায় ভরা মাঠ পেরিয়ে সেই গ্রামে যেতে হয়। বোশেখ মাসের প্রথম সপ্তাহে মাঠে ধানের গাছগুলো ছোট ছোট। বাতাসের সাথে দোল খাচ্ছে চারাগুলো। সামনের জ্যৈাষ্ঠ মাসে ধানের চারাগুলো আরো বড় হবে। তখন বয়ে যাওয়া হাওয়া আরো বড় বড় ঢেউ তুলবে। কী অপরূপ সুন্দর তার গ্রামখানি। কী মিষ্টি রোদ, মিষ্টি বাতাস, মিষ্টি ধানক্ষেত, মাঠ।
শিউলি শুনছে ঘুঘুপাখির ডাক। সুর তো নয়, যেন কান্নাঝরা বেদনার বাণী। হাওয়ায় হাওয়ায় ভেসে ভেসে মাঠ পেরিয়ে করুণ সুর ভেসে ভেসে দূরের ওই গাঁয়ে চলে যাচ্ছে। শিউলি মাঠের দিকে চেয়ে দেখছে, এখানে সেখানে দুই একজন কৃষক কাজ করছে। কেউ ধান নিড়াচ্ছে, কেউবা ক্ষেতে গরু দিয়ে নাইংলা দিচ্ছে। কেউ আবার শুধু শুধু হেঁটে বেড়াচ্ছে ক্ষেতে। কচি ধানের চারার ছোঁয়া নিচ্ছে পায়ে। নিজের জমির ধানের চারাগুলো পা ছুঁয়ে বেঁচে থাকার কথা বলছে, মায়ার কথা বলছে। তাই, এমন ভর দুপুরেও রোদের তাউ কৃষকদের গায়ে লাগে না। বরং সোহাগ ছড়িয়ে দেয় শরীরে।

লিখুন প্রতিধ্বনিতেলিখুন প্রতিধ্বনিতে


শিউলির কাছে মনে হয় ওরা কৃষক না। ওরা আমাদের দেশের পতাকা, লাল সবুজের পতাকা। রোদের ঝলসায় পত্ পত্ করে ওড়ছে। কৃষকদের দেখলে শিউলির বাবার কথা মনে পড়ে। ওর বাবাও কৃষক ছিল। ওদের বাড়ির উঠোনের পাশেই তার কবর। বাবার স্মৃতি ওকে এখনো কাঁদায়। মাঠে কৃষকদের দেখে ওর বাবার স্মৃতি আর বাঁশঝাড়ে বসা ঘুঘু পাখির করুন সুর শিউলির মনকে আরো বিষন্ন করে তুলে। কতো করুন এই পৃথিবী, অথচ কতো সুন্দর, কতো মধুর! এখানে দুপুরের রোদ চোখের কোনে খোয়াব ছড়ায়। মাটির গন্ধ স্বপ্ন বুনে দেয় বুকে।
শিউলির পৃথিবীটা এখনো ছোট। ওর পৃথিবীতে আছে শুধু ওর মা। আর আছে এই বাড়িটি, এই ঘাস, এই উঠোন, এই আমগাছ। আরো আছে বাড়ির অপর পাশের ওই শিমূল তলা, আছে স্কুল ও সহপাঠীরা। ওর পৃথিবীতে আছে পাখি, একটি দুইটি অথবা অসংখ্য পাখি। আছে বাড়ির পাশের ছোট্ট নদী, নদীর পাড়, ধানক্ষেত আর এই আম বাগানের কচি সবুজ গুটিআম।
গাছের আমগুলো এখনো পাকেনি। কাঁচা আম কী যে টক, কী যে মিষ্টি, কী যে মজার। বাতাস ঝিম ধরে আছে। একেবারে চুপ। একটি দুটি ঝাপটা এলেই গাছ থেকে কাঁচা গুটিআম পড়বে। আর যদি বাউকুড়ানী আসে! তাহলে টপ টপ করে অনেকগুলো পড়বে কাঁচা আম। এই লোভেই আমতলায় আসা শিউলির।
ওদের বাড়ির উত্তর-পশ্চিম কোণে বড় একটি শিমূল গাছ। আমতলায় দাঁড়িয়ে গাছটি দেখা যায়। ওর মনে পড়ে ফাগুন মাসের কথা। ফাগুনে লাল ফুলে ভরে যায় গাছটি। দেখলে মনে হয় আগুন লেগেছে গাছে। ফাগুনের সেই লালফুল এখন আর নেই। এখন আছে ডালে ডালে শিমূল তুলার গুটি। কোন কোনটি পেকে ফেঁটে গেছে। প্রজাপতির মতো বাতাসে ওড়ছে শিমূল তুলার আঁশ।
এসব ছবি মনে দোলা দিতেই শিউলির চোখ চলে যায় শিমূল গাছটির দিকে। হঠাৎ কেঁপে উঠে ওর বুক। চমকে উঠে মন। সেই আধ-বয়সী লোকটি! খালি গাও। লুঙ্গি মালকোঁচা করে পরা। গামছা পেঁচিয়ে মাথায় পাগড়ির মতো করে বাঁধা। শিকারী! ঘুঘুপাখির শিকারী সে!
লোকটির আছে একটি পোষা ঘুঘু। খাঁচার ভিতরে পোষা ঘুঘুপাখিটি নিয়ে সে পথে প্রান্তরে ঘুরে বেড়ায়। ঘুঘু শিকার করে। পোষা পাখিটির খাঁচার চারপাশে জাল বুনিয়ে ফাঁদ বানিয়ে রাখা হয়েছে। ফাঁদসহ খাঁচাটিকে সে পেতে রাখে গাছের উঁচু ডালে। তারপর দূরে আড়ালে গিয়ে লুকিয়ে থাকে সে। লুকানো অবস্থায় মাঝে মাঝে দুই হাত মুঠো করে সে মুখের কাছে নিয়ে ঘুঘুপাখির ডাক অনুকরণ করে। ঘুঘু – ঘু, ঘুঘু – – ঘু। এই কৃত্রিম ডাক শুনে তার পোষা ঘুঘুটিও ডাক দেয়। এদিকে পোষা ঘুঘুর ডাক শুনে বনের ঘুঘুও ডেকে ওঠে। এভাবে চলে কিছুক্ষণ দুই পাখির ডাকাডাকি।
এক সময় বনের ঘুঘুটি পাখায় পত্ পত্ শব্দ তুলে উড়ে যায় আকাশের উঁচুতে, অনেক ওপরে। তারপর ডিগবাজি খাওয়ার মতো করে নেমে আসে নিচে। সেই পোষা ঘুঘুপাখির খাচার কাছে। খাঁচার চার পাশে বুনন জালের ফাঁদ পেতে রাখা। বনের ঘুঘুটি সেসব কিছুই বুঝে না। সে কিছুক্ষণ খাঁচার চার পাশে ঘুর ঘুর করে ঘুরে বেড়ায়। খাঁচার ভেতরের ঘুঘুটিকে ঠোকর দিতে যায়। এভাবে চলতে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর কোনো এক মুহুর্তে বনের ঘুঘুটি আটকা পড়ে যায় বুনন জালের ফাঁদে। আর তখনি ছুটে আসে শিকারী। গাছের উঁচু ডাল থেকে ফাঁদে পড়া বনের ঘুঘুসহ নামিয়ে আনে সে পোষা ঘুঘুর খাঁচা। ধরে ফেলে সেই বনের ঘুঘুকে। এভাবেই বনে-জঙ্গলে ঘুঘু শিকার করে বেড়ায় ওই শিকারী। আজ সে আমাদের বাড়ি এসেছে ঘুঘুপাখি শিকার করতে!
এই শিকারীকে দেখলেই শিউলির অস্থিরতা বেড়ে যায়। ওর মনে হয়, আরেকটি ঘুঘুপাখি বুঝি হারিয়ে যেতে বসেছে তাদের গ্রাম থেকে।
এসব কথা যখন ভাবছিল শিউলি, বাঁশ ঝাড়ের আগায় বসে ডাকতে থাকা বনের ঘুঘুটি পাখায় পত্ পত্ শব্দ করে উড়ে যায় আকাশে। তারপর শিউলি দেখতে পায় ঘুঘুটি ডিগবাজি খাওয়ার মতো ভঙ্গি করে নেমে আসে সেই গাছটির শাখায়, যেখানে শিকারী তার পোষা ঘুঘুটির চারপাশে ফাঁদ পেতে রেখেছে। শিউলির বুঝতে আর কষ্ট হয় না, খাঁচার পোষা ঘুঘুটির ডাক শুনেই বাঁশঝাড়ের ঘুঘুটি উড়ে চলে এসেছে খাঁচাটির কাছে। ওইতো দূর থেকেই দেখতে পাচ্ছে শিউলি। বনের ঘুঘুটি এসে খাঁচার চারপাশে ঘুর ঘুর করছে! যে কোন মুহুর্তে ফাঁদে পড়ে যাবে সে! কী করা যায়? কী করা যায়? অস্থিরতা বেড়ে যায় শিউলির মনে। বনের ঘুঘুকে তো বাঁচাতে হবে।
সহসাই বাতাসের ঝাপটা এসে লাগে আমগাছে। সেই ঝাপটায় একটি কাঁচা আম টুপ করে ঝরে পড়ে তলায়। শিউলি দৌড়ে গিয়ে তুলে নেয় আমটি। অবশ্য দৌড় না দিলেও পারতো সে। আম তলায় আর কেউ নেই। প্রতিযোগী না থাকলে আম কুড়োতে কেউ দৌড় দেয়? অথচ দৌড়িয়ে আম কুড়ানো বুঝি শিশু কিশোরদের অভ্যাস। এতে অন্য রকমের আনন্দ, অন্য রকমের মজা। শিউলিকে অবশ্য এই মুহুর্তে তার মনের অস্থিরতা তাকে দৌড় দিতে বাধ্য করেছে। সে দৌড়িয়ে আমটি কুড়িয়ে নেয়।
শিউলি আমটি হাতে নেয়ার সাথে সাথে তার মনে বিদ্যুৎ খেলে যায়। বনের ঘুঘুপাখিকে বাঁচাতে হবে। আমটি সে তক্ষনি ছুড়ে মারে ওই শিমূল গাছটির দিকে্, যেখানে বনের ঘুঘুর জন্য খাঁচায় ফাঁদ পাতা রয়েছে। শিউলি তখন ভুলেই গেছে, এতো স্বাদের কাঁচা আমটি তার হাত ছাড়া হয়ে যাচ্ছে। শিউলির মনে তখন একটাই চিন্তা, যে করেই হোক, বনের ঘুঘুকে বাঁচাতে হবে। তাড়িয়ে দিতে হবে ঘুঘুপাখিটিকে। তা না হলে এক্ষনি শিকারীর হাতে ধরা পড়বে পাখিটি।
শিউলির ছুড়ে মারা গুটি আমের ঢিলটি গিয়ে পড়ে এক্কেবারে শিকারীর পেতে রাখা খাঁচার ওপরে। ছাঁট্ করে একটি শব্দ হয়। অর্থাৎ পড়ে যায় ফাঁদের জালটি। আর সেই শব্দে বনের ঘুঘুটি চমক খেয়ে ওড়ে চলে যায় দূরে, অন্য কোথাও, অন্য কোনো গাঁয়।
শিকারী ছুটে আসে খাঁচার কাছে। সে কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না, কী হলো! ফাঁদ পড়ে গেল, অথচ পাখিটি ধরা পড়ল না! কেন এমনটি হলো?
শিউলিও তখন ছুটে আসে শিকারীর কাছে। বলে, আমিই তাড়িয়ে দিয়েছি পাখিটিকে। আমার গায়ের পাখি মারতে দেবো না আমি। তুমি চলে যাও। না হলে আমি আমার স্কুলের স্যারকে ডাকবো। তাকে বলে দেব তোমার পাখি শিকারের এমন নিষ্ঠুর কাহিনি।
শিকারী লোকটি কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু শিউলির এমন রাগত অগ্নি চেহারা দেখে সে ভয় পেয়ে যায়। চুপি চুপি তার পোষা ঘুঘুটি নিয়ে চলে যায় সে শিমুল গাছের তলা থেকে।

প্রতিধ্বনি
প্রতিধ্বনিhttps://protiddhonii.com
প্রতিধ্বনি একটি অনলাইন ম্যাগাজিন। শিল্প,সাহিত্য,রাজনীতি,অর্থনীতি,ইতিহাস ঐতিহ্য সহ নানা বিষয়ে বিভিন্ন প্রজন্ম কী ভাবছে তা এখানে প্রকাশ করা হয়। নবীন প্রবীণ লেখকদের কাছে প্রতিধ্বনি একটি দারুণ প্ল্যাটফর্ম রুপে আবির্ভূত হয়েছে। সব বয়সী লেখক ও পাঠকদের জন্য নানা ভাবে প্রতিধ্বনি প্রতিনিয়ত কাজ করে চলেছে। অনেক প্রতিভাবান লেখক আড়ালেই থেকে যায় তাদের লেখা প্রকাশের প্ল্যাটফর্মের অভাবে। আমরা সেই সব প্রতিভাবান লেখকদের লেখা সবার সামনে তুলে ধরতে চাই। আমরা চাই ন্যায়সঙ্গত প্রতিটি বিষয় দ্বিধাহীনচিত্ত্বে তুলে ধরতে। আপনিও যদি একজন সাহসী কলম সৈনিক হয়ে থাকেন তবে আপনাকে স্বাগতম। প্রতিধ্বনিতে যুক্ত হয়ে আওয়াজ তুলুন।
এই ধরণের আরো লেখা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

প্রতিধ্বনির বর্তমান মূল্যprotiddhonii.com estimated website worthprotiddhonii.com domain valuewebsite worth calculator

সাম্প্রতিক লেখা

Recent Comments